• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক উপন্যাসে সপ্তর্ষি মণ্ডল (পর্ব – ৭)

অজ্ঞাত

২৯।।
প্রেমের কোন দিন হয় না , কোন তিথি হয় না ; হয় শুধু অপেক্ষা । তেমনই অপেক্ষায় সন্দীপনের সকাল নামতো । চায়ের পেয়ালা হাতে ফোনের ঘন্টা বেজে উঠে বলতো ,
—- গুড মর্নিং …
একটা বিশাল হাই তুলে সন্দীপনের উত্তর যেত সাথে সাথে ,
—- গুড মর্নিং টু ।
অফিসের লাঞ্চ আওয়ারে ভিডিও কলে সত্য ফোন করতো ; প্রায়ই । এক মুখ হাসি নিয়ে বলতো ,
—— খাবার খেয়েছো ।
উত্তর যেত এক মুখ হাসি নিয়ে ,
—– খেয়েছি । তুমি খেয়ে নাও ।
বেশ আবদারি ভঙ্গিমায় উত্তর আসতো তখন ,
—– খাবো তো ।
তারপর তার প্রিয় টেডি গনসা কে কোলে নিয়ে এসে দাঁড়াতো ব্যালকনিতে সে । সত্যের অপরূপ সে রূপের মায়া বিরাজ করতো তার শরীর জুড়ে সারাটা দিন । তারপর রাত নামতো আকাশ জুড়ে । গভীর নিস্তব্ধতা গ্রাস করতো ভোপাল শহরটাকে যখন , তখনও সত্যবতী আর সন্দীপনের চোখে ঘুম নেই । কত পরিকল্পনা মুহূর্তে বাস্তব হয়ে যেত ওই কয়েক ঘন্টায় । অবশেষে আসতো সেই ঘুম চুমুর পালা । সত্যের গুড নাইট শব্দে সন্দীপনের চোখে ঘুম নামতো । ঠিক মায়ের জায়গাটা সে করে নিয়েছিল সন্দীপনের জীবনে । হয়ত প্রেম ঘন হলে , প্রেমিকা এমনি করেই মা হয়ে ওঠে ।
আজ রবিবার । ছুটির দিন । আনন্দের এক একটা মুহূর্ত আজ সত্যের জন্য কষ্টের হয়ে উঠছে । সেই আটটা থেকে ফোন করে চলেছে সে , দু ঘন্টা পেড়িয়ে গেলেও সন্দীপনের কোন সাড়া নেই ।
নিজের অস্থির মনকে ধরে রাখা যাচ্ছে না কিছুতেই । অনবরত নিজেই নিজেকে বলে চলেছে সত্য ,
—- স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন , প্রভু অহং আজ করো সব ভগ্ন
লড়াইয়ের সুরে , শুনি ডঙ্কা বাজে বহুদূরে
দাও কালবশেখের শক্তি যত এ প্রাণে ঢালি
অন্ধকার যত হর প্রভু মম দু নয়নে ।
আলো যত ভালো আছে এ সংসারে
প্রভু আমার মনে দাও তুমি সবেরো ভরি
দাও শুভ যত যেন অশুভেরে কভু নাহি ডরি ,
প্রভু, বাঁশির সুরে দাও নতুন গান
মোরে তুমি বারেবারে দাও ভিখারির স্থান
তব চরণ ধুলার তলে ।
তবে উৎকণ্ঠা শুধু এখানে নয় আজ । সে আজ একলা নয় । পরিচয়ের বহু দূরে সন্দীপনের মা ও বিচলিত ছেলের সারা না পেয়ে । মনে মনে তারও ভাবনা প্রকট হয়ে উঠছে ,
——- হে ঈশ্বর , আমার সন্তান যেন সুস্থ থাকে । তুমি দেখো , যেন কোন বিপদ ওকে ছুঁতে না পারে ।
ফোনের পর ফোন জমা হয়েছে ওই ঘরে । অবচেতন সন্দীপন বুঝতে পারে নি এসব কিছুই । সত্যবতী ওদিকে কি করবে বুঝতে না পেরে , ফেসবুক খুলে বসে । বন্ধু শুভ র সাথে একটু হলেও পরিচয় ছিল , তাই তাকেই লিখে পাঠালো সে ম্যাসেঞ্জারের পাতায়,
—— শুভ দা , সন্দীপন সকাল থেকে ফোন ধরছে না । তুমি একটু দেখবে গো খোঁজ নিয়ে ।
খবরটি পড়ে শুভ যেন আকাশ থেকে পড়লো । সে তৎক্ষনাৎ ফোন করলো সন্দীপনের নম্বরে ; তারপর সত্যবতীকে লিখে পাঠালো ,
—— ও তো আমারও ফোন ধরলো না । ওর মাকে ফোন করলাম । সেও চিন্তিত । মনে হচ্ছে , পুলিশে খবর দিতে হবে একবার ।
