সাপ্তাহিক ধারাবহ -তে প্রভাত মণ্ডল (পর্ব – ৬)
ইছামতীর সন্তান – ৬
বেঁচে থাকার লড়াই, যোগ্য সম্মানের জন্য লড়াই, কুসংস্কার থেকে মুক্তির জন্য জাতির লড়াই– আবহমান কাল ধরে চলে আসছে।এ তো প্রকৃতিরই নিয়ম,ইতিহাস সাক্ষী।এই পল্লীর মানুষগুলোও আজ মুক্তি চায় রাজনীতির জাতাকল থেকে,বাবুদের চক্রান্ত থেকে।সমাজে বাবুসম্পন্ন প্রভাবশালী বেশিরভাগ লোকেরা বরাবরের জন্য রাজনীতির ছত্র ছায়ায় আশ্রয় গ্ৰহণ করে সাধারণ মানুষের মাথায় চেপে বসে থাকে।জনসাধারণকে কৌশলে আর্থিক দিক থেকে শোষণ করে নিজেদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করে।তবে ইতিহাস ঘেঁটলে দেখা যাবে,এই শোষণের বিরুদ্ধে একসময় শ্রেণিবদ্ধ ভাবে মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে, প্রতিবাদ করেছে যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।এ পল্লীও তার ব্যতিক্রম নয়।পল্লীর এই সহজ সরল অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত মানুষগুলোর বুকে চোরা একটা আগুন জ্বলছে দীর্ঘদিন ধরে।তাদের উপরে হওয়া রাজনৈতিক অত্যাচার তারা অনুভব করতে পারে কম-বেশি।হয়তো ফুটে প্রতিবাদ করতে পারে না,সাহস করে উঠতে পারে না,তবে অন্তরে তুষের আগুন ধিকধিক করে জ্বলতে থাকে তাদের।কখন যে দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে সে আগুন তা শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।ভূ-গর্ভস্থ লাভা ম্যাগমা অগ্নুৎপাত হয়ে বের হবে দীর্ঘদিন ধরে ঘুমিয়ে থাকা জীবন্ত আগ্নেয়গিরির মত।চৈত্রের দাবদাহের শেষে অবিরাম বৃষ্টির ফোঁটা এসে এ পৃথিবীকে ধৌত করে দিয়ে যাবে।কচিপাতা জন্মাবে গাছে গাছে।পল্লীও আলোকিত হবে শিক্ষার আলোয়।গ্ৰামীন জনমানসে প্রতিষ্ঠা পাবে অধিকারবোধ।শ্বেত কপোত-কপোতী ডানা মেলে উড়বে।প্রতিটি মানুষ ফিরে পাবে নিজেদের অধিকার।
দিন আনা দিন খাওয়া এই মানুষগুলোর একটা বড় অংশই এখন ইছামতীর বুকে মাছ ধরে সংসার চালায়।আগে প্রত্যেকেই চরে চাষের জমিতে কাজ করত,শ্রম দিয়ে অর্থ উপার্জন করত।কিন্তু সময় বদলেছে,বুঝতে শিখেছে তারা।বুঝবেই বা না কেন,রাজনীতি তারা না বুঝলেও আত্মসম্মান বোধ তাদের আছে।মাস ছয়েক আগে খগেন, ভুলো,সখারা ঘোষ বাবুদের জমিতে কাজে গেলে,কাজে সামান্য ত্রুটি ঘটেছিল বলে মেজোঘোষ শ্যামেশ্বরের কটাক্ষ —–
টাকা কি মাগনাই আসে নাকি?ছোটোলোকের বাচ্চারা।
দুপুরের ঝাঁঝালো রোদে হাড়ভাঙা খাটুনির মাঝে এমন কথা শুনে ভুলোর মেজাজ যায় বিগরে।সেও এক মুহূর্ত দেরি না করে —-
দ্যাহেন বাবু,ছোডোলোক কইবেন না,আপনাগে খ্যাতে কাজ কইর্যা খায়,গতর ঘামায় ট্যাহা এনকাম করি।
কথা শেষ না হতেই শ্যামেশ্বর সটান থাপ্পড় দেয় ভুলোর মুখে।শুধু থাপ্পড় দিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি, মনের রাগ মেটাতে পারেননি।চড়,থাবা,ঘুষি দিতে দিতে —-
এত বড়ো সাহস তোর,আমার মুখের ওপরে কথা বলিস,চিনিস আমি কিডা?বড্ড সাহস হয়ে গেছে তোদের।বহুত দিন গায় হাত তুলিনি বলে যা মনে করিছিস তাই?
