সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অর্ঘ্য রায় চৌধুরী (পর্ব – ১২)

মুনকে লেখা চিঠিগুলোর থেকে

(বারো)

মুন,
বিঠঠল সেই দুর্যোগপূর্ণ রাত্রে যে কথাগুলো বলেছিল তাতে বনকে আমি এক নতুন ভাবে চিনেছিলাম।ও বলেছিল নির্জন বনের গভীরে দূর থেকে কোন কিছু দেখে কৌতুহলী হয়ে এগিয়ে যেতে নেই।আমি বিঠঠলকে তার কারন জিজ্ঞেস করেছিলাম।ও বলেছিল বন ভীষন কূহকিনী।তারপর ঘটনাটা জানিয়েছিল।বনের কূহক।
সহ্যাদ্রীর বিস্তীর্ণ বন পাহাড়ের গভীরে এমন কিছু জায়গা আছে, যেখানে বিভিন্ন সময় অনেকেই অনেক কিছু দেখেছে, ওও দেখেছিল।
এক গ্রীষ্মের দুপুরে কাঠ কুড়াতে কুড়াতে ও রাজগড় দূর্গের নীচের জঙ্গলে পরিশ্রান্ত হয়ে একটা গাছের নীচে বসে বিশ্রাম নিতে বসেছিল।সমস্ত বন গরমে ঝলসে গেছে।ওই সময় ওইসব অঞ্চলে টেম্পারেচার পঞ্চাশ ডিগ্রি পর্যন্ত পৌঁছে যায়।বৃষ্টি না হলে প্রবল জলকষ্ট উপস্থিত হয়।সে বছর তখনও বর্ষা আসেনি।
ও দেখেছিল একটু দূরে একটা ঝোপের আড়াল থেকে হঠাৎ এক প্রকান্ড বাইসনের মাথা একবার উঠে ওকে দেখে নিয়েই আবার ঝোপের আড়ালে চলে গেল।ওইখানে একটা প্রাকৃতিক কুয়ো আছে।তারপরেই ডেড এন্ড, ইউ শেপড একটা জায়গা, চারপাশে জঙ্গল।জঙ্গলের সমস্ত গাছ রোদে ঝলসে গেছে।শুধু একটা আমগাছ তখনও সবুজ, আর একটা গুলমোহর গাছ সোনালী ফুলে ভরে আছে।ওখানে পৌঁছাতে গেলে একটু চড়াই ভেঙে পৌঁছাতে হয়।
বিঠঠল বাইসনটাকে কাছ থেকে দেখবে বলে এগিয়ে গেছিল।ওখানে পৌঁছে দেখেছিল কোত্থাও কিচ্ছু নেই, শুনশান জায়গা।শুধু হু হু করে বাতাসের একটানা গোঙানির মত আওয়াজ ভেসে আসছে।ও বিস্মিত হয়ে অনেকক্ষণ ওই গুলমোহর গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে ফিরে এসেছিল।
ওই রাতে ঘটনাটা বলার সময় ও আমাকে বলেছিল, “রাজে, মি দিসতো কি হো গুলমোহর পেড় মধ্যে সোনে যাইশে ফুল ভরাইসে।মি উথে ঠারলা হোতে, নন্তর নীচে আইসে।এক পন পঞ্ছী লা আওয়াজ নাহি।মোঠি গরমি ঝালা।” রাজে, আমি দেখেছিলাম ওই গুলমোহর গাছটা সোনার মত ফুলে ভরে আছে।আমি কিছুক্ষণ ওইখানে দাঁড়িয়েছিলাম, তারপর নীচে এসেছিলাম।একটাও পাখির ডাক নেই।প্রচন্ড গরম ছিল।
মুন, বিঠঠলের মত বন পাহাড়ের মানুষ, যারা এইসব বন পাহাড়ের ভূমিপুত্র, তারা বন নিয়ে এতটা মিথ্যে কথা কোনদিন বলে না।বন ওদের বেঁচে থাকার রসদ যোগায়।
তারপর ও বলেছিল, ওই জায়গাটা থেকে প্রায় একঘন্টার পথ পার হয়ে এসে ফেরার পথে ও দেখেছিল একটা বাইসন মরে পড়ে আছে।তার সমস্ত শরীর শকুনের ঝাঁক ঢেকে ফেলেছে।
ও আমাকে অনেক পরে এক ঝলসানো গ্রীষ্মের দুপুরে ওই জায়গায় নিয়ে গেছিলো।আমি দেখেছিলাম ওই গুলমোহর গাছে তখনও সোনার মত ফুলে ভরে আছে।চারপাশে ঝলসানো বন।কোন পাখির ডাক নেই।
আমার গা ছমছম করে উঠলেও ওই গুলমোহরের সোনালি ফুলের উচ্ছ্বাস দেখে আমিও অনেকক্ষণ বিমুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
নির্জন বন পাহাড়ে বহুদূর থেকে কোন কিছু দেখে কৌতুহলী হয়ে একা এগিয়ে যেতে নেই।

চন্দ্রতাড়িত।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।