মারিওভা কফি জয়েন্টের পাশে একটা ছোট্ট পার্ক মতো আছে। কয়েকটা রংবাহারি বেঞ্চ আর পলি- গন্ধা ফুলের ঝাড়। এই ফুলগুলো দিনের এক একটা সময় এক একরকম সুগন্ধ ছড়ায়। এগুলো ভার্চুয়াল নয়, ইন্সটলেশন। আর্থেনিয়ার সমস্ত পাব্লিক প্লেসে পলি-গন্ধার ছড়াছড়ি। এছাড়া সেখানে আর কিছুই নেই। আসলে এই পার্কটা মারিওভারই একটা এক্সটেনশন। এখানে বাইরের উটকো লোক ঢুকতে পারে না। মারিওভার ভেতরে আসলে ফোন ধরতে দেওয়া হয় না। তাই কারো ফোন এলে বা ফোন করবার দরকার হলে এখানে বেরিয়ে আসে, একটা বেঞ্চিতে বসে কথা সেরে নেয়। শোনা যাচ্ছে, এই মেয়েটা , যার নাম ঠিকানা এখনো কিছুই জানা যায়নি, বা জানা গেলেও সেটা মিডিয়াকে বলা হয়নি, সে কাল অনেক রাতে মারিওভাতে এসেছিল। নিয়েছিল এক প্লেট অ্যাল্গিস্তা (অ্যালগি ছড়ানো পাস্তা, এটা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সাংঘাতিক জনপ্রিয়)। তারপর সে একটা কফির অর্ডার দেয়।
‘সাধারণ কফি, কফি শেক না ইনফিউশন?’
‘এমনি কফি’
পুলিশের ইন্টেরোগেশনের উত্তরে জানিয়েছে মেয়েটি, যে বছর তিনেক হল মারিওভায় ওয়েট্রেসের কাজ করছে। আর্থেনিয়ায় সেন্ট্রাল হাবের কয়েকটা লোক দেখানো ব্যাপার আছে। তারা প্রশাসনের স্বচ্ছতা প্রমাণ করবার জন্যে এই ধরনের ঘটনা ঘটলেই প্রাথমিক সব ইন্টেরোগেশন সরকারি চ্যানেলগুলোয় লাইভ সম্প্রচার করে থাকে। আর তা দেখানো হয় প্রতিটা সিগন্যালের পোস্টে। নিন্দুকেরা অবশ্য বলে ওরা কেবল অকিঞ্চিৎকর খবর টুকুই দেখায়। যেটা সত্যিকারের খবর, সেটা আড়ালেই থাকে।
নোয়া আর জারা পার্কের রেলিং-র ওপারে দাঁড়িয়ে সিগন্যাল পোস্টের খবরটাই দেখছিল। জারা জানে এই খবরটাই প্রতিদিন অজস্রবার দেখানো হবে, দেখতে দেখতে সবাই ক্লান্ত হয়ে যাবে, বিরক্ত হবে এবং একসময় ভুলেও যাবে। মেয়েটির মৃত্যুর কোন কিনারা হবে না।
পার্কের একেবারে দূরতম কোণে পড়ে আছে মেয়েটি। তার শরীর একটা সাদা-কালো কাপড়ে ঢাকা, কাপড়ের ওপর সি. এইচ.-র লোগো। এই লোগোটা দেখে দেখে অভ্যাস হয়ে গেছে। তবু আজ গা রিরি করে উঠল জারার। সব কিছুতে নিজেদের জাহির করতে হবে? মৃতদেহ ঢাকার কাপড়েও?
জারা নোয়ার হাত ধরে টানল, ‘চলো, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব মিথ্যে খবর দেখে কী হবে? ’
‘ও হ্যাঁ, তুমি তো অফিসে যাবে আবার’
‘না যাব না ভাবছি, ইচ্ছে করছে না, মনটা ভার হয়ে আছে। আজ কোন কাজে মন দিতে পারব না।’
নোয়া হেসে বলল ‘ তাহলে আমার কাজটা কত ভালো বল? মন ভালো থাকলেও ফুল ফোটাতে ভালো লাগে আর মন খারাপ হলে তো কথাই নেই’
জারার মুখ ঝলমল করে উঠল ‘ দারুণ বলেছ! ভাবছি আজই চাকরিতে রিজাইন করে তোমার সঙ্গে ফুল ফোটানোর কাজ করব। ভালো হবে না?’
