• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবহ শ্রী সুতনু হালদার বিরচিত (পর্ব – ৪)

আলাপন

(আত্মজৈবনিক কাব্যোপাখ্যান)

(১৬)
সময় একটা বিষম বস্তু, জাহাজের মাস্তুলের মতো মানব জীবনে এর লেনদেন। প্রত্যেকদিন সকালে আমার পড়ার টেবিলে যখন আমি অনুপস্থিত ঠিক সেই সময়েই একটা টিয়া পাখি টেবিলটা সরজমিনে পরিভ্রমণ করে; আমি ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই সে সতর্কভাবে টেবিলের একটি কোণ ব্যতিরেকে পুরো আধিপত্য নির্দ্বিধায় ছেড়ে দেয়। বর্তমানে এটাই রেওয়াজ। টিয়াটির স্বআরোপিত রেওয়াজে আমি এখনও নিমিত্তমাত্র।
তবে টিয়াটি কখনোই পোষ মানবে না, চেষ্টা করতে করতে এক সময় আমি নিজেই বুঝে গেছি যে, পোষ মানার জন্য ওর জন্ম হয়নি! শুধু টেবিলটাতে ক্ষণিকের আধিপত্যবিস্তার করার জন্যই ওর এইঘরে আসা-যাওয়া। সন্ধ্যার সময় এটা হয় না…
সেই সময়ের আকাশ কখনও জ্যোৎস্নাকে আলিঙ্গন করে কিংবা অন্ধকারকে, চাঁদের আয়োজন এক্ষেত্রে নৈব্যক্তিক ধরে নিতে হবে। ওই সময় চাঁদ আর সকালে আমার ভূমিকা অনেকটা মিলে গেলেও মিশে যায় না কখনোই। এটার ব্যাখ্যাও শুধুমাত্র সময়ই জানে…
(১৭)
নিজস্ব নিঃসঙ্গতাগুলো বৃষ্টিমুখী; ওরা দারুণ আধিপত্যবাদে বিশ্বাসী। মেঘের বিশ্বাস যেমন বৃষ্টিতে নিমজ্জিত হতে কুন্ঠিত হয় না, তেমনই আধিপত্যও আগ্রাসন পছন্দ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না…
যেকোনো পছন্দের মধ্যে একটা ত্রিকোণ রিলেশনশিপ থাকে, আমাদের পাড়ার গোকুলচাঁদ মন্দিরের নাটবারান্দাটা ছোটোবেলায় আমার তেমন একটা পছন্দের স্থান ছিল, নাটবারান্দার চারদিকে বিভিন্ন মন্দিরে ঘেরা থাকত, মাঝখান দিয়ে ছিল লোকচলাচলের জন্য বিস্তৃত পথ; আমরা খেলতে খেলতে ওই পথ টপকিয়ে নাটবারান্দার থেকে অন্য মন্দিরে লাফাতাম, সেইসময় লাফাতে আমি খুব ভয় পেতাম…
একদিন তার থেকেও অনেক বড় বড় পথ নির্ভীকভাবে টপকিয়ে অনায়াসেই নদীর স্রোতে মিশে যেতে শিখে গেলুম, স্রোতের নিঃসঙ্গতাগুলো আগের মতো তখনও নদীতে পা দুলিয়ে দুলিয়েই খেলা করত। আমিও যেন ধীরে ধীরে ছোটোবেলার সেই মরচে খসিয়ে কুয়াশার পলেস্তারা সরাতে সরাতে জ্যোৎস্নার নরম পিঠে হাত বোলাতে লাগলাম! কী অনির্বচনীয় সেই তৃপ্তি…
সেই প্রথম, ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে তোমাকে চুম্বন করতে ইচ্ছা করল না। উল্টে নদীর ছলাৎছলাৎ শব্দে তোমার এগিয়ে যাওয়া দেখতেই ভালো লাগল। আকাশ তখন রীতিমতো মেঘলা, বৃষ্টি আসবে; বৃষ্টিকণাদের অধিকারবোধ চিরদিনই খুব তীক্ষ্ণ…
(১৮)
রুক্ষতার মধ্যেও একটা নমনীয়তা থাকে। বেশ কয়েকদিন গৃহবন্দী থাকতে থাকতে আমি সহসা এই সত্যটা অনুধাবন করলাম। হালকা আমেজ ধরতেই ব্লেন্ডার্স প্রাইডে ঘন কুয়াশা যেন নিজের কুমারীত্বের দেমাকি চাল দিতে তৎপর!
