গত পাঁচ দিন ধরে ভুলোর বড়ো ছেলেটার শরীর বড়ই অসুস্থ।তেমন কিছু মুখে দিতে চায় না।সতেরো বছরের হৃষ্টপুষ্ট দাপুটে ছেলেটা আজ পাঁচদিনের জ্বরে একেবারে কাবু হয়ে গেছে,রোগা লিকলিকে হয়ে গেছে।পল্লীর কোলে দাপিয়ে বেড়ানো,চরের বুকে ঘুরে বেড়ানো এই ছেলেটা আজ নিস্তেজ।সময়ে সময়ে কাঁপুনি দিয়ে প্রচণ্ড জ্বর,সাথে বমি।দিনের একটা সময় কমে তো আর একটা সময়ে হঠাৎই বেড়ে ওঠে।প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেলে খুব দ্রুতই হয়তো সেরে উঠতে পারতো সে,কিন্তু পল্লীর এই মানুষ গুলোর আত্মবিশ্বাসই তাদের কাছে বড়ো চিকিৎসা পদ্ধতি।হাজার বোঝানোর চেষ্টা করলেও তারা শুনতে চায় না কিছু।কুসংস্কারকে আকড়ে পড়ে থাকে তারা।আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে তাদের অনীহা।যদিও ব্যতিক্রমী চরিত্র মাস্টার আর তার পরিবারের মানুষেরা।হবেই না বা কেন,শিক্ষার কালি যে তার উদরে প্রবেশ করেছে।তাই অন্ধ কুসংস্কার তাদেরকে দমিয়ে ফেলতে পারেনি।অমাবস্যার কালো অন্ধকারকে অতিক্রম করে নিঝুম চাঁদনী রাতের স্নিগ্ধ আলোকে আলোকিত হতে পেরেছে তারা।
এ অঞ্চলের প্রাচীন বৃদ্ধ ভোলানাথ,মাজা পড়ে গেছে,গায়ের চামড়া গেছে গুটিয়ে।টুকটুকে ফরসা,ঠোঁটটাতে যেন রাঙা আলতা পরানো,একেবারে পাকা আমের মত গায়ের রঙ তার।পল্লীর ছোকরার দল হাসি ঠাট্টা করে তাকে ব্রিটিশ বুড়ো বলে ডাকে।বড়োরা বলে কোবরেজ দা।যথেষ্ট বয়স হয়েছে তার,হাতে লাঠি ছাড়া সে এক মুহূর্ত চলতে পারে না।সেইই এই পল্লীর চিকিৎসক হিসেবে দীর্ঘদিন পরিচিত।কোনো পাশ করা ডাক্তার নয়,সামান্য গাছ-গাছড়া দিয়ে জরিবুটি বানিয়ে মানুষের দুর্দিনে সেবা করে আসছে সে দীর্ঘদিন ধরে।গাছের গুণের প্রতি অগাধ বিশ্বাস তার।মাস্টারের ছেলেটা তার আত্মবিশ্বাসে আঘাত হেনে বলেছিল —
এহন আধুনিক যুগ,তোমাগে এই সব ফালতু গাচ-গাচড়ার জিনিসে কাজ হৈব না বুড়া।মাইনষেরে আর কদ্দিন ঠহাবা এই ভাবে।তুমার এই গাচগুলানেই যদি সব রোগ সারবো তা হইলে বড়ো বড়ো ডাক্তার, হাসপাতাল এইসব হইতো না।সরকার কোটি কোটি ট্যাহা খরচ করতো না ওইগুলানের জন্যি।তুমারেই লইয়া যাইতো ডাইক্যা।এহোনো সময় আচে লোক ঠহানো বন্দ করো বুড়া।এহন বিজ্ঞানের যুগ,মানুষ বুঝতে শ্যাকচে।আর যারা এহোনো বোজেনাই খুব সত্তর বুইজা যাইবো।
ভোলানাথ প্রচণ্ড অপমানিত বোধ করে এইটুকু ছেলের কথায়,রেগে গিয়ে বলে —–
