সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে দীপান্বিতা বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ১৩)

ঢেপ্সির প্রেমকাহিনী

ত্রয়োদশভাগ

সেদিন কলেজে ওই ঘটনার পর থেকে ঢেপ্সীর সঙ্গে যোগাযোগ তলানীতে ঠেকেছিল। মাঝে কেটে গেছে পাঁচ বছর। আমি মাস্টার্স কমপ্লিট করে একটা স্কুলে জয়েন করেছিলাম। আমার সঙ্গে অনিরুদ্ধর সম্পর্কটা বাড়ি থেকে মেনে নেয়নি। রোজ‌ই ঝামেলা হতো। বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য জেরাজুরি করছিল তাই আমরা বাড়ির অমতে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করি। এখন আমি অনির সাথে ব্যারাকপুরে থাকি। ওখানেই একটি বেসরকারি স্কুলে পুনরায় জয়েন করি কারণ আগের স্কুলের চাকরিটা বিয়ের পর ছেড়ে দিতে হয়েছিল‌‌। মা বাবা আমাদের কখনো মেনে নেয়নি। দাদু মাঝেমধ্যে ফোন করতো। দাদুর থেকেই বাড়ির খবরাখবর পেতাম। ভীষন মন কেমন করে বাড়ির জন্য। মন প্রচন্ড খারাপ করলে গল্পের ব‌ই পড়ি। অনি সারাদিন অফিসে থাকে। স্কুল থেকে ফিরে আমি পুরো একা। একেক করে মাথায় কত কথা ভিড় করে রিমা, ঢেপ্সী সকলের কথা। ওদের সঙ্গে কতদিন যোগাযোগ নেই। ভীষন মিস করি সবথেকে বেশি মিস করি ঢেপ্সীকে। কোনো কোনো দিন এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি।
জুলাই মাসের এক রবিবারের দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে শুয়েছি, সবেমাত্র তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা এসেছে হঠাৎ দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ। এই অসময়ে কে আবার এলো ভেবেই বিরক্ত লাগছিল। দরজা খুলে আমি তাজ্জব বনে গেছি। আমার মা বাবা দাঁড়িয়ে সামনে। ওদের ভেতরে নিয়ে এলাম। অনির সেদিন ডিউটি অফ ছিল তাই বাড়িতেই ছিলো। মা বাবা আমাদের সঙ্গে নিজে এসে দেখা করবে আমি ভাবতেই পারিনি। দুই তরফ থেকেই বরফ গলে সম্পর্ক জল হয়ে গেল। অনিকে বাবা মা মেনে নিয়েছে ভেবেই আমার দারুন আনন্দ হচ্ছে। রাতে মা আমার কাছে শুয়েছিল। মা বেটিতে অনেক গল্প হচ্ছিল। মাকে জিজ্ঞেস করলাম “মা ঢেপ্সী কেমন আছে?” মা বললো “ওর বিয়ে হয়ে গেছে অজয়ের সঙ্গে। তবে ছেলেটা ভীষণ অত্যাচার করে মেয়েটার প্রতি।” আমি বললাম “আর ওদের ব্যবসাটা?” মা বললো “বব্যবসাটা বৌদি নিজেই দেখাশোনা করে। ঢেপ্সীর বাচ্চা হবে শুনেছি।”

মা বাবা ফিরে গেছে। আমরাও নিজেদের কাজ নিয়েই ব্যস্ত। সেদিন ঢেপ্সীর বাচ্চা হবে শুনে আমার কেন জানি না মনটা খারাপ হয়ে গেছিল। কারণ কিছুদিন আগে আমার প্রথম বাচ্চাটা মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। একদিন স্কুলে ক্লাস থেকে স্টাফরুমে ফিরতেই আমার সহকর্মী বললেন ” তোমাকে কে বহুবার ফোন করেছিল। ” আমি তাড়াতাড়ি করে কললিস্ট চেক করে দেখি আমার মা ফোন করেছিল। মাকে কল ব্যাক করতেই মা বললো “আজ‌ ম্যানেজ করে একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আয়।” আমি একটু অবাক হলাম কারন মা হঠাৎ করে ব্যারাকপুর কেন কারণটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। বাড়ি ফিরে দেখি মায়ের সঙ্গে ঢেপ্সীও আছে। চোখমুখ বসে গেছে। চোখের নিচে কালশিটে দাগ। ভয়ে কুঁকড়ে আছে এরকম অবস্থা। আমি মাকে জিজ্ঞেস করার আগেই মা বললো ” বান্ধবীকে বাঁচা। ওই ছেলেটা মেয়েটাকে খুন করে ফেলবে। শুধু তাই নয় পেটের বাচ্চাটাকেও বাঁচতে দেবে না।” আমি ঢেপ্সীর হাতদুটো ধরে বললাম “কাঁদিস না। ভয় নেই, তুই এখানেই থাক। তোর কিছু হবে না।”

