সাপ্তাহিক ধারাবহ শ্রী সুতনু হালদার বিরচিত (অন্তিম পর্ব)
আলাপন
(৪২)
আজকের দিনটা অন্যরকম ছিল। যে সমস্ত দিন তার নিজের গায়ে সর্বদায় কোনও না কোনও স্বপ্ন লাগিয়ে রাখে, তাদের মধ্যে একটা চূড়ান্ত বোঝাপড়া থাকে। এই ধরনের দিনে কাকের কর্কশ ডাকে ঘুম ভেঙে যায়। বুকের মধ্যে হেঁটে চলে বাস্তুসাপ।
আকাশের গায়ে ফুটে ওঠে চিরকালীন সেই গুঁটি বসন্তের দাগ; জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তির ভরন্ত রোদে ইলশেগুঁড়ি, আমরা আশৈশব সবাই জেনে এসেছি, বৃষ্টিরা কখনও নির্বান্ধব হয় না। কথাটা মিথ্যা নয়। বৃষ্টিরা নির্বান্ধব নয় বলেই ওদের আত্মহত্যার প্রবণতা হয়ত কম হয়।
আজ যখন বৃষ্টি এলো, আমি তখন বাড়ি থেকে অনেক দূরে পুঁচকে এক গ্রামে। সোঁদা মাটির গন্ধে ভরপুর ছোট্ট এক কুটিরের আলো আঁধারি দরজাগুলো এইসময় মানুষের মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হয়ে ওঠে। আবার এই সময়টাতেই শোনা যায় এক নির্বান্ধব পান্ডুলিপির প্রাগৈতিহাসিক নিশ্বাসের প্রতিধ্বনি!
কারোর সঙ্গে কখনও কি সময়ের কোনও বন্ধুত্ব হয়েছে? আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে যে সময়, তাকে আমি দেখতে পাই, সে আমার চোখে সামনে অবলীলায় ঘাসের ওপর নিজেকে স্থাপন করতে পারে। তখন দুপুর পৌনে একটা। মোবাইলের স্ক্রিন জুড়ে ফুটে উঠল একটা ছবিসহ নাম,পরপর দু’বার। তারপর নিশ্চুপ। সন্ধেই আবার…
মাঝের সময়টা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গ্রামের আলপথ ধরে অনেকটা হাঁটলাম। একটা সময় পথ ফুরিয়ে গেল। সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই, সব কথা এখন উচ্ছলিত তারাদের মাঝে দুর্বার, পদাতিক। সময় এগিয়ে চলে গভীর রাতের ঐশ্বর্য ভরা এক বাউল সুরের মাদকতার টানে। বাতাসের উথালপাতাল স্রোতে রূপকথার মতো মোবাইলের স্ক্রিন জুড়ে অসম্পূর্ণ এক মেঘমল্লার…
ফেরার পথে আমার সঙ্গ দিয়েছিল অজস্র মেঘ। লোকলয় যখন দূরে ছিল তখন তেমন বুঝিনি, কিন্তু যত কাছে এলো ততই রাস্তায় কুকুরের ডাক তীব্র হয়ে উঠল। উন্মুক্ত শ্মশানটা আজ পরিত্যক্ত, সামনেই ওর দোসর। অথচ একদিন ওরই ছিল ভরা রাজকোষ!