সত্য বেশ ভয় পেয়েই লিখে পাঠায় ,
—— পুলিশ কেন ! কি হয়েছে ওর ।
—— কি হয়েছে জানতেই তো পুলিশ ।
শুভ লিখে পাঠায় ।
সত্যবতী রাজি নয় কিছুতেই ।
—— না । আর একটু দেখি না আমরা । ঠাকুর কিছু না কিছু নিশ্চই উপায় করবে ।
একদিকে শুভ চিন্তিত , একদিকে সন্দীপনের মা আর অন্যদিকে চিন্তিত সত্য যখন ; তখন বারোটার ঘন্টা বেজে উঠলো ঘড়িতে , সত্যের বাড়িতে ।
৩০।।
দীর্ঘ প্রতীক্ষা নয় , প্রচেষ্টার একটা ফল থাকে । সন্দীপনের বন্ধু শুভ সেই উত্থাল সাগরের মাঝেও তীর খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো । এক ঘন্টা আরও পার হলে উৎকণ্ঠা আরও তীব্র হয়ে উঠলো সকলের মনে । এরই মাঝে আশার আলো খুঁজে পেল শুভ , যখন , আজকের মত প্রথমবার সন্দীপনের ফোন ব্যস্ত এলো । সময় নষ্ট না করে সত্যবতীর দেওয়া নম্বরে ফোন করলো সে । না এখানে ব্যস্ততার চিহ্ন মাত্র নেই । উল্টে মুহূর্তের মধ্যে সত্য ফোনটি রিসিভ করেই বলে উঠলো তাকে ,
—– কোন খবর পেলে , শুভ দা ?
শুভ নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে উত্তর দিলো ,
—– পেয়েছি । ব্যস্ত আসছে এই প্রথম ।
সত্যবতীর আনন্দের সীমা নেই । চিৎকার করে বলে উঠলো সে ,
—– হনুমান আমার প্রার্থনা শুনেছে । তুমি ফোনটা রাখো ।
এটুকু বলেই সত্য ফোন কেটে দিলো এবং সটান ডায়েল করলো সন্দীপনের নাম্বারে । কয়েকবার রিং হতে না হতেই ফোন তুললো সন্দীপন আর তারপর ওপর প্রান্ত থেকে এক অদ্ভুত স্বর ভেসে এলো । গলাটা সত্যর সে কথা সন্দীপন ঠাহর করতে পারলেও , ওই অদ্ভুত স্বর সে কোনদিন শোনে নি । এক অদ্ভুত আনন্দ আর অভিমান মিশে গেছে আজ , তার কন্ঠে ;
—– কি হয়েছিল তোমার ? কিছু হয় নি তো ? কেউ কিছু করে নি তো ? তোমাকে নিয়ে পারি না । কোনদিন তোমার জন্য আমার প্রানটা বেড়িয়ে যাবে দেখো ।
সন্দীপন চুপ করে সব শুনে চলেছিল ওদিক থেকে ভেসে আসা সমস্ত অভিযোগ ভালোবাসার ,
—– কোন দ্বায়িত্ব নেই একটা । পচা ছেলে । সেই সকাল থেকে ফোন করে যাচ্ছি । তোমার জন্য আমার কত চিন্তা হয় তুমি আর কি বুঝবে ।
সন্দীপন সব শুনে চলছিল এতক্ষন ধরে । তারপর আস্তে করে শান্ত গলায় উত্তর দিলো সে ,
—– সরি । ঘুমিয়ে পড়েছিলাম …
কথাটা ঠিক করে শেষ করতেও হলোনা তাকে , ওপাশ থেকে প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে বলে উঠলো সত্য ,
—– কুম্ভকর্ণ জুটেছে একটা । এত বেলা অবধি পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছেন উনি । কথা বলবে না আর আমার সঙ্গে ।
সন্দীপন দু তিনবার সত্যবতী বলে ডাক দিলেও , সত্য ফোন সুইচ অফ করে রেখে দিল । প্রেমিকা হীন নায়কের মনে হাজার হাজার চিন্তা যখন , তখন এ কলহ তাকে এক প্রকার মুষড়ে দিয়ে গেল । জীবনে তার আয়লা বয়ে গেছে এমন সময়ে মোবাইলটা বেজে উঠলো আবার । সত্য অনুমান করে ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো মায়ের সেই কন্ঠ ,
—– বাবু , ঠিক আছিস তো ! কি হয়েছিল ? ফোন তুলিস নি কেন ?
