• Uncategorized
  • 0

কন্ঠস্বর চয়ন মুখার্জি (পর্ব – ৩)

।। পর্ব তিন ।।

সাম্প্রতিক কিছু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে বাঙ্গালায় যে উৎসবটি ঘিরে বিতর্ক দানা বেঁধেছে, তা হলো “রামনবমী”!
এক পক্ষের দাবী, রাম আদৌ বাঙ্গালায় সেরকমভাবে পূজিত হোন না এবং রাম প্রকৃতপক্ষে উচ্চবর্ণের দেবতা, অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা নেই। অপর পক্ষ, এই যুক্তি কাটতে তৎপর। আজকে এই দাবীগুলো একটু খতিয়ে দেখা যাক।
বাংলায় এখনো অব্দি সবচেয়ে প্রাচীন যে রামায়ণের সন্ধান পাওয়া গেছে, তিনি সম্রাট দেবপালের সভাকবি ছিলেন, তার নাম অভিনন্দ, রচিত কাব্যের নাম ” রামচরিত”। সোঢঢলের রচিত “উদয়সুন্দরীকথা ” নামক গ্রন্থে এই কবির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়।তার কাব্যে তিনি একই সঙ্গে অযোধ্যার শ্রীরাম এবং সম্রাট বিরুদ তথা ধর্মপাল ও যুবরাজ হারবর্ষ তথা দেবপালের প্রশস্তি রচনা করেছেন।তার রচিত রামায়ণের আর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, তাতে হনুমানের মুখে দেবীমাহাত্ম্য কীর্তনের উপস্থিতি, যা অভূতপূর্ব। অর্থাৎ সেই পালযুগেও বাঙালি রামকে নিজের মনের মতো করে গড়ে আপন করে নিয়েছিল।
পাল যুগেই আর একটি সুবিখ্যাত “রামচরিত” নামক কাব্য রচিত হয়, যার কবি ছিলেন সন্ধ্যাকর নন্দী। পিতার নাম প্রজাপতি নন্দী যিনি ছিলেন পাল সম্রাট রামপালের সান্ধ্যবিগ্রহিক, পিতামহের নাম পিনাক নন্দী এবং জন্মভূমি বরেন্দ্রভূমির অন্তর্গত পুন্ড্রবর্ধনপুর। এই কাব্যে মাত্র ২২০ টি শ্লোকে কবি একদিকে সম্রাট রামপালের কীর্তি আবার শ্রীরামচন্দ্রের যশগম গেয়েছেন। কবি নিজেই এজন্য নিজেকে “কলিকাল বাল্মীকি ” বলে উল্লেখ করেছেন।।
এরও পরে সেন বংশীয় সম্রাট লক্ষ্মণসেনের সভাকবি ধোয়ি তার ” পবনদূত” কাব্যেও স্বর্নদী বা ভাগীরথীতীরে রঘুকূলগুরু দেবতার উল্লেখ করে গিয়েছেন। সবশেষে মধ বাঙালির ” কীর্তিবাস কবি” কৃত্তিবাস তার শ্রীরামপাঁচালির মাধ্যমে বাংলার ঘরে ঘরে রামকে পৌঁছে দিয়েছেন।
রামকে নিয়ে এতগুলো কাব্য লেখা হয়েছে যেখানে সেই বাংলাদেশে কি রামপুজো অপ্রচলিত ছিল? থাকা সম্ভব? নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ” বাঙালির ইতিহাস (আদিপর্ব)” গ্রন্থে এর উত্তর দিয়ে গ্যাছেন- ” পাল চন্দ্র পর্বে বাংলা দেশে রামায়ণের কাহিনী সুপ্রচলিত ছিল এবং উচ্চকোটিস্তরে রাম সীতার মূর্তিপুজো প্রচলিত থাকুক বা না থাকুক, অন্তত ইহারা সাধারণ লোকের শ্রদ্ধা এবং পুজো আকর্ষণ করিতেন, সন্দেহ নেই। রঘুপতি রামের পুজো এবং তাঁহার প্রতি শ্রদ্ধা পরবর্তী সেন বর্মন পড়বে বোধ হয় বাড়িয়াই গিয়াছিল , এবং হয়তো রামের মূর্তিপুজোও প্রচলিত হইয়া থাকিবে।….মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের মতো বাংলাদেশেও রাম সীতার পুজো প্রচলিত ছিল” (- বাঙালির ইতিহাস আদি পর্ব, ত্রয়োদশ অধ্যায়, ৭৩৪ পৃষ্ঠা)