অনিরুদ্ধ অফিস থেকে বাড়ি এলে সবটা খুলে বললাম। ও আমার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করলো না। মা ফিরে গেলো, ঢেপ্সী রয়ে গেল আমাদের সঙ্গে। ওর চিকিৎসা শুরু হলো। কারণ গর্ভবতী হ‌ওয়া সত্ত্বেও এতদিন অজয় ডাক্তার দেখাতে দেয়নি ‌কারণ বাচ্চাটাকে খুন করে ফেলা ছিল ওর উদ্দেশ্য। ডাক্তার ঢেপ্সীকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেবললেন অবস্থা সিরিয়াস কারণ ওর চরম সুগার আছে। ওকে প্রচন্ড সাবধানে রাখতে হবে সাথে হাই প্রেসার‌ও আছে। ভালোমতো কন্ট্রোলে রাখতে হবে নাতো সমস্যা হয়ে যাবে। আমি আর অনি সাধ্যমত দেখাশোনা করতে শুরু করলাম। আমার মা আর কাকিমা মাঝে মাঝে এসে দেখে যায়। আমি একদিন ঢেপ্সীকে অজয়ের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উত্তরে বলেছিল ওকে বিয়ে করাটাই আমার জীবনের ঐতিহাসিক ভুল। আমার বাচ্চাটাকে জানোয়ারটা মেরে ফেলবে রে। তুই যদি না থাকতিস তাহলে আমার বাচ্চাটা হয়তো বাঁচতোই না আর আমিও হয়তো বাঁচতাম না। আমি যদি মরে যায় কোন ভাবে আমার বাচ্চাটাকে তুই দেখিস।
দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছিল। ঢেপ্সী আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠছিল। ট্রমা ব্যাপারটা ধীরে ধীরে কাটছিল বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু বিধাতা মনে হয় অলক্ষ্যে থেকে হাসছিল তখন। একদিন সন্ধ্যাবেলায় ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরছি দুজনে হঠাৎ মূর্তিমান অজয় হাজির রাস্তায়। ঢেপ্সীকে অতর্কিতে আঘাত করে বসলো। ঢেপ্সীর পেটে এলোপাতাড়ি ঘুষি চালাতে লাগলো। আমি আটকাতে গেলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। ল্যাম্পপোস্টে সজোরে ধাক্কা খেয়ে কপাল ফেটে গড়গড় করে রক্ত বেরোতো শুরু করলো। আশেপাশের দোকান থেকে লোকজন ছুটে এসে অজয়কে আটকায়। ঢেপ্সী মাটিতে লুটিয়ে তখন কাতরাচ্ছে। অঝর ধারায় ব্লিডিং শুরু হয়েছে। আমি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছি। আমার কপাল ফেটে গেছে সে চিন্তার থেকেও ঢেপ্সীকে নিয়ে আমি বেশি চিন্তিত। সবাই মিলে ধরে ধরে গাড়িতে করে আমাদের দুজনকে নিয়ে কাছাকাছি নার্সিংহোমে ভর্তি করলেন।
আমার কপালে আটটা সেলাই পড়েছে। ডাক্তার জানালেন ঢেপ্সীর অবস্থা সিরিয়াস। ভীষন জোর আঘাত লেগেছে পেটে। আমি নিজেকে একটু সামলে অনিরুদ্ধকে ফোন করলাম। তখন ভীড়ের মধ্যে থেকে অজয় কীভাবে চোখের পলকে ভ্যানিশ হয়ে গেল তাকে আর খুঁজেই পাওয়া গেল না। অনিরুদ্ধ সব শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। আমি আমার মা, বাবা আর ঢেপ্সীর মাকে ফোন করে সেই রাতেই ব্যারাকপুর চলে আসতে বললাম। ওরা ফোন পাওয়ার একঘন্টার মধ্যেই ওখান থেকে বেরিয়ে পড়েছে। আমি থানায় গিয়ে অজয়ের নামে অভিযোগ দাখিল করে কেস করে এলাম। অনিরুদ্ধ নিজে যেহেতু পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে কাটোয়া থানাকেও অজয়ের ব্যাপারটা ইনফর্ম করে দিলো। সেই রাতেই কাকিমা ওঃ আমার বাবা মা চলে এলো। কাকিমা আমাকে দেখেই কাঁদতে শুরু করেছে একটাই কথা বারবার বলছে আমার মেয়েটাকে বাঁচা, ও জানোয়ারের