এখন সে মা কে কি করে বোঝায় , ঘুমের ওপারে সে ঠিক ছিল ; কিন্তু এখন একদমই ঠিক নেই জীবন । তবু সাহস করে ধৈর্য ধরে উত্তর দিলো সে ,
—– তেমন কিছু নয় , ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ।
—– ঘুমিয়ে পড়েছিলিস ! এত অবেলা অবধি !
মা বেশ অবাক হয়েই উত্তর দিলো ।
ছেলের মন এদিকে আর প্রশ্ন নিতে রাজি নয় । তার এখন মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরছে , সত্যের কি হবে ? তার রাগ কি করে ভাঙাবে সে ? আর তাই মায়ের কথায় এক রকম বিরক্ত হয়ে সে বললো ,
—– বললাম তো ও কিছু না । হয়ে যায় মাঝে মাঝে । এখন ফোন রাখো তো তুমি ।
এই বলে সে ফোন কেটে দিলো । তবে তাতে শান্তি যে এলো তা কিন্তু নয় । বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলেও সত্যবতীর ফোন সুইচ অফ সে পেল বারবার ।
এরই মাঝে মোবাইল বেজে উঠলো আবার । তুলে দেখে শুভর ফোন । বেশ বিরক্তিসূচক মুখ নিয়েই ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো সেই এক প্রশ্ন ,
—— কি ব্যাপার কি ! বোকাচোদা , গাঁজা টেনেছিলে সকাল সকাল ।
সন্দীপন বেশ মেজাজ নিয়েই উত্তর দিলো এবার ,
—— ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । এবার রাখবি তুই ।
শুভও ওদিকে ছেড়ে দেওয়ার ছেলে নয় । সেও বেশ মেজাজ নিয়েই উত্তর দিলো আবার ,
——- রাখবি মানে । রাখবো কেন ? শালা , এত কিসের ঘুম তোর । প্রেম করছো , দুদিন পরে বিয়ে করবে । তখন দেখবো কটা রাত ঘুমিয়ে কাটাও । তখন তো বউকে …
সন্দীপনের আর সহ্য হচ্ছিল না । সে ফোনটা কেটেই দিল এবার , এক প্রকার জোর করে । বন্ধুর এ হেন আচরণে শুভ বেশ অবাক । তবু মুখে কিছু বললো না আর , শুধু মনে মনে বলে উঠলো ,
” প্রেমিকা পেলে সবাই শালা বন্ধুদের ভুলেই যায় ” ।
৩১।।
সাফল্যের জন্য যেমন তপস্বীকে একাগ্র চিত্তে প্রভু নাম জপে যাওয়া উচিত , শিক্ষাত্ৰীকে যেমন জ্ঞান লব্ধ করতে একলব্যের মত গুরু চরণে তপস্বী হয়ে থাকা উচিত , তেমনি প্রেম সাগরে ডুব দেওয়া মনের উচিত সময়ের জন্য অপেক্ষা করা । সময় , এক শক্তিশালী শক্তি , যা বড় বড় বাঁধা সুস্থ করে তোলে অনায়াসে । সময়ের অপেক্ষা ছাড়া প্রেমিক যুগল কি আর করতে পারে ! শুধুই সময় নাম জপে যাওয়া , জপে যাওয়া আর জপে যাওয়া ।
সাগরে ঢেউ উঠবে , প্রচন্ড বেগে উঠবে ; তাই বলে লক্ষ চ্যুতি হলে তো সলিল সমাধি হওয়ারই কথা । কিন্তু যারা ইষ্ঠ নাম আঁকড়ে ধরে কর্মযোগে লিপ্ত হয় , তার নৌকা সাগরের বিশাল ঢেউ কাটিয়ে একদিন নোঙর ফেলে প্রেম সাগরের কিনারায় । জয়ধ্বনি গর্জে ওঠে চারিপাশে , ইষ্ঠধ্বনি গর্জিত হয় তার মনে আর প্রেমধ্বনি কম্পমান হয় গোটা শরীর জুড়ে ।
সন্দীপনের আজকের তপস্বা ঠিক তেমনই । সত্যর জন্য অপেক্ষা করা , সত্যের মানভঙ্গের তাগিদে । তবে অপেক্ষাটা এত সোজা নয় , সে নিজেও যে অপেক্ষা করিয়েছে আজ সারাটা দিন , তাহলে সত্যর আর দোষ কি । দেখতে দেখতে দুপুর পেড়িয়ে বিকেল , বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো আকাশে । মেঘেরা ঘরে ফিরে গেছে যখন , তখন মোবাইলের কণ্ঠে বেজে উঠলো সেই চেনা ডাক ,
—— খুব রাগ করে ফোন করিনি তোমায় ।
সত্যবতী বলে চললো ওপাশ থেকে ।
—— ওভাবে কেউ ঘুমায় । জানো কত চিন্তা করছিলাম । শুভ দা কে যোগাযোগ করেও যখন কোনো খবর পেলাম না , তখন শুধুই সংকটমোচনের কাছে প্রার্থনা করে গেছি সারাটাদিন ।
——- সরি গো । জানি না আজ কেন এত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । সরি ….
