• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে তৃষ্ণা বসাক (পর্ব – ৫)

শূন্যকাননের ফুল

৫। তারে ধরি ধরি মনে করি

প্রশংসায় ভাসছে সেন্ট্রাল হাব। এত সুখের দিন ইদানীং কালে আর এসেছে কিনা সন্দেহ। পদ্মাসনা আয়েঙ্গার যেহেতু পুলিশ প্রশাসন দেখেন, তাই তিনি স্বাভাবিকভাবেই পুরো কৃতিত্ব দাবী করেছিলেন, কিন্তু মিকি টকিহাউস তাঁকে প্রায় ফেড আউট করে দিয়ে সবটাই চিফের পাদপদ্মে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। চ্যানেলে চ্যানেলে সাক্ষাৎকারে তেমনটাই তিনি বলে বেড়াচ্ছেন।
‘যে জন শূন্যে ফোটায় ফুল,
তাকে চিনতে কোর না ভুল
দোষী সে-ই জন
শীঘ্র করো অন্বেষণ।’
চিফের এই চার লাইনের ছড়া বা কবিতা বা কড়া বা ছবিতা বা যাচ্ছেতাই যাই বলা যাক-চ্যানেলে চ্যানেলে, সিগন্যাল পোস্টে, স্কাইবোর্ডে সর্বত্র ছড়িয়ে গিয়েছে, কে একজন সুরও দিয়ে ফেলেছে, আর রাস্তাঘাটে লোকজনকে গাইতেও শোনা যাচ্ছে সেটা গুনগুন করে। তাতে একটু মনক্ষুণ্ণ হলেও নিরাশ হবার কারণ নেই পদ্মাসনার। কারণ সেন্ট্রাল হাবে এখন কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে পদ্মাসনার প্রোমোশনের খবর। সামনের মাসেই পদ্মাসনা হয়ে উঠবেন নেক্সট টু চিফ। সেটা ভাবলেই ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠছেন পদ্মাসনা। খুশির তরঙ্গ তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে তাঁর শরীর, থুড়ি সিস্টেমে। পোস্টটা পেলেই মিকির চাকরি খাবেন তিনি। একেবারে খেতে পারবেন না, তবে ওঁর জন্যে পানিশমেন্ট পোস্টিং ভেবে রেখেছেন তিনি। মিকিকে তিনি পৃথিবীতে আর্থেনিয়ার দূত করে পাঠাবেন। দেখ, শহর ছেড়ে অজ পাড়া গাঁয়ে গিয়ে থাকতে কেমন লাগে!
নিজের ঘরে সোফায় আধশোয়া হয়ে টিভি দেখছিলেন পদ্মাসনা। ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে। ঝুল কলোনি থেকে ছেলেটাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ওর নাম নোয়া । এসেছে পৃথিবীর কি একটা জায়গা, ও হ্যাঁ আজবনগর থেকে। শূন্যে ফুল ফোটাবেন উনি। যাও বাছা, এবার ফুল ভুলে হুলের জ্বালা টের পাও। আর্থেনিয়ার জেলখানা একটা অদ্ভুত জায়গা। এখানে ফাঁসি বা শূলে চড়ানো বা মারধোর –এসব কিছু করা হয় না। শুধু মাথার স্মৃতির অংশটুকু চেঁছে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। লোকে যেমন চুল বা নখ কেটে ফেলে সেইভাবে। চুল বা নখ আবার গজায়, কিন্তু পুরনো স্মৃতি আর গজায় না। স্মৃতিছাঁটা মানুষকে যখন জেল থেকে বার করে দেওয়া হয় তখন সে না নিজেকে চিনতে পারে, না চিনতে পারে তার ছেড়ে যাওয়া পাড়া, শহর, লোকজন, অফিস। সে একটা ‘কিচ্ছু না’ হয়ে যায়। সমাজে সংসারে তার কোন অস্তিত্ব থাকে না। সে তখন তার পুরনো কাজেও ফিরতে পারে না, নতুন করে কিছু শুরুও করতে পারে না। যেভাবে বেঁচে থাকে তা মৃত্যুর থেকেও ভয়ংকর।
ভাবতেই আনন্দে আটখানা হয়ে উঠলেন পদ্মাসনা। আহ, ছেলেটা স্মৃতি হারিয়ে ফিরবে, ওর ফুল ফোটানোর কথা আর মনেই থাকবে না। কি আনন্দ! একটা মেয়েকে রেপ করার শাস্তি এটাই। ছেলেটার মুখ চোখে কিন্তু অপরাধবোধ নেই কোন, বরং খানিকটা কৌতুক আর খানিকটা বিস্ময় খেলা করছে সেখানে। দেখে খুশি ভাবটা কেটে গেল পদ্মাসনার। যাকে শাস্তি দেওয়া হল, সে যদি একটুও না দমে, একটুও না ঘাবড়ায়, তবে আর শাস্তি দেবার মজাটা কোথায়? পদ্মাসনার মনটা কেমন খুঁতখুঁত করতে