—— মনে হচ্ছে আমি ময়দান তাঁবুর কাছে আছি । তুমি কোথায় ?
সত্যবতী প্রচন্ড ভীত হয়ে পড়েছিল । তার ওপর কান্নার স্রোতে বাঁধ দিতে গিয়ে কথাগুলো হোঁচট খাচ্ছিল বারবার । সেই অবস্থাতেই প্রচন্ড অভিমান নিয়ে বলে উঠলো সে ,
——- যেখানে ফেলে গেচিলে । ফাঁকা রাস্তায় । চলে এসো । এখুনি । খুব ভয় করছে ।
সন্দীপন নিজেকে শক্ত করে উত্তর দেয় যে সত্য যেন না ঘাবরায় । সে আসছে ।
তারপর সে রাস্তা পার করে পেছনে হাঁটা লাগায় , যদিও গন্তব্য কত দূর তার বিন্দু বিসর্গ জানা নেই কিছুই । এদিকে এগিয়ে চলেছে সময় , ওদিকে এগিয়ে চলেছে পাগল হয়ে ওঠা সন্দীপন ও তার হৃদয় আর অন্যদিকে মুহুর্মুহু বেজে ওঠা রিংটোনে এক আতঙ্ক ,
— তুমি কোথায় ?
সত্যবতী-র কাতর প্রশ্নগুলো আজ নিরুত্তর দেখে সন্দীপন আরও বিচলিত হয়ে পড়ে । গতি বারে পায়ের , গতি বারের মোবাইলের কান্নার অন্তর্বতী সময়ের । অবশেষে নিরুপায় ছেলেটি একটা ধার দেখে দাঁড়িয়ে , সত্যকে বলে
—- আশেপাশে কেউ আছে তোমার ?
সত্য কয়েক মুহূর্ত ঘাড় ঘুরিয়ে চেয়ে দেখে চারপাশ , তারপর করুন স্বরে ভেসে আসে তিনটি অক্ষর ,
—- পু লি স ।
“পুলিস ! বেশ চমকে উঠেই সন্দীপন উত্তর দিল , মানে কোন রাস্তার মোড়ে বা থানায় ।” কিছুই ঠিক করে বুঝে উঠতে পারছে না সে যখন , তখন পাশ দিয়ে এগিয়ে আসা এক ট্যাক্সিকে দাঁড় করিয়ে বেশ উদগ্রীব স্বরে বলে উঠলো সে ,
—- একটু হেল্প করবেন দাদা । আমরা দুজন ছিলাম । বাসে করে ফিরছিলাম , হঠাৎ বাসটা কোন এক সিগন্যালের কাছে দাঁড়ায় । সে নেমে পড়লেও আমি নামতে পারি নি । কোথায় , কোন জায়গায় কিছুই বুঝতে পারছি না ।
ট্যাক্সি ওয়ালা বেশি কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠে আসতে বললে সন্দীপন কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হলো বটে তবে প্রাক সন্ধ্যা মুহূর্তে বেশ কিছু পথ খোঁজা খুঁজি করেও সত্যের ঠিকানা না পাওয়ায় অস্থিরতা আবার গ্রাস করলো তাকে । এদিকে তার অস্থির হৃদয় আর ওদিকে সত্যের ক্রমাগত ফোন — দুদিক সামলাতে সামলাতে তার অবস্থা বেশ কাহিল । সূর্যের শেষ লাল রংটাও এবার দুপ করে নিভে গেল আর সাথে সাথে কালো অন্ধকারে গ্রাসিত হলো গোটা শহর । এ পথ ভালো কিছু দিয়ে যেতে পারে না , তবে বহু অন্যায় এ পথে প্রায়শই ঘটে যায় আর সে আশঙ্কাই ট্যাক্সি আর দুই বাহকের মনকে আরও চিন্তিত করে তুলছে বারবার ।
ঘড়িতে তখন ছটা । শীতের সন্ধ্যায় রাত ঘন নিবিড় হয়ে উঠেছে খুব । রাস্তাঘাট প্রায় শুনশান । শুধু কিছুজনের বাড়ি ফিরতি ভিড় চোখে পড়ছে । ট্যাক্সি আর দুই মাহুত এমনই এক পথের ধারে দাঁড়িয়ে চিন্তায় মগ্ন , জায়গাটি কোথায় ! এরই মাঝে সমস্ত নীরবতা ভেঙে দিয়ে মোবাইলটা আবার বেজে উঠলো । এবার কিন্তু সব স্বাভাবিক ছিল না আর । ওপাশ থেকে এবার যা ভেসে এলো , তা সন্দীপনের মুখের রঙ বেশ ফ্যাকাসে করে দিল নিমেষে ।
—- হ্যালো । আপ সত্যবতী নাম সে কিসিকো জানতে হ্যায় ।
গলাটা বেশ গম্ভীর আর সেই গম্ভীর স্বরটি সন্দীপনের মুখ থেকে হা শোনা মাত্রই পুনরায় বলে উঠলো ,
—– ম্যায় ট্রাফিক হাওয়ালদার বোল রহা হু । সত্যবতী মেরে ইহা ব্যায়ঠি হ্যায় । ট্রাম লাইন কে পাস ওয়ালা ক্রসিং আকে লে যাও উসে ।
এটুকু বলেই ফোনটা কেটে দিলো সে আর সন্দীপন ; মনে হলো শীতে গরমের অভিজ্ঞতা করে ফিরছে আজ ।