সন্দীপন উত্তর দেয় । তার গলায় এক ভালোবাসার ছাপ । আর ওদিকে সত্য , ভারি কণ্ঠে বলে ওঠে আবার ,
——- নিজের খেয়াল রাখো । আমি অনেকদিন পর হাসছি । এ হাসি থামতে দিও না গো ।
সত্যের কথায় সন্দীপনের দু চোখ ছলছল করে ওঠে । তবু নিজেকে সামলে সে উত্তর দেয় ,
—— এত ভালোবাসো আমায় !!
শান্ত গলায় উত্তর আসে এবার ,
—– আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বাইক এক্সিডেন্টে মারা যায় দু বছর হলো । ওর সাথে প্রাণ খুলে কথা বলতাম । ওর এক্সিডেন্ট , মৃত্যু আমাকে ভেঙে দিয়ে গেছিল । এর পর দুজন এসেছিল জীবনে , কিন্তু , থাকেনি কেউ । বুঝেছিলাম যে ওই দুজনই ভালোবাসা নয় , অন্য কিছুর জন্য কাছে আসতে চেয়েছিল । একমাত্র তোমাকেই পেলাম , মনের মতো কেউ । এত সহজে হারাতে দিতে পারি তোমায় ।
আজ আসি । তোমার সাথে কথা বলবো বলে , বাজারে আসার নাম করে স্টেশনে বসে কথা বলছিলাম । বাড়ি ফিরতে হবে । বাঙলায় এসো , অনেক ভালোবাসা দেবো ।
সন্দীপন আর জোর করলো না তাকে । শান্ত গলায় উত্তর দিলো
—— সাবধানে যেও । আর রাতে পারলে ফেসবুকটা দেখো ।
সত্যবতী ফোন কেটে দিয়ে এগিয়ে চললো বাড়ির দিকে । এদিকে সন্দীপনের দু চোখে তখনও বাধনহারা অশ্রুধারা বয়ে চলেছে । তার বিশ্বাস হচ্ছে না , কেউ তাকেও এত ভালোবাসতে পারে !!
গভীর রাতে সন্দীপনের কথা মতো ফেসবুকে উপস্থিত সত্যবতী । ম্যাসেঞ্জারে সন্দীপন কে দেখে সে লিখে পাঠায় ,
—— কি গো আজ ফোন করবে না ।
—— বিশেষ মুহুর্ত ফোনে নয় , চোখে চোখে পালন করতে হয় । একটা উপহার ছিল তোমার জন্য ।
সন্দীপন উত্তর দেয় ।
সন্দীপনের কথায় বেশ অবাক হয়েই সত্যবতি লিখে পাঠায় ,
—– উপহার ! কি উপহার ! কোথায় ?