ভুলো চুপচাপ মার খেয়ে চলে আসে।শরীরের শক্তিও কম আবার অর্থবলও কম,কাজেই চুপচাপ চলে আসা ছাড়া কোনো গতি নেই।সেদিনের প্রহার এতটাই তীব্র ছিলো যে দুদিন আর কাজে যেতে পারেনি সে।এ তল্লাটে শুধু এই পল্লীর মানুষ গুলোই নয়,অন্য ঘোষ,কাপালি, হালদার, পন্ডক্ষৈত্র, নমঃশূদ্র প্রতিটি সম্প্রদায়ের বহু মানুষই শুধুমাত্র এই একটি ঘোষ পরিবারের অত্যাচারের শিকার।সে রাজনীতি হোক,অর্থনীতি হোক কিংবা মানসিক।এ অঞ্চলে আর এক প্রভাব সম্পন্ন ঘোষ পরিবার সুবিৎ ঘোষের।এদের পৈত্রিক সম্পত্তি শত বিঘার কাছে।তবে এরা খুবই ভদ্র,শান্তশিষ্ট প্রকৃতির মানুষ।সুবিৎ ঘোষের চাষের জমিতেও পল্লীর অনেকেই কাজ করে, নারী-পুরুষ সকলেই।কিন্তু সুবিৎ ঘোষের বিরুদ্ধে পল্লীর এই মানুষগুলোর কোনো অভিযোগ নেই।বরং মালিকের কষ্টে তারা সমব্যথী, মলিকও এদের কষ্টে।শান্তশিষ্ট ও ভদ্র প্রকৃতির এই মানুষটি অন্যায় দেখলে চুপ করে থাকতে পারেন না।রামেশ্বর ঘোষদের অত্যাচারের কথা বলতে গিয়ে বলে—-
আর কতদিন,ভরা বর্ষা এলে শুকনো মরা গাছেও জীবন আসে।তাই একদিন এই বোবা মুখ গুলোতেও কথা ফুটবে,সেদিন অর্থের দম্ভ আর ক্ষমতার জোর ধূলোতে মিশে যাবে।
গরীবের সংসার,ছেলে-মেয়ের মুখে কিভাবে অন্ন জোগাবে তাই নিয়ে জ্যোৎস্নার মাথায় গভীর চিন্তা।ঘরে চাল নেই, হাতে টাকাও নেই,শ্যামেশ্বরের হাতে মার খেয়ে শরীরে আঘাত পেয়ে দুদিন ঘরেই ছিলো ভুলো।তিন দিনের দিন জ্যোৎস্না সুলতার কাছে ছুটে যায় —-
অ অ অ দিদি,কয়ডা চাইল কজ্জ দিবা?আমাগে না হয় খাওয়া না হইলো,বাচলাম মরলাম কিচু আসে যায় না।ছলগুলানরে তো আর না খাওয়ায়ে রাকতি পারি নে।
বলে কেঁদে পড়ল সুলতার সামনে।সুলতা —-
আরে কান্দিস ক্যান,কি হইচে,সব খুইলা কইয়ে ফ্যাল দিকিনি।কান্দলি কি আর প্যাটে ভাত যাইবো!কিচু তো করতে হইবো।আর যদ্দিন এই সুলতা বাইচা আচে কতা দিলাম আমাগে পোলা-পানগো না খাইয়ে থাকতি হইবো না,বুজচিস?
—– হ অ অ দিদি,বুইজা আর কি করুম কউ দিন দেহি।আমাগে উনি বাবুগে কাজে যাইচেলো দুদিন আগে,কি নে কি হৈচে আর ম্যাজোবাবু এমনি মার মারচে যে দুইদিন ধইর্যা মুক,কপাল সব ফুইল্যা ছ্যালো।দুই দিন হইলো কাজে যাই নাই।আইজক্যা এট্টু উটলো।আমি আর কাজে যাতি দেয় নাই।কইলাম ওগে কাজে আর যাওনের দরকার নাই।
—– হ অ অ অ ঠিক কইচিস।হেইবারে হালদারগো ছল আনন্দরে মারচেলো ওমনি।মাতাহান ফাইটা দেচেলো, ফিনকি দে অক্ত গড়াইতেচেলো।কি ভাবচে বিডারা,ট্যাহা আচে বইলা কি যহন তহন আমাগো গায় হাত দিবো আর আমরা চুপ কইর্যা থাইকবো?অনেক হইচে,আর না।তা চল দেহি বাড়ি,ভুলোডারে দ্যাহে আসি।
—- বাড়ি নাই দিদি,কইলো আজ থেইক্যা মাচ ধইরবে,খগেনও আইচেলো,একসাতে জাল লইয়া গেলো।
—— তা গাঙে যাইচে মাচ ধরতে,পুলিশরে কইয়ে গ্যাচে?
