• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে দীপান্বিতা বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৬)

ঢেপ্সির প্রেমকাহিনী

ষষ্ঠ ভাগ

কলেজের সাইকেল স্ট্যান্ড থেকে সাইকেলটা নিয়ে সবেমাত্র প্যাডেলে পা দিয়েছি এমন সময় মা ফোন করলো। ভীষণ ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করল ‘তুই কোথায়?’
আমি বললাম ‘এই তো কলেজ থেকে বেরোচ্ছি।’ বলল ‘তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়।’ আমি বুঝতে পারলাম বাড়িতে কিছু একটা গন্ডোগোল হয়েছে কিন্তু বাড়িতে এসে যে ঘটনা আমার সঙ্গে ঘটল তার জন্য আমি কোন ভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না।
বাড়ি ফিরতেই উঠোনে দাঁড়িয়েই মা আমাকে এক চড় মারলো। আমি অবাক, বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম ‘মারলে কেন?’ মা বললো কলেজে পড়াশোনার জন্য পাঠিয়েছি, নোংরামির জন্য নয়। তোমার জন্য ঢেপ্সির মা আজ বাড়ি বয়ে এসে অপমান করে গেছে। তোমাকে কি আমরা কুশিক্ষা দিয়ে মানুষ করে তুলেছি?
আমি এবার বুঝতে পারলাম ঘটনাটা। ঢেপ্সির ব্যাপারটা তবে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। একবার ভাবলাম আজ কলেজে যে ঘটনাটা ঘটেছৈ সেটা সম্পূর্ণ মাকে বলে দিই। কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলাম যে মা এমনিতেই রেগে আছে, এই ঘটনাটা বললে পরিস্থিতি হয়তো হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই বুদ্ধিমানের মতো চেপে গেলাম। মাকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘তোমাকে ঢেপ্সির মা ঠিক কী কী বলেছ?’
মা বললো ঢেপ্সির মা ঘন্টাখানেক আগে আমাদের বাড়িতে এসেছিল। ওনার অভিযোগ ঢেপ্সি ইদানিং কোনো একটি ছেলের সঙ্গে জড়িয়েছে। যেটা নাকি আমি সম্পূর্ণই জানি কিন্তু জানা সত্বেও আমি কাকীমাকে কোনো কিছুই বলিনি। ঢেপ্সি বাড়িতে ঠিকমতো পড়াশোনা কিছুই করেনা। কারণে-অকারণে বাড়িতে মেজাজ দেখায় দিনরাত ছেলেটার সঙ্গে কথাবার্তা হয়, ওদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি এই সমস্ত চলতেই থাকে। আমি ঢেপ্সির সঙ্গে এতদিন মেলামেশা করেছি ভালো ব্যবহার করেছি সেগুলো সম্পূর্ণটাই আমার নাটক। ঢেপ্সি পড়াশোনায় ভালো বলে আমি এতদিন ওকে ব্যবহার করেছি। আসলে আমি ওর ভালো বন্ধুই না। ওর মা সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত যে ছেলেটির সঙ্গে যোগাযোগের পেছনে আমারই হাত আছে কারণ তার মেয়ে এরকম কোন কিছু করতেই পারেনা। তার মেয়ে জীবনে কখনো তাদের কথার অবাধ্য হয়নি সেই মেয়ে কি করে কারো সঙ্গে প্রেম করতে পারে!? ওর মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস আমিই এই সমস্ত কিছু করিয়েছি। সম্পূর্ণটাই আমার চক্রান্ত।আমি যেন ভবিষ্যতে ঢেপ্সির সঙ্গে কোনোদিন যোগাযোগ না করি এবং আজকের পর থেকে ওদের বাড়ির সঙ্গে আমাদের বাড়ির সমস্ত রকম যোগাযোগ বন্ধ। আমি যেন ঢেপ্সির জীবন থেকে চিরদিনের মত সরে যায়।
মাকে খুব শান্ত মাথায় বুঝিয়ে বলি আমি এসবের সঙ্গে জড়িত নেই। রিমাকে ফোন করে মায়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিই। তারপর মা কিছুটা শান্ত হয়। আমাকে দিয়ে দিব্যি করিয়ে নেয় আমি যেন যোগাযোগ বন্ধ রাখি। সেদিন কলেজের ঘটনার পর থেকে আমার সঙ্গে ঢেপ্সির আর দেখাসাক্ষাৎ বা যোগাযোগ ছিল না। পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কারণ ছমাস পর থার্ড ইয়ার পরীক্ষা ছিল। বিশাল সিলেবাস তাই চাপ‌ও বেশি। মাঝে একদিন রিমা ফোন করেছিল। একথা সেকথায় বললো ঢেপ্সি অসুস্থ। ওকে ডাক্তার অনেকগুলো টেস্ট দিয়েছে। খুব সম্ভবত ওর থাইরয়েড হয়েছে। এই নিয়ে অজয়ের সঙ্গে ঢেপ্সির একটু গন্ডোগোল‌ও হয়েছে। আমি রিমার সামনে এমন ভাব করলাম যেন ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চাইছি কিন্তু আমার খুব খটকা লাগলো ঢেপ্সির অসুস্থ হ‌ওয়া নিয়ে অজয় কেন ঝামেলা করবে?
তারপর আর খোঁজখবর নিইনি। রিমাও আমাকে কিছু বলেনি কারণ ও জানে ঢেপ্সির জন্য আমাকে কতটা হ্যারাসমেন্ট সহ্য করতে হয়েছে। ইতিমধ্যে রেজাল্ট আউট হলো। সবাইকে ফোন করে রেজাল্টের খোঁজ নিচ্ছি অবশ্য‌ই ঢেপ্সি বাদে। কিন্তু অঙ্কিতা বললো আমাদের বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে কম নম্বর পেয়েছে অপরাজিতা, মাত্র ৫৬%। আমি বলে উঠলাম ‘অসম্ভব! আমাদের মধ্যে সবথেকে বেশি ট্যালেন্টেড এবং স্টুডিয়াস ঢেপ্সি।’ অঙ্কিতা একটু খোঁচা দিয়েই কথাটা বললো আমাকে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। বললো ‘ তোর বেস্ট ফ্রেন্ডের নম্বর তুই জানিস না!’ আমি বললাম না জানি না। আমাদের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ। তুই এবার ফোনটা রাখ বলে দুম করে ফোনটা কেটে দিলাম আমি।
আমি ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলাম বলে বাড়ির সকলেই খুব খুশি হয়েছিল। আমার বাবার একটা অভ্যাস ছিল প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় গঙ্গার ধারে চা খেতে যাওয়া। বাবা আর তার কয়েকজন বন্ধুর একটা গ্রুপ ছিল। সবাই একসাথে ঘন্টাখানেক আড্ডা দিতো, তারপর চা সিগারেট খেয়ে সাতটার দিকে বাড়ি ফিরে যেতো। সেদিন রাত সাড়ে আটটা বেজে গেলো তবুও বাবা বাড়ি ফিরলো না। আমরা সবাই চিন্তা করছি বাড়িতে। বাবা বিকালে বেরিয়ে যাওয়ার আগে মাকে বলেছিল আমার রেজাল্টে খুশি হয়ে আজ ডিনারে নিজে হাতে ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন রেজালা রান্না করে সকলকে খাওয়াবে। বাবাকে দেখতে দাদু সাইকেলটা নিয়ে রাস্তার মোড় সবে ক্রশ করেছে এমন সময় দেখে বাবার বন্ধুরা ধরাধরি করে বাবাকে বাড়ি নিয়ে আসছে। বাবার মাথায় ব্যান্ডেজ। দাদু বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। বাবাকে ওই অবস্থায় দেখে স্বাভাবিকভাবেই সকলে অবাক হয়ে গেছি। বাবা সোফায় বসে আমাকে বলল এদিকে শোন।