অচিরেই ফুটিফাটা দেমাক আজ সর্বত্র করোনা সন্ত্রস্ত ; গাছের পাতাগুলোর যে বিচ্ছেদ হয় তা বসন্ত জনিত, আর আমরা গভীর শীতলতার নামাবলি গায়ে চাপিয়ে বিচ্ছিন্ন…
নিশ্বাসের নিটোল উপবাসে সার্জিকাল মাস্ক আকাশ গড়ে তোলে, পথের ধারে ধারে স্মৃতিরা ওৎ পেতে বসে থাকতে থাকতে কোনো এক অবসরে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলে! কে বলে স্মৃতিরা কেবলই নির্বান্ধব? কেবলই ছবি? একশো পঁচিশ ন্যানোমিটারের আণুবীক্ষণিক শপথ রাস্তা পারাবারে যখন প্রচণ্ড রকম ব্যস্ত ঠিক তখন ধুলোঝড়ে মনটা কেমন যেন আঁতকে ওঠে! ভীড় জমায় আমাদের ফেলে আসা স্মৃতির তুষারবিন্দু…
কতদিন আর যাওয়া হয় না বগা দার চায়ের দোকানে! আতশ কাচের সোচ্চার বাৎসল্য পুরোটাই আইসোলেশনে রোদ্দুর পোয়াচ্ছে; ভবিতব্য সেখানে মেঠোপথ আর রাজপথের দাড়িপাল্লাকে সমান করে দিয়েছে! এরথেকে বড় সাম্য এই পৃথিবী আগে কখনোই দ্যাখেনি…
এখন দিন আর রাতের মূলত পার্থক্য শুধুমাত্র গা জোয়ারি উপকথা ভিত্তিক একটা বিষাদ মাত্র। নিপুণ জ্যোৎস্নার গর্ভাশয় সাবলীলতায় লকডাউন। কখনও কখনও মমত্ব মিশিয়ে রাবীন্দ্রিক সুর মূর্ছনা ভেসে ওঠে -‘আমি ভিক্ষা করে ফিরতেছিলেম গ্রামের পথে পথে…’। সেই পথই রুক্ষতাতে পরম আদরে নমনীয়তা মিশিয়ে দ্যায়; প্রতিটা কণ্ঠে যে আকাশসীমা থাকে সেখানে স্মৃতিমেদুর আবছা আলো-আঁধারি বারবার যেন হাতছানি দ্যায়…
(১৯)
লকডাউনের প্রতিটা মুহূর্ত তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করত, কথা যেটুকু বলতাম তাতে মুঠোফোন হাঁপিয়ে যেন হাঁপর কাটত; অথচ রাতের জ্যোৎস্নাগুলো আমাকে ব্যাঙ্গমাব্যাঙ্গমীর গল্প শোনাত! প্রতিটা রাত এখন নদীর হয়ে আমাকে সঙ্গ দ্যায়, স্রোতে ভাসায়, জোয়ারভাটা দ্যাখায়; আমাকে কখনো নিজের স্রোতে মিশে যেতে বলে না, উল্টে আমাকে পলি ভেবে নিয়ে নিজের ইচ্ছাতেই আমাকে নিয়ে বয়ে চলে! এই রাতের সঙ্গে তোমার কত মিল! এখানেই আমরা একীভূত হয়ে গান শুনেছি কতবার, এস্রাজে আমরা পূরবী, ভৈরবী ফুটিয়ে তুলতে তুলতে একসময় নিতান্তই বেখেয়ালে যেন অন্তরায় পৌঁছে গিয়েছিলাম…
হিমালয়ে এখন অনেক বেশি বরফ জমে, প্রকৃতি এই কয়েকদিনেই অনেক বেশি যৌবনা হয়েছে; তোমার প্রিয় পশুরা এখন আর রাস্তা পারাপার করতে ভয় পাচ্ছে না। ওরা সবাই এখন খুব কাছাকাছি! একদিন তুমি আর আমিও তো এমনই ছিলাম। আজ ওরা আমাদের সেই পথেই শিশিরের প্রলেপ দিচ্ছে! রাজার বদল হলেও পথের ভাগ্য চিরকালীন প্রজাস্বত্ব থেকে বঞ্চিত হতে শেখেনি।
যা কিছু শেখার প্রকৃতি তা সর্বদা পুরুষকেই শেখাতে পছন্দ করে। অন্য কেউ সেই ভাগের অংশীদার হতে পারে না;