পাশ দিয়ে একমনে বয়ে চলেছে গঙ্গা। অসমাপ্ত কবিতার শেষ পঙক্তির কান্নাকে সম্বল করে গঙ্গার বুকে ঠাঁই পাওয়া মৎস্যকন্যার ভারী স্তনদ্বয় ঢেকে দেবার সময় অনামী এক ঢেউ যেন আমাকে শুনিয়েই ওই মৎসকন্যাকে বলে উঠল, ‘শুধুমাত্র স্বপ্ন বা বাস্তবেই নয়, প্রতিটা অস্তিত্বেই নিত্য বসতি স্থাপন করে চলেছে এক অতলস্পর্শ বিরহ। প্রতিনিয়ত আমরা যার সঙ্গে স্বজ্ঞানে কিংবা অবচেতনে মিলিত হবার কথা ভাবছি সে যেন ক্রমশই অন্য এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের কণ্ঠ আলিঙ্গন করে বসে আছে। কল্পনা সেখানে রাজপুত্র বা রাজকন্যা হয়ে ধরা দিলেও দিতে পারে কিন্তু বাস্তব সেখানে অলীক হতে বাধ্য, তার ভূমিকা শুধুমাত্র আজ্ঞাবহ দাসানুদাস ভিন্ন অন্য কিছু নয়। সেই রূপকথার জগতে কে-ই বা আমি, কে-ই বা তুমি? আমরা পরস্পরের পরিপূরকমাত্র। এই দেহভাণ্ড জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধি-শোক-তাপ-বিরহ-মিলনের এক অনবদ্য আধার। মন তার গোপন তন্ত্রে গড়ে তোলে শত-সহস্র অবিনশ্বর পাখির নীড়। তারা বলে এসো হাত ধরো। বিরহের মাঝে ওই যে আকাশ দেখছ সেখানেই জীবন; সেখানেই যাপনের সমস্ত সুখ লুকিয়ে। এই বিরহ আত্মহত্যার জন্য প্রস্তুত নয়, এই বিরহের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে বেঁচে থাকার আদিগন্ত রসদ।’
ভৌগলিক নিয়মেই পথ আমার বাসস্থানের দরজার সামনে আমাকে পৌঁছে দ্যায়। আমিও দরজা হয়ে উঠি…
(৪৩)
আলাপটা হয়েছিল কোনও এক আদরহীন মেঘদিঘিতে। সেদিন থেকেই আমার মধ্যে বসত গেড়েছল এক সহজিয়া সাধক। ভেঙে যাওয়া চাঁদের আলোয় আমি তাকে চিনেছিলাম। অনেক সময় মনেহয় এসব যেন গতজন্মের স্বপ্নে পাওয়া এক আশ্চর্য অনুভূতি।
আজকাল রাতে ঘুমতে যেতে যেতে প্রায় ভোর হয়ে যায়, পাখির ডাক শুনতে শুনতে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ি। সকালে আর ওঠা হয় না! যেদিন রাতে একদমই ঘুম আসে না, সেইসময় ফিরে আসেন ওই সহজিয়া সাধক। আমি চিলেকোঠার ধারে দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে গল্প জুড়ি। সামনের মেহগনি গাছটা আমাদের পাহারা দ্যায়। গাছেরা চিরকাল অতন্দ্র প্রহরী হয়। একটা মরমী বাতাস পরম মমতায় আমাকে আচ্ছাদিত করে রাখে। আমার সামনে নিষ্পলক দাঁড়িয়ে থাকেন সেই সাধক।
রাত আরো গভীর হলে একটা রিনরিনে শব্দ শুনতে পাই। লোকে বলে ওই শব্দ নাকি রহস্যময়। আমি জেগে থাকি। সামনের কোনও গাছে শব্দটা মিলিয়ে যায়, কিছুক্ষণ বাদে আবার জেগে ওঠে। এইসময় গাছেরা আমার বন্ধু হয়ে ওঠে। তারা বলে দ্যায়, ‘শব্দটা রহস্যময় নয়।’ শব্দ তো চিরটাকালই অশরীরী হয়েই বেঁচে থাকে।