যত বড় মুক লয় ততবড় কতা?দু দিনের পুলাপাইন আমারে আইচিস বেজ্ঞান শেহাইতে।ধম্মে সবে না কইয়ে দিলাম,ধম্মে সবে না।দ্যাপতা ওপরতি দেকচিতে তোগে দম্ব।বাপ য্যামনি ছলডাও হইচিস ত্যামনি।কাউরে এক আনা দাম দিবার চাইস না।ফল বালো হইবো না কইয়ে দিতেচি।এই ভুলা কোবরেজের পত্যের ওপরি দু-দশ গ্যারাম আগে চেইয়ে থাইকতো,ভুইলা যাইস না।মাইনষে ঠহায় তা ভুলা কোবরেজের গাচ ঠহায় না।
ভারতীয় প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিতে ভেষজ ঔষধের যে পরিচয় মেলে বর্তমান দিনে তার অবদান অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই সত্যি,তা বলে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি সে যুগের থেকে যে অনেক মোক্ষম দাওয়াই তা বিন্দুমাত্র বলার অপেক্ষা রাখে না।ভেষজ কাঁচামাল দিয়েই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন নিত্য নতুন ঔষধ আবিষ্কৃত হচ্ছে।যত দিন যাচ্ছে ক্রমশ বিজ্ঞানের অগ্ৰগতি ঘটে চলেছে।পরাজিত হয়েছে মিথ্যার ধর্মীয় বিশ্বাস ও অন্ধ অনুভূতি।মানুষের অন্ধ আবেগকে পরাজিত করে হিমাদ্রির শিখরের ন্যায় মাথা উঁচু করেই দাঁড়িয়ে আছে বিজ্ঞান।প্রথম প্রথম অন্ধবিশ্বাসী মানুষ বিজ্ঞানের সাফল্যতাকে স্বীকার করতে না চাইলেও সত্যকে একসময় মেনেই নিয়েছে বাস্তবতার মুখাপেক্ষী হয়ে।
সীমান্ত রক্ষী বাহিনী চাষের জমিতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে,আটকে দিয়েছে রাস্তা,তাই রাস্তায় কোথাও একটুও সময় নষ্ট না করে ভুলো সোজা টান পায়ে বাড়িতে ফিরে আসে।ছেলের শরীর খারাপ বলে তার মন মেজাজ এমনিতেই ভালো নেই, তার উপর একমাত্র রুটি রোজগারের পথও বন্ধ হবার উপক্রম।দিন আনা দিন খাওয়া বললেই চলে,তাই উভয় সঙ্কটে সে।শুধু সেইই নয়,পল্লীর মানুষ গুলোর সকলেরই প্রায় একই অবস্থা।বাড়িতে ফিরে দেখে পাড়ার মহিলাদের সমাগম।ছোট্ট উঠোনে ভর্তি প্রতিবেশীরা।সুলতা অসুস্থ ছেলেটার মাথায় জল পটি দিতে দিতে —–
কাঁন্দিস না জোছনা, কান্দিস না,সব ঠিক হইয়্যা যাইবো,সবুর কর।আমাগে ভুলা বুড়ো আচে না?অত চিন্তা করিস ক্যান।কত কটিন কটিন রোগ তুড়ি মাইর্যা উড়ায় দ্যাচে।এই সামান্যি জ্বর ওর কাচে কিচ্চু না।তোর মরদ ঘরে ফেরচে,দ্যাক দেকিনি কি কয়।
ভোলানাথ এই পাঁচ দিনে সাধ্যমত চেষ্টা করেছে জষ্টিকে সেবা করে সুস্থ করে তোলার জন্য।বিভিন্ন ভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তার ভেষজগুণ সম্পন্ন ঔষধের প্রয়োগ ঘটিয়েছে সে বারবার।এ সম্পর্কে তার যেটুকু অভিজ্ঞতা ছিলো সবটুকু নিংড়ে দিয়ে দেখেছে,কিন্তু কিছুতেই কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারছে না।তবে বুঝতে পেরেছে তার দ্বারা আর কিছু হওয়া সম্ভব নয়।সে হাল ছেড়ে দিয়ে বলে —-
