বিষন্নতাকে ভোগ চড়াতে হয়। ফুলে, ফলে নৈবেদ্য সাজাতে হয়। ধূপ জ্বেলে বলতে হয়— ও বিষন্নতা, যা তুমি আমায় শিখিয়েছো, যা তুমি আমায় পড়িয়েছো, যা তুমি আমায় বুঝিয়েছো, বারবার তা অতি বরণীয় — তা আমার জীবন পথের ভিত পুজো। আমার পুজো গ্রহণ করো। আমার যা কিছু তোমার বিষাদে শিখিয়েছো, সে শিক্ষার নিষ্পত্তি ঘটাও, আনন্দের পথ দেখাও।
তখন প্রয়োজন হয় বলি পুজোর। কী বলি দিই, কী বলি দিই ভাবতে ভাবতে ডুবতে হয় নিজেতে। কিন্তু ডোবাও তো চাট্টিখানি কথা নয়। কী করে ডুববো? কী করে শিখব সেই প্রেমময়ীর দিব্য প্রেমসাধন! যে প্রেমে শবে আসে প্রাণ, যে নেশায় ত্রিধারা রুধি ঝরে পড়ে শ্বেত সরোবরে। নামে প্রেম আর প্রেমে নাম অব্যয় আর ধাতুর বাঘবন্দি খেলা। ধরা দেয় শরীর ফাঁদে।
মন গুনগুনিয়ে ওঠে—
প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে
কে কখন ধরা পড়ে কে জানে
ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর — যোগ্য বলির পাঁঠা। আঠালো মন মানতে চায় না। খুঁজে ফেরে সংস্কার। কোন পথে যাই আর কোন পথে নাই – এই ভেদাভেদে ছড়িয়ে পড়ে। গুরু শিষ্যকে বলেন — মন বড় উচাটন হয়েছে, যাও বিশ্রাম দাও। গায়ত্রী আশ্রয় করো। বিশ্রাম কি আদেও বিশ্রাম! ততক্ষনে প্রেমময়ীর পদতলে ভক্তিভ্রমর গুনগুনিয়ে নাম ধরেছে। জপে চলেছে অবিরাম।
এ কোন দেশে এলাম! সূর্য যেন গলে পড়ে, আকাশ যেন ছলকে ওঠে, মন যেন বাতি চায়। একটু আলো, আরও একটু এই করে গলে পড়ে আপন জ্যোতির খেলা। ততক্ষণে মাতাল টলে পড়েছে রাস্তায়। কে তাকে ধরে, কে তাকে ফেলে, কে তাকে পৌঁছে দেয় তার নিজের আশ্রয়! এক রাজা আছে — আজব দেশের গজব রাজা। কে যেন কবে বলেছিল তার দোহাই দিলে রাত কানে কানে বলে যায়, পথ চলে যায়, ভয় থাকে না। দোহাই দিতে তো লাগেনি, যেই ভেবেছি অমনি শুনেছি রথের ঝনঝনানি। কে আসে, কে আসে। আঁধার দেশের গজব রাজা, হাতে তার ছেঁড়া কাঁথা, গন্ধ যেন ঠিক মায়ের গায়ের। ও রাজা তোমার এতই প্রতাপ! তবে তো দাও একটু তাপ, একটু গরম হই। রাজা তো ছোঁবে না, সে ছুঁলে যে পুড়ে যাবো, মিশে যাবো একেবারে। তার চেয়ে রাজা তুমি জ্বলো, আরও জ্বলো, আমি আরও নিজেকে মিলিয়ে নিই তোমার আলোয়। ততক্ষণে আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। সাধনায় ছেদ আমার গুরু মোটেই পছন্দ করতেন না। বলতেন বিশ্রাম—বিশ্রাম না করে সাধনাকে বিশ্রাম কর, নিঃশ্বাস কে কর্ম কর, বায়ুকে বর্ম কর, ব্রহ্ম কে অগ্নি জ্ঞান কর। সে মানুষ বড় আজব কারিগর! জলে জলে জ্বালিয়ে তিনি গুড় বানান। এবার আমায় এগিয়ে যেতে হবে। বলির পাঁঠা খুঁজতে। কিন্তু কোন দিকে? পাখির তো দিক নেই, দিকের চিন্তা করতে নেই। সবদিকেই ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ। কাল হাঁটছে, কাল চলছে, কাল টিকটিক করে বলে যাচ্ছে — আছি, আমি আছি। তোমার সাথেই চলছি। কাল বলতেই আগামী ভাবাই শ্রেয়। ওতে দ্বন্দ্ব কমে। আগামীকাল মেরুদেশ খুঁজতে হবে। তার জন্য মেরু পুজোর প্রয়োজন। অগ্নিহোত্রী ব্রাহ্মণ চাই, যার আগুনের জ্ঞান আছে। সেই করবে এই মেরু পুজো। শরীরকে তীর বানিয়ে নিক্ষেপ করতে হবে সেইদিকে যেদিকে সূর্যনারায়ণের পেল্লাই রাজপ্রাসাদ। ব্রহ্মাণ্ডের নাভিপদ্ম জানিয়ে দেবে আমার গন্তব্য স্থল। ভাবতে ভাবতেই ঢলে পড়লো সূর্য, মাথার ওপর ঈষদুষ্ণ গরম আর অনেকটা নরম। আমার বালিশ হলো।
পাখিরও ঘুমের প্রয়োজন হয়। রাত বেড়েছে। পাগলামোটা চেপে বসার আগে থামতে হবে। আজ এটুকুই বরাদ্দ। আবার গল্পটা বলবো অন্য কোন দিন না হয়। একটু আগেই বলেছি কাল বলতে আগামীই ভালো, ওতে দ্বন্দ্ব থাকে না