একটানা অঝোর ধারায় বৃষ্টিপাতের পর এক রাত্রে হঠাৎ করে মেঘ সরে গেল।ভাঙা জোছনার আলো যেন শিশি ভাঙা মধুর মত বিঠঠলের উঠোনে এসে পড়ল।আমরা বাইরে এসে দাঁড়ালাম।ওই মেঘ ছেঁড়া চন্দ্রালোকের পাশে, একটা ম্লান তারার আলো।যেভাবে বুকের ভেতর হৃদয়ের পাশে কোন স্হায়ী, অনুপম দাগ লেগে থাকে, সেইভাবে লেগেছিল।আর সমস্ত চরাচর, সেই মায়াবী আলোর ভেতর নিঝুম।সহ্যাদ্রীর উত্তুঙ্গ পাহাড় চূড়ার থেকে বয়ে এল ঠান্ডা বাতাস।বিঠঠল দেখাল ওই চাঁদের গায়ে পরশ লেগে আছে।বলেছিল, “রাজে, পাউস বড়ি জোর আইসে।” মানে, বৃষ্টি ভীষণ জোরে আসবে।বৃষ্টিকে ওরা পাউস বলে।বাতাসে কিসের যেন গন্ধ টেনে নিল।তারপর বলল, বেশি বৃষ্টি হলে ঘরে জল ঢুকতে পারে।কাল পাথর এনে চৌকাঠ বানাতে হবে।
মুন শহরে বসে জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখা, কাব্য কল্পনা, সব আমার কাছে বড় অর্থহীন মনে হয় যখন এইসব বন পাহাড়ের মানুষদের এরকম ঘনঘোর দূর্যোগে কাছ থেকে দেখেছি।এঁদের জন্য কিই বা করেছি আমরা? দল বেঁধে জঙ্গলে বেড়াতে গেছি, শহরে ফিরে এসে বলেছি দারুন লেগেছে সেই ঝটিকা সফর।কিন্তু এদের দিকে তাকিয়ে দেখিনি।
ভোর রাতে আবার বৃষ্টি শুরু হল, যখন আলো ফুটল, তখন মুষলধারে বৃষ্টি।তার সেই ছন্দ যেন “ভূজঙ্গপ্রয়াত” ছন্দেরই মতো সমস্ত উপত্যকায় বেজে উঠল।আমরা দুজন সেই ভরা বর্ষার মধ্যেই ছোট বড় পাথর টেনে আনতে লাগলাম।এক ঘন্টার মধ্যে একটা চৌকাঠ তৈরি করে ফেললাম।
এটা প্রতিটা মাওয়ালী গ্রামেই বর্ষার আগে সবাই করে।নয়তো পাহাড়ের ঢালু পথ বেয়ে জল তখন ঘরে এসে ঢোকে।জল তখন জীবন না, জীবনের জন্য তখন জল থেকে দূরে থাকতে হয়।পাহাড় থেকে বিষাক্ত সাপের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়।একবার ওইভাবে সাপ ভেসে এল।কালো কুচকুচে রং, ফনা আছে।বিঠঠল বলল সাপটার নাম “গেহুমন।” কামড়ালে দুমিনিটের বেশি মানুষ বাঁচে না।ও তাও নির্লিপ্ত ভাবে ওর বল্লমটা দিয়ে সাপটার ফনা ঘুরিয়ে দিতে লাগল বাইরের দিকে, আর বলতে লাগল, ” চলা নাগদেওতা, পাউস মধ্যে কায় করাইসে? চলা চলা।” মানে যাও নাগদেবতা, বৃষ্টির মধ্যে এখানে কি করছ? যাও যাও।” আমি রুদ্ধশ্বাসে ওর সাহস দেখে যাচ্ছিলাম।সাপটা কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে পাহাড়ের দিকে চলে গেল।বিঠঠল এসে ওর ঘরের সামনে বসে বলল, ওই বা কোথায় যাবে? হয়ত ওর ঘর ভেসে গেছে জলে।ওও তো আমারই মত।কিন্তু ওর জায়গা এটা না, ও ঠিক জায়গা খুঁজে নেবে। শুনেছি শহরের লোক সাপ দেখলেই মেরে ফেলে, মেরে বোধহয় তোমরা নিজেদের বিরাট বীরপুরুষ ভাব, কিন্তু এতে কোন বীরত্ব নেই।একটা সাপকে দশজন মিলে দল বেঁধে মেরে কি লাভ? তাড়িয়ে দিতে হয়।ওরা কি বোঝে? ভয় পায় বলে আত্মরক্ষার জন্য কামড়ায়, হয়তো খাবারের খোঁজে বেরিয়েছে, ঘরের খোঁজে বেরিয়েছে।
শহুরে মানুষ শুনি শিকার করে? হরিন মারে, পাখি মারে, ওরা তাদের কোন ক্ষতিটা করে? মানুষ সবচেয়ে হিংস্র এক জীব।বনের আইন আলাদা, শিকার বলে তোমরা এখানে যেটা ভাব সেটা আসলে বেঁচে থাকার জন্য রসদ আহরণ।
মুন, কথাগুলো আজকাল বড় বড় গেম ওয়ার্ডেনদের মুখে শুনি।ওরা ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিস পাশ করা তো দূর, নামটুকুও সই করতে পারে না।ওরা বংশপরম্পরায় এই শিক্ষা পেয়ে এসেছে।আর পেয়েই শুধু আসেনি, তাকে বিশ্বাস করেছে।
সারা সকাল দুপুর রাত্রি জুড়ে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হতেই থাকল, আর আমার বারবার মনে পড়ে যেতে লাগল রবীন্দ্রনাথের সেই গানের কথাগুলো
” আমি তখনও ছিলেম মগন গহন
ঘুমের ঘোরে, যখন বৃষ্টি নামল…”
সেই পুঞ্জীভূত মেঘদল রিমঝিম বরিষণে ঝরে পড়ল ওই মায়াবী উঠোন জুড়ে, বন পাহাড় যেন সেই অনুপম আদরে সলজ্জ সোহাগী ভাষায় সাড়া দিয়ে উঠল, মাঝে মাঝে প্রাচীন দুন্দুভির মত ডেকে উঠল মেঘ, আর বৃষ্টি এক তুখোড় নর্তকী।মুন সহ্যাদ্রীর ওই বৃষ্টিপাতের রাতগুলো আমার তৃতীয় নয়ন উন্মুক্ত করে দিয়েছে।এই বন পাহাড়ের এত রূপ, এত সুগন্ধ সমারোহ, এত অপরূপ সেই বৃষ্টিপাতের ভাষা।মনে হচ্ছিল আমিও ওই শ্রাবণ ধারার মতো অঝোরে ঝরে পড়ি ওইসব নির্জন উপত্যকায়, নদীতে।ওই বন পাহাড়কে আমার সমস্ত সত্ত্বায় মিশিয়ে ফেলি।
ওই বৃষ্টিবনের ভেতর সজল মেঘের নীলাঞ্জন ছায়ায় আমি তোমাকেই খুঁজেছিলাম।কে জানত, যে তুমি এখানেই আছ? তোমাকে ওই বৃষ্টিটুকু দিলাম।