আচ্চা জষ্টির মা,তুমাগো পুলা ভয় টয় পাই নাই তো?আমার কাচে কিচু লুকায়ো না কইলাম।তাতি ফল তো ভালো হইবো না,আকেরে তুমাগো ক্ষেতিই হইবো।
ভোলানাথ নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী,কারণ এ পর্যন্ত প্রতিবার তার মিথ্যা চিকিসায় মানুষ সুস্থ হয়ে গেছে বলে।আজ জষ্টির চিকিৎসা করতে গিয়ে সে কাবু হয়ে পড়েছে।নিজের আত্মবিশ্বাসে ভাঙন ধরেছে তার।মুখে যাই বলুক না কেন,তার প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে বর্তমান চিকিৎসা পদ্ধতি ও বিজ্ঞান যে অনেক এগিয়ে তা স্বীকার করে নিয়েছে মনে প্রাণে।শুধু আত্মসম্মান ও গৌরব ধরে রাখতে পল্লীর এ মানুষগুলোর কাছে সে পরাজিত হতে চায় না। বিজ্ঞের মতই সান্ত্বনা দিয়ে বলে—
মাতাহান ঠান্ডা কইর্যা ভাবো দিন জষ্টির মা,তুমাগো ছল যদি ভয় টয় পাইয়ে থাহে তা হইলে গৌর কাউড়ারে খবর দিতে হইবো, তাবিজ কবচ কইরতে হইব।আমি যদ্দূর বুজতিচি ভাব ভালো মনে হইতেচে না।কোনো প্রেতাত্মা ভর করিচে ওর ওপোরে।
গৌর কাওড়া,অন্ধ বিশ্বাসীদের ভগবান।সমাজকে অন্ধ করে রাখতে তার মত ভণ্ড মানুষদের জুড়ি মেলা ভার।সে নিজেকে ভূত প্রেতের ওস্তাদ বলে পরিচয় দিয়ে থাকে।ভোলানাথের মত ইনিও খুবই বয়স্ক।কপাল জোড়া ভ্রু,মুখটা ডিম্বাকৃতির।পাকানো গোঁফ আর হাত খানেক পাকা দাড়ি।দাড়ির চুলগুলো সকল সময় গার্ডার দিয়ে বেঁধে রাখে।বলে ——
এই চুল আমার দ্যাহের শক্তি,মনের মুক্তি, সহল প্রেতাত্মার যমদূত।এই চুল দিয়াই আমি বশ কইরা থাহি হাজার বচরের দুষ্ট আত্মারে।একাত্তরের আগে যহন ওব্দি এদ্যাশে আসি নাই,তদ্দিন বাংলাদ্যাশের কত্ত বড়ো বড়ো ভূতরে ঠাঙায় সোজা করচি।
ভুলো আগেই ভেবেছিল ভোলানাথ বদ্যির ওষুধে কাজ না হলে গৌর কাউড়াকে ডাকবে।ভোলানাথ হাল ছেড়ে দিয়েছে দেখে ভুলো বলে —-
অঅঅঅ জোচনা,কওনা ক্যান,ছল কি কইতেচিল কয়দিন আগে।সবকিচু খুইলা কও দিন দেহি সগ্গলের কাচে,যদি ছলডা সাইরা ওটে,সহলে মিলা কিচু করতে পারে।
জ্যোৎস্না কান্না থামিয়ে, নিজেকে একটু সামলে নেয়।গ্ৰামের পরিবেশ মানেই একটু অন্য রকম।হিংসা বিদ্বেষ অতটা পরিলক্ষিত হয় না।তবে এসব একেবারে যে নেই তা বলা যাবে না।শহরের ইট কাঠ পাথরের জঞ্জাল এখানে তেমন নেই।নেই ঘিঞ্জি পরিবেশ।পল্লীর এ ঘরগুলো একে অপরের ঘরের খুব কাছাকাছি,একেবারে চালে চাল ঠেকানোর মত অবস্থা।ট্রেন কিংবা ট্রাম লাইনের মত অতটা ঘুর প্যাঁচ নেই এদের সহজ সরল মনের ভিতরে।তবে বলাবাহুল্য, পৃথিবীর সব মানুষ কখনোই একরকম নয়।তবে এ পল্লীর প্রতিটি মানুষ একে অপরের সুখ-দুঃখের সাথী।পাশে থেকে পরস্পর পরস্পরের দিকে আর্থিক, মানসিক সব রকমের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় তারা সময়ে অসময়ে।সামান্য ছোটোখাটো বিষয়ে তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি হাতাহাতি হলেও পরক্ষণেই যেন সব ভুলে এক হয়ে যায় একে অপরের দুর্দিনে।কারো ঘরে চাল না থাকলে অন্যের বাড়ি থেকে কজ্জ নেয়,আবার ঘরে চাল এলেই তা ফিরিয়ে দেয়।