বাচ্চা মরে মরুক, আমার মেয়েটাকে বাঁচা। আমি অনি দু’জনেই ওদের তিনজনকে শান্ত করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। সারারাত আমরা স্বামী স্ত্রী হসপিটালে। ডাক্তার জানিয়েছেন ঢেপ্সীর অবস্থা স্থিতিশীল, ওনারা আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন মা বাচ্চা দুজনকে বাঁচানোর। ভোরবেলায় ডাক্তার জানালেন সরি ওনারা শেষ রক্ষা করতে পারেনি। অতিরিক্ত ব্লিডিং হ‌ওয়ায় ঢেপ্সী মারা গেছে। বাচ্চাটাকে প্রিম্যাচিওর ডেলিভার করে বের করে নেওয়া গেলেও ঢেপ্সীর শেষ রক্ষা হয়নি। কিন্তু বাচ্চার অবস্থাও সিরিয়াস। ওর রিতিমত ভালো ট্রিটমেন্ট দরকার তাই হসপিটালেই রাখতে হবে।
এই খবরটা শোনার পর কাকিমাকে আর কোনোভাবেই আটকে রাখা যাচ্ছিল না। পাগলের মতো কেঁদে চলেছে। ঢেপ্সীর দেহ সৎকার করে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন ঘড়িতে রাত দুটো। ঢেপ্সীর পরোলৌকিক কাজকর্ম আমি আর অনিই করলাম। টানা একমাস যমে মানুষে টানাটানি করে বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এলাম। কিন্তু ঢেপ্সীর মা কোনোমতেই ওই বাচ্চাকে সাথে নিতে নারাজ। আমাকে বললো কোনো অনাথ আশ্রমে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে কিন্তু আমার মন কিছুতেই এই কাজে সায় দিলো না। এই নিয়ে বাড়িতে দোলাচল চলছে বাচ্চাটার এখন কী হবে। এই কদিনে বাচ্চাটার ওপর আমার মায়া জন্মে গেছে। কিছুতেই কাছছাড়া করতে ইচ্ছে করছে না ওই একরত্তি শিশুটাকে আমি নিজের মেয়ে বলেই ভাবতে শুরু করেছি। একদিন সন্ধ্যায় অনি হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এসে আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করতে শুরু করলো। আমরা সকলেই ছুটে ড্রয়িংরুমে পৌঁছালাম। অনি বললো কাটোয়া থানার পুলিশ ইনফর্ম করেছেন অজয় মারা গেছে। পুলিশ ওকে অ্যারেস্ট করার জন্য ধাওয়া করেছিল। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে রেকলেসলি বাইক চালিয়ে পালাচ্ছিল সেই সময় উল্টো দিক থেকে ধেয়ে আসা একটা মালবাহী লরির সাথে প্রচন্ড জোর ধাক্কা লাগে এবং ওখানেই স্পট ডেড। খবরটা শুনে ঢেপ্সীর মা কাঁদতে কাঁদতে বললো ” আপদ বিদায় হয়েছে। জানোয়ার আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলে সুখে শান্তিতে ঘুরে বেড়াবে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। ভগবান স্বকানে আমার কথা শুনেছে। এবার ওই রক্তবীজের ঝাড়টাকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে এলেই ষোলোকলা পূর্ণ হবে।” আমি চিৎকার করে উঠলাম “নাহ! এই বাচ্চা আমি কিছুতেই অন্য কোথাও যেতে দেবো না। ও আমার সন্তান।” আমি বুকে আঁকড়ে ধরে দৌড়ে ঘরে চলে এলাম। কিছুক্ষন পর অনি আমার পাশে গিয়ে বসলো। বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে বললো ” ও শুধু তোমার একার মেয়ে না, আমার ও মেয়ে। আমার মেয়েকে একটু আদর করতে দাও।” মেয়েকে কোলে নিয়ে আমরা দুজনে নীচে নেমে এলাম, কাকিমাকে জানালাম এই বাচ্চা আমাদের দুজনের। ও আমাদের কাছেই থাকবে কোনো অনাথ আশ্রমে না।

সমাপ্ত

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।