রবীন্দ্রনাথ তার বহু লেখায় শ্রীরামকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে গ্যাছেন, তার মধ্যে একটি অংশ উল্লেখ করে শেষ করছি , ” কৃত্তিবাসের রাম ভক্তবৎসল রাম। তিনি অধম পাপী, সকলকেই উদ্ধার করেন। তিনি গুহক চন্ডালকে মিত্র বলিয়া আলিঙ্গন করেন। বনের পশু বানরদিগকে তিনি প্রেমের দ্বারা ধন্য করেন। ভক্ত হনুমানের জীবনকে আর্দ্র করিয়া তাহার জন্ম সার্থক করিয়াছেন। বিভীষণ তাহার পরম ভক্ত। রাবণও শত্রুভাবে তাঁহার কাছ হইতে বিনাশ পাইয়া উদ্ধার হইয়া গেল। এই রামায়নে ভক্তিরই লীলা “(- সাহিত্যসৃষ্টি)
বাস্তব এটাই যে আজ বাঙ্গালা সংস্কৃতির ধ্বজা যে কলকাতানিবাসী তথাকথিত এলিট সম্প্রদায় কুক্ষিগত করে রেখেছেন, বৃহত্তর বাঙ্গালার , জেলার বাঙ্গালীর সাথে তাদের সংযোগ খুবই কম । নাহলে তারা অনেক আগেই জানতেন যে রাঢ় বাঙ্গালায় রাম ঘরে ঘরে পূজিত হোন । তাঁদের কাছে প্রশ্ন যে , ১২০৫ খ্রিস্টাব্দের আগে বাঙ্গালায় কেউ ঈদ পালন করতো না, তাহলে কি তাঁরা ঈদকে অবাঙ্গালী উৎসব বলবেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন,রাম কি শুধুই উচ্চবর্ণের দেবতা? যেখানে বেদপাঠের অপরাধে শূদ্রককে হত্যার কলঙ্ক তাঁর গায়ে লেগে আছে?
বাংলা ১৩১৮ সনে প্রবাসী পত্রিকায় মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা সর্বপ্রথম এ বিষয়ে আলোকপাত করেছিলেন তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধে, প্রবন্ধের নাম ” জাতীয় জীবনে রামায়ণের প্রভাব”। ছোটনাগপুর এবং বিহারের নিম্নবর্ণের সম্প্রদায়ের মধ্যে রাম কতখানি সজীব, তিনি তুলে ধরেছিলেন। সেই প্ৰবন্ধ থেকে কিছু অংশ তুলে দিলাম
” এ যুগের কতিপয় রাজনীতিবিদের কাছে আত্মসমর্পিত বুদ্ধিজীবী রামকে উচ্চশ্রেণীর প্রতিভূ হিসেবে চিহ্নিত করবার চেষ্টা করে সত্য বিকৃত ঘটান, রাজনীতির যূপকাষ্ঠে বিসর্জন দেন সত্যনিষ্ঠা। অন্যদিকে যারা সত্যনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী তাদের ভূষিত করেন সাম্প্রদায়িক অভিধায়, কিন্তু এ যুগের কয়জন উচ্চবর্ণের হিন্দু রামভক্ত? প্রতিদিন সন্ধ্যায় যারা ঢোল কত্তাল নিয়ে রামকীর্তন করেন তারা ত তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দু। তারা খেটে খাওয়া মানুষ, তারা কৃষক শ্রমিক। এমনকি ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে যেসব আদিম জনগোষ্ঠী সভ্য শিক্ষিত সমাজের ছোঁয়া বাঁচিয়ে তারাও তো রামভক্ত। এসব অনেকেরই বিশ্বাস তাদের উৎপত্তি রামায়ণের কোনো না কোনো চরিত্র থেকে। কেওনঝারের বন্য ভূঁইয়ারা হনুমানকে সূর্যদেবতা হিসেবে পুজো করে। সমগ্র ভারতে জনপ্রিয় গ্রাম্য দেবতা হনুমান। পশ্চিমবঙ্গে ভূঁইয়ারা দাবী করে তাদের উৎপত্তি হনুমান থেকেই ..”