গৌর বুড়ো বাইরে বেরিয়ে এসে —-
হঅঅঅঅ,ক্যাডা,মহানন্দ আইচো নাই?তা কি মনে কইর্যা আইলে নাহি,বিপদ ছাড়া তো আর এই কাউড়ারে কেউ খোঁজও ন্যাই না।
— হঅঅঅ দাদা,বিপদ কি আর কম আইচে,ভুলোর ছলডার এই পাঁচদিন হইলো জ্বর,থ্যাহে থ্যাহে আসে আবার চইলা যায়।কিচুতেই কিচু হইতেচে না।
—– কেন,তোমাগো ভুলানাত,বড়ো কোবরেজ,তা হাইরে গ্যালো নাই?কিচু করতে পারতেচে না?অত সহজ লয় গো মহানন্দ, এই গৌর কাউড়া না হইলে কিচ্চু হবেনানে।
—– চলেন,চলেন,হেই সুমায় গুসা করেন ক্যান, সব কান্নাকাটি পইড়া গ্যাচে ওদিহে।আপনার জন্যি সগ্গলে পত চাইয়ে বসে আচে।
এদিকে গৌর কাউড়া আসার আগেই মাস্টার আর তার ছেলে এসে হাজির ভুলোদের বাড়িতে।মাস্টার আগেই শুনেছে জষ্টির শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে।বর্তমান পরিস্থিতিতে মারন ভাইরাস করোনা সম্পর্কে এ পল্লীর মানুষজন সম্পূর্ণ অজ্ঞ।কোনোপ্রকার সচেতনতা বোধ তাদের মধ্যে নেই।মাস্টার বাজার ঘাটে যায়,বাড়িতে টি.ভি আছে,নিয়মিত খবর দেখে।তাই বর্তমান বিশ্বের উদ্ভূত পরিস্তিতি সম্পর্কে কম বেশি সে জানে।তার পল্লীর মানুষজনকে সচেতন করতে চায় সে।কিন্তু তার সচেতনতা মূলক কথাবার্তা যে অন্ধবিশ্বাসী এই মানুষগুলোর কাছে মিথ্যা প্রতিপন্ন হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।তবুও সে চেষ্টা করতে চায় সবাইকে সচেতন করতে,বিজ্ঞানের ওপর বিশ্বাস জাগাতে।যতই অন্ধবিশ্বাসী হোক এ পল্লীর মানুষজন, তবুও তো এ পল্লী তার।এ পল্লীর মানুষেরা তার বড় আপন।মাস্টারের স্বপ্ন এ পল্লীকে কুসংস্কার মুক্ত করে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসা।বারবার চেষ্টা করে,ব্যর্থ হয় তবুও হাল ছাড়তে সে নারাজ।
চরের মাঠ লাগোয়া সীমান্তবর্তী এই পল্লীর মধ্যে দিয়েই চলে গেছে সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট ও ডিউটিপোস্টগুলি।একত্রিত মানুষের জমায়েত দেখে কর্তব্যরত সেনা জওয়ান এগিয়ে এসে ——-
ইতনা ভীড় কিউ ইধার,ক্যায়া হুয়া?আপনে আপনে ঘর যাও সবলোগ।নিউজ দেখতা নেহি হ্যায় ক্যায়া আপলোগ?দুনিয়ামে করোনা ভাইরাস ইতনা তেজিসে বাড়রাহি হ্যায়,অর সবকুছ শুননেকে বাদ ভি আপলোগ কিউ ইকাঠ্যা হো রাহি হ্যায়?চলো চলো চলো,জাগা খালি ক্যারো।