সন্দীপন আর কোন উত্তর দেয় না । কয়েক মিনিট নীরব থাকে সবকিছু আর তারপর সত্যবতীর স্ক্রিনে ভেসে ওঠে কিছু কথা , কিছু লেখা …
” বাইরে ঘন শ্রাবণ ধারা ঝরে পড়ে ।।
কাঁচের জানালায় ফোঁটা ফোঁটা , টপ টপ শব্দ করে ।।
ঘরের মধ্যে তারই পাশে বসে সত্যবতী ।। দূরে দাঁড়িয়ে
তার প্রিয় সন্দীপন ।।
সত্য : বরষা আমার বড়ই প্রিয় সর্বদা ।। কি সুন্দর লাগে !! কি দারুন !! যেন কোন বার্তা ভালোবেসে নিয়ে এসেছে কেউ ; ওই মেঘেদের ওপার থেকে ।।
সন্দীপন : তাই বুঝি !! তবে তো হিংসা করতে হয় ।। বৃষ্টির এই সতিনতা আমার জন্য মোটেও ভাল নয় ।।
সত্য : যা: !! কি যে বল ।। বৃষ্টি আমার গান আর তুমি আমার প্রাণ ।। বৃষ্টি জীবনে আনে অনেক খুশি আর
তুমি মুঠো মুঠো আনন্দ ।।
সন্দীপন : এইটি শুনতে চেয়েছিলাম ।। আমি জানি তুমি আমায় কত ভালবাস …
সত্য : সে কি তুমি কম বাসো আমায় ।।
সন্দীপন এবার দুপা এগিয়ে যায় সত্যের দিকে ।।
সন্দীপন : সাহিত্য , রহস্য এই নিয়েই তো ছিলাম ।। তারপর হঠাৎ তোমাকে দেখলাম ।।
ঠিক যেন একটা হলুদ পাখি সবুজ গাছে বসে অপেক্ষায় মেঘের দিকে চেয়ে ।। নিচ থেকে অনেকেই
মুগ্ধ ভাবে চেয়ে আছে ।। তোমায় একটি বার কাছে পাবে তাই ।।
সত্য : তাই বুঝি !! তাহলে তুমি কেন ডাক দাওনি সেদিন ।।
সন্দীপন : দিয়েছিলাম তবে মনে মনে ।। তারপর একদিন সেই মনের কথাগুলোই চিঠি হয়ে ফুটে উঠলো জীবনে ।।
সত্য : তারপরেও তো মুরোদ ছিল না বলবার ।। ভালোবেসে আমাকে জোর করে কেড়ে নেওয়ার ।।
ভাগ্যিস , সব কিছু বুঝতে পেরেছিলাম আর তাই বলে দিলাম ।।
সন্দীপন : সত্য , তুমি সত্য আমার ।। তোমাকে কাছে পেয়ে জীবন সত্যিই ধন্য আমার ।।
সত্য : একটা কথা বলবে ।। তুমি এত ভাল কেন গো ??
সন্দীপন : হয়ত তুমি এত ভাল তাই ।।
এটুকু বলে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরল ।। দুজনের মুখে একটাই কথা তখন
আই লাভ ইউ টু ” ।।
নীচে লেখা শুভ রাত্রি ।
সত্যবতী আজ শুভ রাত্রি লিখলো না আর , বরং প্রত্যুত্তরে সে লিখে পাঠালো
কবিতার শেষ লাইনটা ” আই লাভ ইউ টু ” ।।
৩২।।
দিনটা ২০সে অক্টোবর । সেদিন ছিল সত্যবতীর জন্মদিন । আর তারই পাশাপাশি সত্যবতীর জীবনের পরীক্ষা । আসলে পরীক্ষা মানেই ভয় , এই টা বেশ কিছু মাস যাবৎ সত্যবতীর মাথায় গেঁথে গেছিল । সুদূর দিল্লি থেকে সকাল সাতটায় যখন মোবাইল টা চিৎকার করে উঠলো সত্যবতী তখন পরীক্ষা দিতে যাবে বলে সাজুগুজু করতে ব্যস্ত । যাই হোক সবার নজর এড়িয়ে সেদিন সে ফোনটা তুলতে সফল হয়েছিল । রিসিভ বাটন টা টিপতেই ওপাশ থেকে সেই চেনা গলায় ভেসে এলো সেই লাইনটা , যার জন্য এতক্ষন ধরে অপেক্ষা ছিল তার । আসলে ভালোবাসার মানুষটির মুখ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা না পেলে অনেক কিছুই না পাওয়া থেকে যায় ।
—– হ্যাপি বার্থডে টু ইউ ।
সন্দীপনের গলায় বহু প্রতীক্ষিত কথাগুলো ভেসে এলেও সত্যবতী আজ বিশেষ কিছুই বলতে পারেনি । ফোন কাটার আগে শুধু হালকা কণ্ঠে উত্তর দিলো ,
—– ধন্যবাদ ।
