সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অর্ঘ্য রায় চৌধুরী (পর্ব – ১০)

মুনকে লেখা চিঠিগুলোর থেকে

(দশ)

মুন,
সহ্যাদ্রীর সেই ঘনঘোর বর্ষায় ওই বন পাহাড়কে আমি এক নতুন রূপে চিনেছিলাম।
প্রবল বৃষ্টির মধ্যে কিকউয়ী গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন গাছটা এক রাতে ভেঙে পড়ল।ওই দুর্যোগে এই প্রথম মৃত্যু।আমরা মানুষ মারা গেলে ব্যথিত হই, কিন্তু গাছ? সেও তো আমাদের প্রতিবেশী!
মাঝরাতে ওই মৃত্যুর শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে গেল।আমরা বাইরে এসে দাঁড়ালাম।দেখলাম ওই অন্ধকারে কিছু টের পাওয়া যাচ্ছে না।বিঠঠল বলল কাছাকাছি কোন গাছ ভেঙে পড়েছে।
সেই রাতে সহ্যাদ্রীর ওই উপত্যকায় অসংখ্যবার বাজ পড়েছিল।সঙ্গে মূহুর্মূহ বিদ্যুৎ চমক।আমরা সারা রাত দুজন জেগেই কাটিয়ে দিলাম।আমার ভানুসিংহের পদাবলীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল
“উন্মদ পবনে যমুনা তর্জিত,
ঘন ঘন গর্জিত মেহ।
দমকত বিদ্যুৎ, পথতরু লুন্ঠিত,
থরহর কম্পিত দেহ।
ঘন ঘন রিমঝিম,
রিমঝিম রিমঝিম
বরখত নীরদপুঞ্জ।
শাল-পিয়ালে তাল-তমালে
নিবিড়তিমিরময় কুঞ্জ।”
সেই বিজুরী চমক, সেই বজ্রপাত, সেই ভয়ঙ্কর দুর্যোগপূর্ণ রাত্রির মধ্যে যে সুন্দরের স্থান রয়ে গেছে, সেই সুন্দরকে সেই রাতে দুচোখ ভরে দেখেছি।
সে দুর্যোগ তুলনাহীন তুলনাহীন।
সমস্ত উপত্যকা বিদ্যুৎ চমকে বারবার কেঁপে উঠছিল।সমস্ত বন প্রবল বেগে আন্দোলিত হচ্ছিল, যেন মনে হচ্ছিল প্রমত্ত ধূর্জটি পার্বতী বিরহে রুদ্ররূপ ধারন করেছেন।আজ রাতেই পৃথিবী রসাতলে নিমজ্জিত হবে।
তারপর যখন ধীরে ধীরে সকাল হল, দেখলাম অসংখ্য ঝরা পাতা, গাছের ডালে সমাকীর্ণ ওই বনাঞ্চল।অসংখ্য পাখির শব, তার মধ্যে একটা ময়ূরও পড়ে আছে।
মুন, যে কোন মৃত্যুই কোথাও না কোথাও ভীষণ বেজে ওঠে, নিঃশব্দ মৃত্যু কথাটা আসলে আলঙ্কারিক প্রয়োগমাত্র।

চন্দ্রতাড়িত।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।