তোমার মুখ জ্যোৎস্নালোকিত হয়ে চোখের তারায় উষ্ণ মদিরা পানের আকুতি জানাত, সেই আকুতি অনেকদিন পর আজকে আবার ভিডিও কলে দেখলাম! ক্ষুধার্ত পাকস্থলি ভর্তি করে আমি যখন খেয়ে নিতাম এক আকাশ জ্যোৎস্না; পুরোটা দেখেও তুমি আমাকে কক্ষনও কিচ্ছুটি বলতে না! আশ্চর্য! তখন জানার চেষ্টাও করিনি ওসব তোমার পছন্দের ছিল কী অপছন্দের? এখন বুঝি, মুখে বলার থেকে হাতে ধরে বুঝিয়ে দেওয়াটাই তোমার বেশি পছন্দের…
ভোরের নতুন আলোয় অনেকদিন পরে আজ আবার তোমাকে দেখলাম। আগেও এমন তো কতই দেখেছি! পরস্ত্রীর মতো নিবিড় এক আকর্ষণে ছুটে গেছি তোমার কাছে, তুমি পরম আদরে কাছে টেনে নিতে।
প্রাথমিকভাবে আজ অবশ্য তেমন কিছুই করলে না! নদীর স্বচ্ছতায় তোমার মধ্যে নিজেকেই বারবার দেখতে পাচ্ছিলাম। ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা করতেই তখন তুমি ব্যস্ত! বেশ কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ আমাকে আলিঙ্গন করে নিজেই ঢেউ হয়ে ঝাপিয়ে পড়লে আমার বুকে, একান্ত গোপনে যেভাবে নারীরা প্রকৃতি হয়ে ওঠে…
(২০)
শুনশান রাস্তাঘাট, কয়েকটা কুকুর আমার বাড়ির দরজার সামনে বসে আছে, আমি প্রতিদিন এইসময় ওখানে ওদের কিছু খাবার দিই; ওরাও আসে, নিয়ম করেই আসে।
নিয়মের কথাতেই মনে পড়ল, প্রতিটা জিনিসই এখনও পূর্ববৎ নিয়মেই গতিশীল। আমি শুধু বহুবচনে ঘরের অন্তরালকে নিরাপদ ঠাউরেছি। নিজেকে নিজেই দেশপ্রেমিক ভেবে বেশ বাহবা দিচ্ছি!
খাবার দেবার সময় কুকুরগুলো আজকাল আমার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, আর আমি ওদের সেই সুযোগে অনেকক্ষণ ধরে প্রাণভরে দেখি, একসময় আমাদের আদানপ্রদান শেষ হয়; কুকুরগুলো চলে যায়, এখন ওদের বদলে আমাদের ল্যাজটাই বড়ো যত্নে গোটানো থাকে…
ল্যাজের মাহাত্ম্য আর কে না জানে, এই ল্যাজ দিয়েই হনুমান রাবণের সাধের সোনার লঙ্কা পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিয়েছিল, সেই ল্যাজকে যদি একটু আদরযত্নে লুকিয়েই না রাখা হয় তো বিড়ম্বনার শেষ থাকবে না। একথা এখন অক্ষরে অক্ষরে বুঝে ওনারা বুঝিয়ে দিয়েছেন। কোনো কার্পণ্য নেই।
তবে ওই যে বসন্তের দাঁড়িপাল্লার শেষাশেষি কিছুটা ভবঘুরে রোদ্দুর আমাদের ল্যাজের ওপর আগুন হয়ে পড়ছে, তাতেও তো ল্যাজটা পুড়ছে! ঠিক তখনই কেউ কেউ মানবজমিন জরিপ করা শুরু করে দ্যায়, জোনাকিপোকার অনুগামীত্বে ভরপুর হয়ে ওঠে ভয়!
দুপুরবেলাগুলো এখন আর শান্ত থাকেনা, দামাল হয়ে ওঠে! আর কয়েকদিন পরেই তো শিবের গাজন, দেখতে দেখতেই চলে আসবে চড়ক, সেই বনবন করে ঘূর্ণনের সামনে ঠিকমতো ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি খুঁজে চলে আমাদের অন্তর্গত রক্তকণিকারা…

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।