—- হ অ অ দিদি,খগেন কইলো পুলিশরে কইয়্যা যাইবো।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত,সর্বক্ষণ প্রহরীর বেড়াজাল নদীর তীর দিয়ে।এখানে নদীতে মাছ ধরতে নামার আগে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাছে নির্দেশ নিয়ে, তাদের খাতায় নাম তুলে তবেই যেতে হয়।না হলে নিয়ম লঙ্ঘন করলে যখন তখন শাস্তি হতে পারে।
ভুলো শ্যামেশ্বরদের জমিতে মজুরির কাজ বন্ধ করে দেয়।ভুলোর সাথে খগেন আর সখাও।আজ কয়েকটা মাস কেটে গেছে,এখন ভুলো,খগেন, সখা একসাথে মাছ ধরে ইছামতীর বুকে।নিয়ম মেনে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নির্দেশ নিয়েই নদীতে নামে।খুব ভোর হতেই মাছ ধরে নিয়ে আসে,সোজা চলে যায় বনগাঁ মাছ বাজারে।আবার বিকেলে ধরা মাছগুলো কখনো সখনো বনগাঁ নিয়ে যায়,আর তা না হলে গ্ৰামের হাটেই বিক্রি করে।টাকা পয়সা সবদিন সমান হয় না।তবে পুষিয়ে যায়।যা উপার্জন হয় তিন জন ভাগে মিলে নিয়ে নেয়।একজন কোনো কারণে কাজে যেতে না পারলে সেও সমান ভাগ পায়।স্বার্থান্বেষী মনোভাব পল্লীর এই মানুষগুলোকে এখনে সম্পূর্ণ ভাবে গ্ৰাস করতে পারেনি।ভুলো বলে —-
জানস খগেন দা,এই গাঙ হইতেচে আমাগো মা,এই ইচামতীই আমাগো মা।এদ্দিন হইলো আর বাবুগে ঝ্যাটা লাতি সইতি হয় না।গতরে কুলাইলে যাইলাম,না কুলাইলে বইসা থাইকলাম।
—- হঅঅ রে ভুলো এই ইচামতীই আমাগে মা।আজ কোলে কাচে আচে বইলা দুইডা মাচ ধইর্যা সংসার চালাই।আর হঅঅ ভুলো,দিন সহলের আইবো,দেহিস।এহন বাবুগে ক্ষ্যামতা আচে দেহায়তেচে।উপরি দেপতা আচে,সব দেকতিচে,আর কদ্দিন।
আমরা সহ্যি করলিও দেপতারে কেউ ফাঁকি দ্যাতে পারবোনানে।
গ্ৰাম্য পরিবেশে পাখিদের ডাক,দিনান্তে তাদের ঘরে ফেরা– এ যেন এক অন্য রকম অনুভূতি।এই গ্ৰাম্য পরিবেশে কল-কারখানা তেমন নেই, নেই রুটি রুজির জোগান।তাই শিক্ষিত ছেলে-মেয়েগুলোকে বাধ্য হয়ে বাইরে ছুটতে হয় কাজের জন্য।এখন দিন পরিবর্তনের সাথে সাথে বিশ্ব রাজনীতি পাল্টেছে, সভ্যতার অগ্ৰগতি ঘটেছে,মানুষের জীবন ধারার পরিবর্তনও ঘটেছে।গ্ৰামীন জীবনে তেমন পরিবর্তন না আসলেও শহুরে সভ্যতার অগ্ৰগতির সংস্পর্শে এসে গ্ৰামীন সভ্যতাও ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছে।সরকারের প্রচেষ্টায় এখন গ্ৰামে গ্ৰামে বিদ্যুৎ,রান্নার গ্যাসের জোগান এসব গ্ৰামীন জীবনে অন্য স্বাদ এনে দিয়েছে।অপেক্ষা শুধু শিক্ষার আলো আসতে।রান্নার গ্যাসের জোগান দেওয়ার জন্য গোডাউন খোলা হয়েছে বিভিন্ন গ্ৰামাঞ্চলে।পল্লীর পাশ্ববর্তী অঞ্চলেও গড়ে উঠেছে এমনই এক গ্যাস গোডাউন।ডিলারশিপ পেয়েছেন এ অঞ্চলেরই এক রাঘববোয়াল, বিশু হালদার।ঘোষ বাবুদের খুবই ঘনিষ্ঠ এই ব্যক্তিও অবৈধ অর্থের জোরে ডিলারশিপ আদায় করে নিয়েছে সে।এমনিতে ঘোষ বাবুদের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক হলে কি হবে,পাওনা গন্ডার দিক থেকে নিজে কিঞ্চিৎ বঞ্চিত হলে কেউটে সাপের মতো ফনা তুলে ওঠে।হালদারের স্বভাব ঘোষবাবুরা ভালো মতই জানে,তাই তাকে চটিয়ে তুলতে সাহস করে না।