এছাড়া আরো কয়েকটি দলিত ও অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের উল্লেখ করছি, যাদের আরাধ্য দেবতা রাম।
মথুরার নিকটস্থ কাছওয়াস ,লোধা , বুন্দেলখণ্ডের শহরিয়া, গোন্দ , সেঞ্জয়ারি ইত্যাদি সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা রামের পুজো করে।
অন্ধ্রপ্রদেশের ( বর্তমান সীমান্ধ্র) কাপুস আদিবাসীরা মনে করেন রাম সর্বজ্ঞানের আধার। কারণ অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেই তিনি সাধারণ মানুষের হিতের জন্য ধনীদের অন্যায় পথে আয় করা সম্পত্তি বিলিয়ে দেন।
কর্ণাল জেলার বালু অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে বাল্মীকি এখনো জীবন্ত। রামকে তারা বলে থাকেন লাল বেল বা নিম্নবর্ণের ঝাড়ুদারদের দেবতা।
উত্তরপ্রদেশের বেহেলিয়া সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা দাবী করে তারা বাল্মীকির বংশধর। তাদের উপাস্য দেবতা রাম।
মহাবীরচরিত ও ভবভূতির উত্তর রামচরিততেও রামকে এমনভাবেই চিত্রিত করা হয়েছে যেন তিনি তাদেরই দেবতা যাদের রয়েছে মাটির সাথে সম্পর্ক। অর্থাৎ রাম মাটির কাছাকাছি যারা বাস করে তাদেরই প্রিয় দেবতা।
দক্ষিণ মির্জাপুরের ভূঁইহার আদিবাসীরা খুবই রামভক্ত। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো , তারা ব্রাহ্মণদের নীচু নজরে দেখে। তাদের মতে ব্রাহ্মণরা ছিল রামের ঢাকী বা বাদক। রাম যখন রাবণ বধের অভিযানে যাত্রা করেছিলেন তখন ব্রাহ্মণরা ঢাক পেটাতে পেটাতে রামের সেনাবাহিনীর জয়গান ঘোষণা করেছিল। সেই ঢাক মাটির তৈরি হওয়ায় সমুদ্রে নামতেই তা গলে যায়, শুধু থাকে গলায় বাঁধা সূত্র যার সাহায্যে ঢাকগুলি তারা ঝুলিয়ে রেখেছিল। সেই সূত্রই এখনকার পৈতে। ( রেফারেন্স – William Crooke, The Tribes and Castes of the North Western India, 1974, page 94)
এবার আমাদের বাংলার প্রসঙ্গে আসি। সুন্দরবনে ওঁরাও আদিবাসীদের ঝুমুর গানে রামায়ণের অনেক বিষয় বস্তু টিকে আছে। যেমন
“কেশালিয়া ধুনি ধুনি কাঁদে
কৌশল্যা রানী-
বলি হাইরে হাইরে হয়,
ভারত নৃপতি কে ভাই।
হারালো অযোধ্যাপুরী
রাম ও চালাও বনবাসে
বলি হায়রে হায়রে হায়।”
(সূত্র – A K Das & M K Raha , The Oraons of Sunderban, 1963, page 14)