লাগল। শাস্তিটা যথেষ্ট কড়া হল না। আরও কঠিন, আরও ভয়ংকর কিছু ভাবতে হবে। যদিও তিনি পুলিশ প্রশাসন দেখেন, তবু আইন প্রণয়নের ক্ষমতা তাঁর হাতে নেই। সেটা ঠিক কার হাতে আছে, তাও জানেন না তিনি। চিফ যা বলেন তার অন্ধ অনুসরণ করা ছাড়া কোন উপায় নেই তাঁর বা বাকিদের। এই প্রথম আর্থেনিয়ার সব কিছুর ওপর খেপে উঠলেন পদ্মাসনা। সব কিছুই লোক দেখানো মনে হল তাঁর। স্মৃতি মুছে দেওয়া, ছোঃ! এটা কোন শাস্তি হল! ফাঁসি কিংবা কুকুর দিয়ে খাওয়ানো, কিংবা উলটো গাধার পিঠে চড়িয়ে দেশ থেকে বার করে দেওয়া- পৃথিবীতে কি চমৎকার সব শাস্তি ছিল। আর এখানে যত্ত সব ন্যাকামো। কিছু হলেই হইচই পড়ে যাবে আর্থেনিয়ান রাইটস লঙ্ঘিত হচ্ছে! ভাগ্যিস এই ছেলেটা আর্থেনিয়ান নয়, একজন উদ্বাস্তু। আর একেবারে একলা উদ্বাস্তু, যার জন্যে গলা ফাটাবার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
পদ্মাসনা মনের আনন্দে পাশের টেবিলে রাখা বাটি থেকে একমুঠো কাঁঠালের চিপস তুলে কুড়মুড় করে চিবোতে লাগলেন। হিউম্যানয়েড যদিও, কিন্তু ইনি মাত্র এক প্রজন্ম আগে পৃথিবী থেকে এসেছেন, আর তার আগের প্রজন্ম তো মানুষ। অর্থাৎ মানুষের ঔরসে ও বীর্জে না হোক, মানুষের উদ্যোগেই ল্যাবে জন্ম তাঁর। আর তাঁর সেই পূর্ব মানুষেরা ছিলেন তামিল, তাদের শ্রদ্ধা জানাতেই তিনি যেমন পদবী আয়েঙ্গার ব্যবহার করেন, তেমনি সুযোগ পেলেই তামিল খাবার খান। আর্থেনিয়ায় এসব খাবার জোগাড় করা খুব শক্ত, এগুলো আসে পৃথিবী থেকে। নিন্দুকেরা বলে পদ্মাসনাকে এক প্যাকেট কাঁঠালের চিপস দিলেই অনেক অবৈধ অনুপ্রবেশকারী আর্থেনিয়ায় নাগরিকত্ব পেয়ে যায়। কথাটা খুব মিথ্যে না। এই চিপসের প্যাকেটটা দিয়েছে পৃথিবীরই একজন। সে এখানে ইলিশ মাছের ব্যবসা করতে চায়। ব্যাপারটা খুব সন্দেহজনক মনে হয়েছিল পদ্মাসনার। কারণ ইলিশ মাছ তো পৃথিবী থেকে কবেই হারিয়ে গেছে, যা নেই তার ব্যবসা হবে কেমন করে? তাহলে মানুষ থেকে যেমন হিউম্যানয়েড, তেমনি ইলিশ থেকে কি হিলশয়েড বানিয়ে ফেলল পৃথিবীর মানুষেরা? আর সেই হিলশয়েড আর্থেনিয়ানদের খাওয়াতে চাইছে লোকটা? মাথা গরম হয়ে গেছিল শুনে। রেগে কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই লোকটা ঝোলা থেকে বের করল এক বাক্স ইডলি, উত্তপম আর কয়েক প্যাকেট কাঁঠালের চিপস। ব্যস। সব পাস হয়ে গেল।
কিন্তু কাঁঠালের চিপসও শান্ত করতে পারল না পদ্মাসনাকে। নিমপাতা মুখ করে তিনি টিভি দেখতে লাগলেন। ছেলেটাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওলালার পুলিশ। দড়ির ওপারে কৌতূহলী মুখের ভিড়। যেমন হয়। রেপ কেস আর উদ্বাস্তু অপরাধী বলে ভিড় একটু বেশি। হঠাৎ সেই ভিড় থেকে দড়ি টপকে ছেলেটির কাছে চলে এল একটি মেয়ে, পুলিশ বাধা দেবার আগেই জড়িয়ে ধরল ছেলেটাকে। যদিও এক মুহূর্তের জন্যে, কিন্তু সেটাকেই অনন্তকাল মনে হল পদ্মাসনার। ওই এক মুহূর্তেই যেন ওদের মধ্যে এমন সংকেত চালাচালি হয়ে গেল যা আর্থেনিয়াকে ধসিয়ে দিতে পারে। তারপরে যা ঘটল, তাতে হাড় হিম হয়ে গেল তাঁর। ক্যামেরার দিকে মুখ ফিরিয়ে মেয়েটি বলল ‘ চোখে যা দেখছেন তা একদম বিশ্বাস করবেন না। আসল অপরাধীকে আড়াল করতে নোয়াকে ফাঁসানো হয়েছে। সত্যিটা আমি খুঁজে বার করবই। নোয়া, আর্থেনিয়ার জেল তোমাকে আটকে রাখতে পারবে না, আই প্রমিস’

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।