সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অর্ঘ্য রায় চৌধুরী (পর্ব – ১৫)

মুনকে লেখা চিঠিগুলোর থেকে

পনেরো

মুন,

সেই রাতে সহ‍্যাদ্রীর দুর্যোগ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করল। অবিশ্রান্ত বিরামহীন বারিধারা অঝোর ধারায় সমগ্র আকাশ ভেঙে নেমে এলো, আর প্রবল ঝড়ের আওয়াজ সহ‍্যাদ্রীর চূড়ায় চূড়ায়, বনের গভীরে, উপত‍্যকা জুড়ে যেন গুমড়ে গুমড়ে কেঁদে চলল।আমার পাশে বিঠঠল নিথর, শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো “রাজে, রুক্মিণী সাংলা আহে না?” মানে রাজা, রুক্মিণী ভালোই আছে না?
মুন আমি নিশ্চুপে ওর পিঠে হাত রাখলাম, আর বিঠঠল তার ছেড়ে যাওয়া বউকে উদ্দেশ্য করে গেয়ে উঠলো হোওওও মাঝা আঁখ আহে তু, মাঝা জান আহে তু, তুম্হি মাঝা রাত আহে তু, হোওওও…সেই বিরহী লাভণীর সুর ওই প্রবল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাতের গিরীকন্দরে সেই প্রবল ঝড়ের মতোই আছড়ে পড়ে সেই প্রমত্ত তান্ডবের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেলো।সেই প্রবল ঝঞ্ঝাবাত সেই হৃদয় নিংড়ানো বিরহী সুর রুক্মিণীর কানে পৌঁছে দিলো কিনা কে জানে?
সে ঝড় চলতেই থাকলো আর চারিদিকে ক্রমশ আরো আঁধার নেমে এলো, আর মাঝেমাঝেই গাছ উপড়ে পড়ার আওয়াজ ভেসে এসে গভীর রাত্রে আমাদের সচকিত করে তুললো।সে আওয়াজ তোপধ্বনির মতোই প্রবল, প্রচন্ড।
আমরা ক্রমশ গৃহবন্দী হয়ে পড়লাম। আমি আর বিঠঠল,সহ‍্যাদ্রীর সেই অখ‍্যাত কিকউয়ী গ্রামের বনবাসী বন্ধু আমার।যার কাছে আমার অপ্রাপ‍্য বলে কিছুই নেই, যে আমার কাছে কোনদিন কিছু চায়নি। শুধু এমন এক প্রগাঢ় ভালোবাসায় পুনের শেষ দিনটা পর্যন্ত জড়িয়ে ছিল সেই শহুরে মানুষের চোখে অশিক্ষিত, অনাহারে থাকা বিঠঠল, যে তার মতো বন্ধু আমি কোত্থাও পাইনি।
সহ‍্যাদ্রীর দূর্গম পথের বিপদে সে আমাকে বহুবার বহু বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছে, চিনিয়েছে গহীন অরণ্যের ভিতরে আত্মগোপনকারী সৌন্দর্যের জায়গাগুলো।আমরা একই খাবার ভাগ করে খেয়েছি, একই বিছানায় শুয়েছি, দিনের পর দিন একই ছাদের নীচে থেকেছি।
সহ‍্যাদ্রীর ওই ঘনঘোর বর্ষণমুখরিত সেই রাত্রিগুলোতে আমরা এমন এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা পড়ে গেছিলাম, যা মানুষের কল্পনাতীত।
আমরা দুজন, ওই বৃষ্টির মধ্যেই আরেকদিন বেরোলাম। আমার ছুটির দিনগুলো শেষ হয়ে আসছিলো।পিছল পথ বেয়ে সামনের পাহাড়ের ওপর উঠে বহুদূরে দেখলাম ছায়া সুনিবিড় এক বনভূমি, নয়নাভিরাম সৌন্দর্য সমস্ত বনকে এক অপূর্ব শোভায় সমাকীর্ণ করে রেখেছে, আর বৃষ্টি পড়েই চলেছে অবিরাম অবিশ্রান্ত। দেখলাম সুদূরে নীরার ওপর কাঠের ব্রীজটা সম্পূর্নরূপে জলের তলায়, তারপর আর কিছু চোখে পড়েনা।আমি আর বিঠঠল নেমে আসার সময় দেখলাম, তুলজা ভবাণী মন্দিরের গৈরিক ধ্বজা ঝঞ্ঝায় উড়ে গেছে, মন্দিরের মাথার ছোট্ট ত্রিশূলটা শুধু একাকী নিঃসঙ্গ ভিজে চলেছে, ওরকম বিষাদ সমাকীর্ণ ত্রিশূল পরে আর কখনো চোখে পড়েনি।
সেদিন সারারাত তৃতীয় পান্ডব অর্জুনের গান্ডীব টঙ্কারের মতো মূহুর্মূহ বজ্রপাতের ধ্বনি আমাদের কানে বেজেই চলল, আর সেই সঙ্গে বনের সকাতর আর্তনাদ।প্রবল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাত্রির মেঘগর্জনের শব্দ সহস্র ঐরাবতের বৃংহনের মতো বনে বনে, উপত‍্যকার গভীরে প্রতিধ্বনীত হয়েই চলল।যেন মনে হলো কৌন্তেয় গান্ডীবে পাশুপত যোজনা করেছেন। পৃথিবীর অন্তিম ক্ষণ উপস্থিত।
কিন্তু সেই প্রমত্ত বিভীষিকার মধ‍্যেও এক অনন্য সৌন্দর্য আছে।সেই সৌন্দর্য নটরাজের ছন্দে নেচে চলল সেই বনভূমি জুড়ে, উপত‍্যকার হৃদয়ের অন্তঃপুরে।
চতুর্থ দিন সেই দুর্যোগের অবসান হল, দেখলাম, ওল্টানো সুবর্ণকলসের মতো মেঘের আড়াল থেকে অমৃত ধারার মতো নেমে এলো সূর্যরশ্মী, সমস্ত বনভূমি যেন পৃথিবীর প্রথম আলোর মতো সেই সূর্যকিরণকে সর্বাঙ্গে ধারণ করল। মনে হলো মাইলের পর মাইল বিস্তৃত সহ‍্যাদ্রীর সেই বনাঞ্চল একযোগে অংশুমালীর প্রণাম মন্ত্রে বেজে উঠলো,

ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ‍্যপেয়ং মহাদ‍্যুতিম।
ধ্বন্তারিং সর্বপাপঘ্ন প্রণতোহস্মি দিবাকরম।।

হঠাৎ বনের ভিতর থেকে বাইরের দিকে উড়ে গেল একটা পাখি।তার ডাকের আওয়াজ সমস্ত উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল।

চন্দ্রতাড়িত।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।