সারাদিন হলবন্দি সত্যবতী যখন মুক্তির আকাশ খুঁজে পেল , ঘড়িতে তখন বিকেল ৪টে । তারপর সেখান থেকে মায়ের হাত ধরে বাড়ি ফেরার তাড়া । বাসে ট্রেনে চন্দননগর পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যে ৭টা হয়ে গেল । এর মধ্যে সত্যবতীর যে সন্দীপনের কথা একবারের জন্য মনে পড়েনি ঠিক তেমনটি নয় , তবে মা সঙ্গে থাকায় কথা বলার বা ম্যাসেজ করার সুযোগ হয়নি তার । বাসে বা ট্রেনে বসে বা দাঁড়িয়ে , রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে সত্যবতীর মনে হচ্ছিল আর কতদিন এভাবে মায়ের আঁচলের আড়ালে চলতে হবে তাকে । আফসোস করে নিজের মনকে বারবার বলছিল সে ,
” ইস ! আজ যদি সন্দীপন সঙ্গে থাকতো তাহলে কত মজাই না হতো “।
বাড়ি পৌছেই আর সময় নষ্ট করে নি সে । মনের মানুষটিকে একটিবার কাছে পেতে সে সোজা নিজের ঘরে ঢুকে পড়ে । ফোন করার তেমন সুযোগ নেই এখন । তাই ফেসবুক একমাত্র সাধন হতে পারে মনের মানুষটার কাছে পৌঁছানোর মনে করে সে ল্যাপ টা অন করলো । এর আগে পর্যন্ত সত্যবতীর মধ্যে এরকম ব্যাকুলতা , উদগ্রীব স্বভাব কোনদিন কারুর চোখে পড়ে নি । কিন্তু ওই যে কথায় আছে , প্রেমে পড়লে সব মানুষ ই বদলে যায় । সুতরাং , সত্যবতীর ক্ষেত্রেও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় কী করে ? ফেসবুকে অন হতেই সত্যবতী তো হতবাক !! একদম অন্যরকম এক প্রাপ্তি দাঁড়িয়ে তার সামনে , সৌজন্যে সেই পাগল ছেলেটা , সন্দীপন –
” আর তো কিছুক্ষন ।। সময়ের পাল্লায় সেই সময় এসে দাঁড়িয়েছে ,
একদিন সন্দীপন যখন নিজের প্রিয় অংশটুকু
সযত্নে পাঠিয়ে ছিল পৃথিবীর কাছে ।।
সেদিন থেকে এইদিন ; সত্য ; ১৩২ খানা ঋতু পেরিয়ে এসেছ
বেড়েছে বয়স , বেড়েছে অভিজ্ঞতা , চিনেছ পৃথিবীটাকে
অনেকটা ।। আরও পথ চলতে বাকি ,
অনেক অধ্যায় জীবনে আসতে বাকি , আমি ধন্য
এ পথে তোমার সঙ্গী হতে পেরে ।।
ভবিষ্যৎ চিনি না ; কিস্সু জানি না
শুধু বুঝি এটুকুই , সত্য , কোনদিন পালিয়ে যাব না
তোমাকে ছেড়ে ।।
২২ এর দোরগোড়া আজ খোলা ।। স্বাগতম জানাতে হয় তোমায় ।। তবে আড়ম্বর দিয়ে নয় ,
এ জীবন্ত দেবীর আজ
অভিষেক হোক সামান্য টুকু রেখে দেওয়া ভালবাসায় ।।
মহাভারত থেকে ব্যোমকেশ ; সর্বত্রই তুমি ছিলে ,
কোথাও প্রেমিকা হয়ে তো কোথাও নায়িকা হয়ে ।।
সত্য , তোমায় ছাড়া ব্যোমকেশ যেমন অধরা ; ঠিক তেমনি
একটুকু সোহাগ ছাড়া এ বুদ্ধিমতি , সত্যবতী আমার —
তার ২২ এর এই মুহূর্ত টুকুও খুবই পাতলা ।।
ডাকহরকরা এসে গেছে , মেঘের চিঠি হাতে নিয়ে —
চোখ খোল এবার : ২২ এর আগের পর্বেও আবার
ব্যোমকেশের জীবনে সত্যবতী ; তোমাকেই যে দরকার ।। “
মেসেজটা পড়ে বেশ কিছুক্ষণ নিজের মনের মধ্যেই আজ কেঁদেছে সত্যবতী । ভাল লাগছে না তার ,মনে হচ্ছে যেন পৃথিবী থেকে কেউ তাকে দূরে সরিয়ে রেখে দিয়েছে আজ । তবু সমস্তটাই নিয়তি বলে মেনে নিয়ে সে পরের দিন আবার বেড়িয়ে পড়েছে পরীক্ষা দিতে । সন্দীপন যেমন লক্ষ তার , তেমনই তার লক্ষ বিন্দু চাকরি পাওয়াটা সন্দীপনেরও যে লক্ষ তাই …