আমার মনেও প্রশ্ন জাগে, ‘শরীর থাকলেও সব সময় তার বেঁচে থাকা সম্ভব হয়?’- কেউ উত্তর দেয় না। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সহজিয়া সাধকটি মিটিমিটি হাসতে থাকেন। তাঁর এই হাসি আমার চেনা, অথচ এই সময় তাঁর বিরুদ্ধে আমি কোনও যুক্তি খাঁড়া করতে পারি না! সেই সাধক হাসিতেই নিজের উত্তর আমার কাছে পৌঁছে দিতে চান। এই দেহকেই তিনি ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড জ্ঞানে সাধনা করতে বিশ্বাসী। তাঁর মতে সাধনার লক্ষ্যবস্তুকে দেহের ভেতরেই তিনি অনুভব করেন,দেহের বাইরে নয়। জ্ঞানস্বরূপ সেই লক্ষ্য, একদিকে অবিচল, অন্যদিকে স্থির। একমাত্র দৈহিক সাধনায় সেই সিদ্ধিলাভ সম্ভব।
আমার চোখের সামনে কখনও কখনও মূলাধারের ঘুমন্ত কুণ্ডলিনী জেগে ওঠে। ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে — আগুন, জল, বায়ু, মাটি, আকাশ…
(৪৪)
অনেকদিন পরে আজ বিকলে বাইরে বেরলাম। চিরদিনই আমার সঙ্গে পথের ধারে গজিয়ে ওঠা আগাছাদের একটা শ্যামল আত্মীয়তা আছে। এতোদিন দ্যাখা সাক্ষাৎ বন্ধ তাও সেই আত্মীয়তায় কোনও ফাটল ধরেনি। ওদের মুগ্ধ সাহচর্যে ডাকঘর মোড় পেরিয়ে চলে এলাম উত্তরদিকে। এখানে বাচ্চাদের একটা পার্ক আছে, ফাঁকা পার্কটির গায়ে ঝরে পড়া পাতার নিশ্বাস শুনতে শুনতে মনে হ’ল বাতাসের ভাগ্যিস কোনও ঘর-বাড়ি নেই, বিশ্রাম নেই, তাই হয়ত ওদের রক্তে কোনও চর্বি থাকে না।
আমাদের বাড়ি আছে, দেশ আছে, ভূখণ্ড আছে, যুদ্ধ আছে, স্বার্থ আছে — কত কিছুই আমাদের আছে। এতকিছুর ভিড়ে আমাদের টাটকা সতেজ রোদ্দুর ভিজে চুপসে বসে আছে সেইকথাটা বুঝতে গিয়ে কখনো নিজের মেরুদন্ডে হাত দিয়ে দেখতে হয় কিংবা হৃৎপিণ্ডের নীল আঁতুড়ঘরে তল্লাসি চালাতে হয়।
নিভু নিভু তারার মাঝে স্পষ্ট ফুটে ওঠে রাতের বলিরেখাগুলো। আষাঢ় মাসের জোলো জোলো হাওয়ার গভীরতা ছারখার করে দিয়ে যখন আমার অঞ্জলিবদ্ধ শরীর জুড়ে নেমে এসেছিল একঝাঁক রূপালি জ্যোৎস্না তখন মনে হয়েছিল, বিন্দু বিন্দু শিশির যেমন ঘাসকে আলিঙ্গন করতে ভালোবাসে তেমনই প্রতিটা মানুষের শরীর থেকেও নিজস্ব একটা সেতারের সুর ভেসে আসে…
নিকষ অন্ধকারের ওপারে সেতারের মিষ্টি সেই সুর গাছেদের শুকনো বৈরাগ্যকে অনেকটাই ঢাকা দিয়ে দ্যায়। রাতের অন্ধকারকে তাও ম্যানেজ করা যায় কিন্তু হৃদয়ের অন্ধকারকে স্যানিটারি ন্যাপকিনে মুড়িয়ে ঠুমরী শোনানোর থেকে দুস্কর্ম আর দ্বিতীয়টি নেই।
জ্যোৎস্নারা তাই মনকে বোঝে, মনে ওদের আনাগোনা
হোক না ওদের মৃদু আলো, তবু ওদের ছাড়ব না…