• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে তৃষ্ণা বসাক (পর্ব – ৮)

শূন্যকাননের ফুল

ফুল ফোটে, তাই বলো !

‘যদি আমরা কয়েক বছর ধরে আর্থেনিয়ার সমস্ত মিডিয়ার ফোকাস লক্ষ্য করি তবে দেখব বারবার দুটো ইস্যু উঠে আসছে- এক তো রেপ, অন্যটা উদ্বাস্তু। এই দুটো সমস্যাই সি এইচ এর গলার কাঁটা হয়ে আছে’
জারাদের ব্যালকনিটা খুবই ছোট, আর আজ সেখানে চার- চারজন লোক বসায় আরও ছোট দেখাচ্ছে। তবু বিকেলটা ভালো লাগছে বড্ড। পাশের মোড়াতে নোয়া বসে আছে যে।
কফিতে চুমুক দিয়ে মা আবার বলতে শুরু করে ‘ প্রথমটা দিয়ে শুরু করি। রেপ দিনদিন বাড়ছে, এমনকি রোবটরাও রেপ করছে, মেয়েদের নিরাপত্তা প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। এই সমস্যার সমাধান করতে পারেননি আর্থেনিয়ার সি এইচ। উলটে তারা সোনার পাথরবাটির মতো একটা পলিসি আনলেন, যার নাম নিউটালাব্রিয়াম। প্রত্যেকটা মেয়েকে বলা হল বাড়ি থেকে বেরনোর সময় নিউট্রাল মোড অন করে বেরতে হবে। একটা প্যানিক ছড়িয়ে দেওয়া হল, আমরা মায়েরা মেয়েদের বাড়ি থেকে বেরনোর আগে সমানে বলতে থাকলাম নিউট্রাল মোড অন করে নে। বলতে খারাপ লাগে আমিও করেছি।’ শেষ বাক্যটা বলার সময় গলাটা কেঁপে গেল মায়ের।
‘ইটস অল রাইট মা। কিন্তু আমি কোনদিন বুঝতে পারিনি জিনিসটা কি। একটা ঘড়ির মতো পরতে হয় আমাদের’
‘এর থেকে বড় বুজরুকি কিছু হয় না। আগেকার দিনে পৃথিবীতে মানুষ ভাগ্য ফেরানোর জন্যে হাতে আংটি পরত, এটাও সেইরকম। হরমোন নিয়ন্ত্রণের জন্যে শরীরের মধ্যে যে চিপ বসানো হয়, জন্মের পরেই, হাতের ঘড়িটা তার রেগুলেটর।’
ছিটকে ওঠে জারা ‘এটা তো ভীষণ অপমানজনক। এর মানে তো বোঝানো হচ্ছে রেপ হয় মেয়েদের তরফ থেকে মেয়েলি ইশারার জন্যে।’
‘একজ্যাক্টলি। এ যেন চুরির জন্যে চোর না ধরে গৃহস্থকে বলা সব জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলো। অনেক আগে মেয়েদের চেস্টিটি ব্যান্ড পরতে হত এ হচ্ছে অনেকটা এইরকম।’
জারা মুখ বাঁকিয়ে বলে ‘এই তাহলে নিউটালাব্রিয়াম!’
ব্যালকনির কোণের দিকে মোড়ায় বসা চতুর্থ ব্যক্তিটি এইসময় কিছু বলার চেষ্টা করেন, কিন্তু তাকে বলার সুযোগ না দিয়ে মা বলতে শুরু করেন
‘ স্বাভাবিকভাবেই নিউট্রালাব্রিয়াম নিয়ে বিক্ষোভ বেড়েই চলেছে। মেয়েরা মানতে রাজি নয় এই অদ্ভুত জিনিস। এদিকে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে উদ্বাস্তু সমস্যা’
‘লোক কি শুধু পৃথিবী থেকেই আসে মা? আর কেনই বা আসে?’
‘হ্যাঁ, আর্থেনিয়ায় যত উদ্বাস্তু প্রায় সবই পৃথিবীর। আসলে আর্থেনিয়ার জন্ম তো বলতে গেলে পৃথিবীর হাতেই, এখানকার প্রথম যুগের নেতা নেত্রীরা সবাই পৃথিবীর। তাই ওখানে কোন অসুবিধে হলে কিংবা নতুন ভাবে বাঁচতে চাইলে সবাই আর্থেনিয়ায় পাড়ি জমায়।
প্রথম প্রথম এদের খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি সি এইচ। কিন্তু পরে এমন এমন লোক আসতে শুরু করল, যে সি এইচ -এর ধারনা হল এরা আর্থেনিয়ার অচলায়তন ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে। বিশেষ করে নোয়া আসার পর সি এইচের ভেতরে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল, তাকে প্রায় হিস্টিরিয়াই বলা যায়’
এইসময় চতুর্থ ব্যক্তি গলা খাঁকারি দিলেন। মা তাঁর দিকে না চেয়েই বললেন ‘ ভেবো না, তুমিও বলার সুযোগ পাবে। আমার আর সামান্যই বাকি আছে’
জারা ভেবে পেল না এই ভদ্রলোককে মা এখানে কেন ডেকেছে। আসার পর থেকে কোন হাই হ্যালো শিষ্টতাও বিনিময় হয়নি, আর এই ব্যাপারে ইনি কীভাবেই বা জড়িয়ে কে জানে। যাক গে, মার কথায় মন দিল জারা।
‘জারা, তুই জিগ্যেস করেছিলি না যে ফুলকে কেন কেউ ভয় পাবে? আমি তোকে বলেছিলাম ফুল একটা থ্রেট। বিপ্লব, প্রেম সব কিছুর প্রতীক ফুল। আর আর্থেনিয়ায় সবসময় চেষ্টা হয়েছে যেকোন অনুভূতিকে দমিয়ে রাখতে, তাই ফুল বেচতে আসা নোয়া হয়ে দাঁড়াল বিষষ মাথাব্যথার কারণ। আর তাই ওকে ফাঁসাতে ব্যবহার করা হল রেপ ইস্যুকেই। এতে দুটো লাভ- একঃ নোয়ার মতো কেউ যেমন ভবিষ্যতে ফুল ফোটাতে আসবে না এখানে, তেমনি দুইঃ পাবলিক ভাববে রেপকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখছে সি এইচ। তাই মিকির মাধ্যমে সাজানো হল মারিওভা কফি জয়েন্টের নাটক। ওই কাপড় তুলে যদি দেখতিস ওখানে কিছু পেতিস না!’