৩৩।।
আজ রবিবার । সন্দীপন একদিকে ব্যস্ত যেমন ঘরের কাজে , সত্যবতীও সে জানে পরীক্ষা নিয়ে আজও ব্যস্ত আর তাই গুড মর্নিং শোনার জন্য হাজার ইচ্ছা হলেও , সে নিজেকে অনেক সংবরঙ করে রেখেছে আজ । ঘড়িতে তখন সকাল এগারোটা । প্রতিদিনের মতো মায়ের ফোন এসেছিল আজও । মায়ের সাথে কথা বলে , সে সবে একটু ঘর দুয়ার পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়েছে কি হয়নি আচমকা মোবাইলের শব্দ তাকে আকৃষ্ট করতে শুরু করলো । বেশ স্বাভাবিক ভাবে ফোনটা তুললেও , ওপাশ থেকে ভেসে আসা গলার শব্দে বেশ অবাক হলো সন্দীপন । সত্য ফোন করেছে তাকে ! সে কি ঠিক শুনছে ! স্বপ্ন নয়তো এ কোন ! এসব হাজার প্রশ্ন যখন ভেসে উঠছে সন্দীপনের মনে তখন ওপাশ থেকে ভেসে এলো শব্দ যা তার কানে নয় , ছুঁয়ে গেলো সোজা হৃদয়ে ,
——- হ্যালো । গুড মর্নিং । কি করছিলে ? কোথায় আছো এখন ?
সন্দীপন শান্ত গলায় উত্তর দিলো ,
——- তোমার মনে বসে আছি । তোমার কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ির কাজ করছি ।
সত্যবতী বেশ বিরক্ত হয়েই উত্তর দিলো ,
—— মজা করার সময় নেই এখন । তুমি বর্ধমান আসোনি !
—— বর্ধমান !
সন্দীপন বেশ অবাক হয়েই উত্তর দিলো এবার ।
——- হ্যাঁ গো । আমি আজ পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে যখন বসে অপেক্ষা করছিলাম , তখন তোমার মতোই একজনকে পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢুকে যেতে দেখলাম । কিছু বুঝতে পারলাম না । মনে হলো যেন তুমি এসেছো এখানে । তাই…
সত্যবতী উত্তর দিতেই , সন্দীপন ফোনের ওপাশ থেকে হা হা হা হা করে উচ্চকণ্ঠে হাসতে লাগলো । তারপর হাসি থামিয়ে বললো ,
——- ভোপাল থেকে বর্ধমান কি কম দূর গো !
সত্যবতী আর কথা না বাড়িয়ে উত্তর দিলো ,
——- মা কে মিথ্যে বলে একটু আড়াল থেকে ফোন করছিলাম । এখন আসি । সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে কল করবো তোমায় ।
এই বলে সে ফোন কেটে দিল । সন্দীপনও পুনরায় নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও সে বেশ বুঝতে পারছিল যে , তার হৃদয়ে যে আঘাত লেগেছে সে আঘাতে আজ দুজনই সমান ভাবে আহত । ভালোবাসার এ অপরূপ অবস্থা এত জলদি যে সে খুঁজে পাবে তা মোটেও জানা ছিল না তার । সেই স্বাদের আরও অংশিদার হতে এখন সন্ধ্যার অপেক্ষাই ভরসা তার কাছে ।
তখন দুপুর প্রায় দুটো । সত্যবতীর ফোন আসবে না আজ আর বাড়ির কাজও শেষ । এমন অবস্থায় সন্দীপন নিজের গদির ওপর শরীরটাকে অল্প এলিয়ে বিশ্রামে মগ্ন যখন , ঠিক তখন ভেসে আসা ফোনের রিংটোনে চেতনা ফেরে তার । লেখালেখির জগতে তার অন্যতম বন্ধু ও ভাই নিজাম আলীর নাম জ্বলজ্বল করছে স্ক্রিনের ওপর । বাড়ি ছাড়ার বহু মাস পরে যোগাযোগ আজ তাদের । ফোনটা নিজামই করেছে । বলে রাখি লেখালিখির জগতে পা রাখার সময় থেকে যে মানুষটির সাথে তার পরিচয় ও ধীরে ধীরে সম্পর্ক গভীর হওয়া , সেই নিজাম । প্রথম থেকেই নজরুল ভক্ত ও নজরুলের আদর্শেই চলে এসেছে ছেলেটি । ঠিক কে ঠিক আর ভুল কে ভুল বলাটা তার অভ্যেস । তাই বহু মানুষের চোখে সে আজও খারাপ । তবে সন্দীপনের সাথে তার মিল বিশাল আর তাই আজও তারা একসাথে চলতে পারছে । অবশ্য নিজামের আরও একটা দিক আছে । তার কথা আর একদিন বলবো ।