পশ্চিমবঙ্গে বলাহাড়ি সম্প্রদায় তাদের আরাধ্য পুরুষ বলরাম হাড়িকে রামচন্দ্রের অবতার “হাড়িরাম”রূপেই পুজো করে। তাদের গানেই রয়েছে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ-
“দিব্যযুগে যিনি হাড়ি
সত্যযুগে বলিহারি
ত্রেতাযুগে দর্পহারী
দ্বাপর যুগে ভৃগুরাম
কলিযুগে সেই হাড়িরাম
প্রকাশ করলেন তার নিজনাম।”
আবার ,
” হাড়িরাম হাড়িরাম
স্বয়ং রামচন্দ্র পূর্নব্রহ্ম সনাতন
সীতাপতি হনুমানকে যেমন করে করিলেন উৎপত্তি
তেমনই নিজগুণে কৃপাদানে
এ অধমের প্রতি করো গতি
তুমি আমার মাতা পিতা তুমি আমার পতি
শ্রী চরণে করি এই মিনতি
জয় হাড়িরামের জয়।।৩।।”
( উৎস – বলাহাড়ি সম্প্রদায়ের গান- সুধীর চক্রবর্তী)
শূদ্রক কে হত্যা করার অংশটি বহু পরে রামায়ণে সংযোজিত হয়েছিল, বিশেষ উদ্দেশ্যে।। যে প্রসঙ্গে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ” স্বদেশী সমাজ” প্রবন্ধে লিখেছিলেন-
“শূদ্র তপস্বীকে তিনি বধদন্ড দিয়াছিলেন এই অপরাধ রামচন্দ্রের উপর আরোপ করিয়া পরবর্তী সমাজরক্ষকের দল রামচরিতের দৃষ্টান্তকে সপক্ষে আনিবার চেষ্টা করিয়াছে। যে সীতাকে রামচন্দ্র সুখে দুঃখে রক্ষা করিয়াছেন ও প্রাণপণে শত্রুহস্ত হইতে উদ্ধার করিয়াছেন, সমাজের প্রতি কর্তব্যের অনুরোধে তাহাকেও তিনি বিনা অপরাধে পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। উত্তরকাণ্ডের এই কাহিনীসৃষ্টির দ্বারা স্পষ্টই বুঝিতে পারা যায় আর্যজাতির বীরশ্রেষ্ঠ আদর্শ চরিত্ররূপে পূজ্য রামচন্দ্রের জীবনীকে একদা সামাজিক আচার রক্ষার অনুকূল করিয়া বর্নণা করিবার বিশেষ চেষ্টা জন্মিয়াছিল।”
কবি স্পষ্টতই বুঝিয়ে দিয়েছেন , সমস্ত উত্তর কান্ডটাই পরে নিজেদের স্বার্থপূরণের জন্য তৎকালীন সমাজবিধাতারা রামায়ণে জুড়ে দিয়েছেন। তাঁর জন্য রামের মহিমা ম্লান হয়না।বাঙ্গালায় রাম যুগে যুগে, সমস্ত শ্রেণীর মানুষের কাছে পূজিত হয়ে আসছেন এবং হবেনও। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রোপাগান্ডা করে সেই ইতিহাস মুছে দেওয়া যাবে না।
Reference:
১/ জাতীয় জীবনে রামায়ণের প্রভাব – নোরঞ্জন গুহঠাকুরতা
২/ The Tribes and Castes of the North Western India – William Crooke
৩/ The Oraons of Sunderban-A K Das & M K Raha
৪/ বলাহাড়ি সম্প্রদায়ের গান – সুধীর চক্রবর্তী
৫/ গভীর নির্জন পথে – সুধীর চক্রবর্তী

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।