জারা খুব অবাক হল না শুনে, কারণ এমন একটা আভাস মা আগেই দিয়ে রেখেছিল। মা বলতে লাগলেন ‘ সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু বাদ সাধল আমার জারা। সে নোয়াকে ভালবাসল আর ভালবাসা পাথরেও ফুল ফোটাতে পারে’
নোয়া জারার হাতে চাপ দিল। মা সেদিকে চেয়ে একটু হেসে বললেন ‘জারা তুই বলেছিলি না কে ফুল ভয় পায়? এই সেই লোক’
জারা চমকে উঠে বলল ‘ইনি! ইনি তাহলে চিফ! রিয়েল’
‘হ্যাঁ ইনিই জালের আড়ালে থাকা রাজা, শুধু যে ফুলে অ্যালার্জি তাই নয়, শিশুতেও এর .. তাই ছোট্ট জারা আর তার মাকে ফেলে চলে গেছিলেন’
জারা লাফিয়ে উঠে বলল ‘কী বলছ মা? ইনি আমার বাবা! আর্থেনিয়ার চিফ আমার বাবা! আর আমরা এই ছোট্ট ফ্ল্যাটে এত কষ্ট করে কাটিয়েছি এতগুলো বছর!’
জারাকে বুকে টেনে নেন মা। নোয়া দেখে তার ফোটানো ফুলের চেয়েও সুন্দর এই জোড়া ফুল। বোধহয় এই দৃশ্য চিফকেও কিঞ্চিৎ বিচলিত করে, নইলে তিনি উঠে এসে জারার পিঠে হাত রাখবেন কেন। যদিও সেই স্পর্শে স্পষ্টতই কুঁচকে যায় জারা।
মা বলেন ‘ প্লিজ তুমি বোসো। ভালবাসার স্পর্শ ছাড়া কোন স্পর্শ আমার মেয়ে সহ্য করতে পারে না। জারা শান্ত হও, এবার আমরা চিফের কথা শুনব’
একটু নড়েচড়ে বসেন চিফ। গলা ঝেড়ে বলেন ‘ আমার বিশেষ কিছু বলার নেই। আর্থেনিয়ার পলিসি নিয়ে এখানে আমি কিছু বলব না। আশা করি কেন বলব না- সেটা সবাই বুঝবে। রাষ্ট্র রাষ্ট্রের মতো চলবে। আমিও সেখানে একটা ছোট্ট আলপিন’ এই কথাটায় জারা আর নোয়ার মুখে যে মুচকি হাসি ফুটল সেটা না দেখার ভান করে চিফ বলে চললেন-
‘তাই রাষ্ট্রের কাছে ফুল বিপদসংকেত কিনা এসব কেউ আমার মুখ থেকে বার করতে পারবে না, আর এই কেসটার ব্যাপারে একটা কথাই বলব, এটা ঠিক মতো হ্যান্ডল করা হয়নি, এই মিকিটাকে নিয়ে’ চিফের মুখে স্পষ্টই বিরক্তি ফুটে ওঠে।
মা ঠান্ডা গলায় বলেন ‘সেসব নিয়ে আমার কোন আগ্রহ নেই, আমি জানতে চাই এবার থেকে নোয়া তার কাজটা বিনা বাধায় করতে পারবে কিনা?’
চিফ সে কথার জবাব না দিয়ে বলেন ‘হ্যাঁ একটা কথা আমি বলতে পারি, ব্যক্তিগতভাবে আমি ফুল টুল একদম পছন্দ করি না, আর বাচ্চাকাচ্চা দেখলেই আমার মাথা ধরে যায়। তাই তোমাকে ছেড়ে যেতে হয়েছিল সারা। তুমি যদি তখন মেয়েটাকে কেয়ার সেলে দিয়ে দিতে, তবে তো যেতে হত না’
মার মুখ কঠিন হয়ে ওঠে, তিনি কিছু বলার আগেই চিফ আবার বলেন ‘বেশ, ধরে নেওয়া যাক ওটা আমার ঐতিহাসিক ভুল, তবে সেটা জনসমক্ষে স্বীকার করব, এমন আশা কোর না। তবে হ্যাঁ এবার থেকে তোমরা মাসে মাসে একটা ভাতা পাবে, পরিত্যক্ত নারী ও শিশু ভাতা। সেটা যথেষ্ট বেশি। আর এই ছেলেটা যদি বেশি কেরদানি না দেখিয়ে চুপচাপ ফুল ফোটায় আর বেচে, তো ঠিক আছে, তবে মনে রেখো, ওর ওপর সেন্ট্রাল হাবের নজর থাকবে।’