বর্তমানে দুজনে মিলে একটি পত্রিকা চালিয়ে থাকে , নাম অপরাজেয় । কিছু মানুষের অহংকার, কিছু পত্রিকাওয়ালাদের দাম্ভিকতার সম্মুখীন হয়ে হঠাৎই ঠিক করলো তারা , গুণমান না রেখে শুধু চেনা পরিচিতির বসে লেখাকে প্রাধান্য দেওয়ার যে রীতি , তা ভেঙে চুরমার করে দিতে হবে । বজ্র কলমের চার হাত এক করে জন্ম নিল অপরাজেয় । প্রথম প্রথম তারা কিছুই জানতো না। জানতো না কিভাবে একটা সংগঠন বানাতে হয়। শুধু পাঠক, সাহিত্যকে ভালোবেসে তাদের যাত্রা শুরু হলো । নবীন দের নবীনত্ব, প্রবীনের অভিজ্ঞতা কে পাথেয় করে এগিয়ে চললো তারা । তারপর ধীরে ধীরে অনলাইন থেকে অফলাইন সর্বত্র অপরাজেয় হলো তারা । তরুণ কলমচির স্বপ্নের নাম হয়ে উঠলো অপরাজেয় ।
আজ সন্দীপনের বাঙলা ছাড়ার পর দীর্ঘদিন পত্রিকা বন্ধ । নিজামের এই কল সন্দীপনকে ইতিহাস আর বর্তমানের মাঝখানে দাড় করিয়ে রেখে দিল , বেশ কিছুক্ষণ । তারপর তৃতীয়বার মোবাইল বেজে উঠতেই উত্তর গেল ,
—– বল নিজু ।
নিজাম নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে উত্তর দিলো ,
—— কি ব্যাপার গো সন্দীপন দা । অপরাজেয় , নিজাম সব ভুলে অজ্ঞাতবাসে চলে গেলে একদম করে । প্রেম টেম করছো নাকি ।
সন্দীপন মনে মনে মুচকি হেসে উত্তর দেয় ,
—– না ঠিক তা নয় । তবে কি জানিস তো আমি বাংলা ছেড়ে ভোপাল চলে এসেছি । নতুন জায়গা তো তাই সব খেই হারিয়ে যাচ্ছে । তোর খবর বল ? অপরাজেয় নিয়ে কি ভাবলি ?
নিজাম এবার বেশ সিরিয়াস একটা টোন টেনে বলে উঠলো ,
—– সে জন্যই তো আমাকে ফোন করতে হলো । কিছু নতুন প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলাম । সময় আছে শোনার ।
সন্দীপন নিজামের ওই কায়দা করা ভঙ্গিমায় হেসে ফেললো এবার । শান্ত গলায় বললো ,
—– বলো সোনা । ক্যায়া হুকুম হ্যায় মেরে আকা ?
নিজাম এবার সত্যিই বেশ সিরিয়াস হয়ে উত্তর দিলো ,
—— অনেক ইয়ার্কি হয়েছে । এবার মন দিয়ে শোনো । আমাদের পত্রিকা থেকে উঠে আসা শ্রেষ্ঠ তরুণদের বই বের করলে কেমন হয় ।
নিজামের কথা শেষ হতে না হতে এপাস থেকে উত্তর গেল ,
—— উত্তম প্রস্তাব । তবে অপরাজেয় একা করবে না । বই প্রকাশিত হবে কোন প্রকাশনীর সাথে যৌথ ভাবে ।
নিজাম সন্দীপনের কথায় আপত্তি করলো না কারন সে জানতো যে প্রকাশক হিসাবে তারা রেজিস্টার্ড নয় ।
—— বেশ এ বিষয়ে তুমি দায়িত্ব নাও । কার বই করবে সে সিদ্ধান্ত তোমার হাতেই দিলাম ।
সন্দীপন , নিজামকে অভয় দিয়ে বললো ,
—– তুই নিশ্চিন্তে থাক ।

এই বলে সে ফোন কেটে দিয়ে নিজের বিছানায় গা এলিয়ে দিলো আবার ।

( চলবে )

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।