নোয়া খুব সিরিয়াস মুখ করে বলল ‘সত্যি আসবে আমার সঙ্গে? এটা প্রফেশনালি করা গেলে কিন্তু দারুণ ভবিষ্যৎ। আমি খুব ভালো করে খোঁজ নিয়েছি আর্থেনিয়ায় আমার মতো কেউ ফুল ফোটায় না। ইতিমধ্যেই কিন্তু অনেকে আমার কাছে এ নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে, কেউ কেউ নিজেদের বাড়ি সাজানোর জন্যে কিনেও নিয়ে গেছে। মুশকিল হচ্ছে, আমি ফুল ফোটাতে পারি কিন্তু বেচতে জানি না। কী দাম ফেলব, টার্গেট মার্কেট কোনটা, প্রমোশন কীভাবে করব, এ ব্যাপারে কেউ সাহায্য করলে ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে যাবে। এখন তুমি ছাড়া এখানে কাউকে তো চিনিই না, তাছাড়া তোমাকে প্রথম দিন দেখেই আমার খুব কাছের নিজের লোক বলে মনে হয়। আজবনগরে ঠিক তোমার মতো একজন’
এই পর্জন্ত বলে হঠাৎ যেভাবে থেমে গেল নোয়া, তাতে জারার মনে হল পেছনে ও এমন অনেক কিছু ফেলে এসেছে, যা ওকে এখনো কাঁদায়। সেই জীবনের কিছুই জানে না জারা। একেবারে না জেনে শুনে বাঁধা চাকরি ছেড়ে অনিশ্চিতের দিকে ঝুঁকবে?
নোয়া যেন ওর মনের কথা পড়তে পেরেছে, সেইভাবেই বলল ‘অবশ্য সেটা সম্পূর্ণ তোমার সিদ্ধান্ত। তুমি তো আমাকে চেনই না। কেনই বা আমার জন্য চাকরি ছাড়বে?’
জারা হেসে ফেলল। ‘আরে অত ভারিভারি কথা ভাবার দরকার নেই। আপাতত আজ আমি ছুটি নিয়ে নিলাম। চলো নদীর ধারে গিয়ে বসি। মাথাটা ছাড়ানো দরকার। যাবে?’
নোয়া উত্তর না দিয়ে জারার এরো-স্কুটিতে গিয়ে বসল। এই মেয়েটার সঙ্গে থাকলে এত ভালো লাগে কেন কে জানে! কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেল বাঁশি নদীর ধারে। এখন অফিস টাইম বলেই বোধহয় বেশি ভিড় নেই। ওরা একটা গাছের ছায়াতে গিয়ে বসল। গাছ, নদী সবই নকল, তবু জায়গাটা বেশ লাগে জারার।
নোয়া হেসে বলল ‘গাছটা সত্যি নয়, কিন্তু ছায়াটা সত্যি। মজার ব্যাপার তাই না?’
জারা বলল ‘দুনিয়া বলে একটা শব্দ আছে জান তো? আগে দুনিয়া বলতে শুধু পৃথিবীটাই বোঝাত। এখন দুনিয়া অনেক বড়। গ্রহে গ্রহে নতুন বাসভূমি, তাছাড়া আমাদের আর্থেনিয়ার মতো কত গ্রহাণু । সব জায়গাতেই কিন্তু এই ব্যাপারটা পাবে’
নোয়া ধরতে পারল না কথাটা। ‘এই ব্যাপারটা মানে?’
‘মানে, গাছ নেই, তবু ছায়া আছে। আসলে কোন কিছুর অস্তিত্ব শুধু আমাদের মনেই থাকে। মনে করলে আছে, না করলে নেই। যে যত মনে করতে পারবে, সে তত ধনী’
নোয়া অবাক হয়ে বলল ‘এ রকম কথা তো আমাদের আজবনগরে চলে। তুমি জানলে কী করে?’
জারা খুব নরম করে নোয়ার হাতে হাত রাখল ‘ কি করে জানলাম? সে এক লম্বা গল্প। মার কাছে এরকম গল্প অনেক শুনেছি। মার কাছে একটা জিনিস আছে। একটা পুরনো ডায়েরি। আমাকে দেখতে দেয় না কোনদিন। কেন কে জানে! তবে আমিও জেদ ধরে আছি। দেখবই ওটা। তোমাকে দেখাব একদিন। আজ নয়। আজ শুধু বাঁশি নদীর ধারে নোয়া আর জারা । ব্যস আর কিচ্ছু না’
নোয়া হাত টেনে নিল না, ওরও ভালো লাগছিল খুব। নদীর বুকে আলোর নাচ দেখতে দেখতে ও বলল ‘কিছু কিছু জিনিস আছে, যা না দেখাই ভালো। একটু কম জানলে জীবনটা সুন্দর হয়’
জারা অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।