উঠে দাঁড়ান সারা, জারা দেখে মার ঋজু চেহারার সামনে চিফকে একটা বদখত জোকারের মতো দেখাচ্ছে।
‘আপনি এখন আসতে পারেন চিফ। আপনার ভাতা আমাদের প্রয়োজন হবে না, সরি। আপনি তো আবার নিজের কবিতা ছাড়া অন্যের টবিতা পড়েন না, পড়লে ভালো হত, আর্থেনিয়া বেঁচে যেত। প্রাচীন কালে পৃথিবীতে সুকুমার রায় বলে একজন কবি ছিলেন , তাঁর একটা কবিতা শুনুন-
ঠাস ঠাস দ্রুমদ্রাম শুনে লাগে খটকা/ ফুল ফোটে? তাই বলো, আমি ভাবি পটকা! তো নোয়া ফুল ফোটাবে না আপনাদের ল্যাজে জ্বলন্ত পটকা বেঁধে দেবে সেটা ওই ঠিক করবে। আর তখন আপনারা কী করবেন, সেটা আপনারা ভাবুন। তাড়াতাড়ি যান, গিয়ে আবার মিকি টকিহাউসকে শো কজ করতে হবে, কত ঝঞ্জাট বলুন তো!’
চিফ চলে যাবার পরে জারা ঝলমলে মুখে বলে ‘মা, আজকের বিকেলটা খুব সুন্দর, আমরা একটু বাঁশি নদীর ধার থেকে ঘুরে আসি’
‘আচ্ছা যাও, কিন্তু সাবধানে। লেজে পটকা বাঁধা কুকুর গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। আর নোয়া, তুমি কিন্তু একটা মিথ্যে কথা বলেছ’
সারার এই কথায় জারা চমকে উঠে দেখে, যাকে বলা, সে কিন্তু মুচকি মুচকি হাসছে।
জারা নোয়ার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে ‘বলো বলো কী মিথ্যে কথা বলেছ আমাকে?’
‘ঠিক মিথ্যে নয়, কথা গোপন করা। ও আজবনগর থেকে এসেছে ঠিকই, কিন্তু ওর নাম নোয়া নয়, ও হচ্ছে জিয়ান’
ধপ করে বসে পড়ে জারা ‘জিয়ান! ইচ্ছাময়ীর জিয়ান! সে তো প্রায় পাঁচশো বছর আগের কথা! আমার মাথা ঝিমঝিম করছে’
সারা জারার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন ‘ নোয়া শুধু পৃথিবীর সীমান্ত পেরিয়ে এখানে আসেনি, ও সময় সীমান্ত পেরিয়েও এসেছে, আর এসেছে শুধু তোর জন্যে। ও খবর পেয়েছিল, ইচ্ছাময়ীর উত্তরনারী এই আর্থেনিয়ায় থাকে। যে ভালবাসা সে সেই সময় গ্রহণ করতে অপারগ ছিল, সেটা দুহাত পেতে নিতেই ও এসেছে, ওকে ফেরাস না জারা’
জারা অস্ফুটে বলে ‘তার মানে ও আমার চেয়ে ৫০০ বছরের বড়?’
‘দূর বোকা মেয়ে! ভালবাসার জন্যে সময়ের পারাপার করতে পারে যারা, তাদের বয়স এক জায়গায় থেমে থাকে, জানিস না বুঝি?’
নোয়া থুড়ি জিয়ানকে নিয়ে এরো স্কুটিতে উঠে মাকে হাত নাড়ে জারা। সারা দেখেন তাঁর শূন্যকানন ভরে উঠেছে ইচ্ছাময়ীর ফুলে।

সমাপ্ত

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।