আমি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম। কাছে যেতেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলাম। বাবা বললো পাশে বস। আমি কিছু বলার আগেই বাবা বল উঠলো ‘ আজ বিকালে গঙ্গার ধারে আমরা যখন আড্ডা দিচ্ছিলাম তখন তোর ওই বন্ধু ঢেপ্সির বাবা ওখানে যায়। উনি মাঝেমধ্যে আসেন। আজকেও এসেছিলেন। কিন্তু আজ লক্ষ্য করলাম ওনার মেজাজটা কোনো কারনে গরম হয়ে আছে। সব কথায় হ্যাঁ, না করে উত্তর দিচ্ছিলেন। আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম রোজ যেরকমকরে থাকি রাজনীতি, সিনেমা, লাইফস্টাইল পড়াশোনা। একথা সেকথায় তোর রবিন কাকু বলে উঠল মেয়ের তো রেজাল্ট বেরিয়েছে। কত পার্সেন্ট পেলো মেয়ে? আমি বেশ আনন্দ করেই বললাম তুই ফাস্ট ক্লাস পেয়েছিস। যেই না এই কথাটা বলেছি ঢেপ্সির বাবা রাগে ফেটে পরলো। আমাকে যা নয় তাই বলতে শুরু করলো। সকলের সামনে তোকে দোষারোপ করে বলল ওর মেয়ে রে কম নম্বর পেয়েছে এর জন্য নাকি তুই দায়ী। তুইই ওর মেয়ের মাথাটা নষ্ট করে দিয়েছিস। ওর মেয়ে যাতে পড়াশোনায় খারাপ হয়ে যায় তোর থেকে কম নাম্বার পায় সেজন্য তুই বিপথে চালিত করেছিস। আমি কিছুতেই মানতে রাজি ছিলাম না আমা মেয়ের সম্বন্ধে এসব কথা। আমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি লেগে যায়। ঢেপ্সির বাবা তোকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করে। আমি বারবার বলতে থাকি আপনার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে আমার মেয়ে এরকম কিছু করতেই পারে না। কিন্তু উনি সে কথা কোনোমতেই কানে তোলেন না। হঠাৎ করে সামনের চায়ের দোকান থেকে একটা লাঠি নিয়ে আমাকে মারতে আসে আমি নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করি এবং ছুটে পালিয়ে যেতে চাই। বাকিরা সবাই ওনাকে আটকাতে শুরু করে লাঠিটা কেড়ে নেয়। উনি তখন একটা ইঁট আমার মাথা লক্ষ্য করে ছুড়ে মারে এবং আমার মাথা ফেটে যায়। এবার তুই সত্যি করে বল তো আসল ঘটনাটা কি? আমিতো কিছুই জানিনা। উনি হঠাৎ করে আমার সঙ্গে কেন এমন ব্যবহার করলো?’

আমি সবে বলতে শুরু করেছি মা আমাকে দুম করে চড় থাপ্পর মারতে শুরু করলো। দোষারোপ করতে লাগলো। বারবার বলতে থাকলো ‘তোর জন্য মান-সম্মান ধূলোয় মিশিয়ে গেল। ছিঃ ছিঃ তুই এমন মেয়ে! কী কুক্ষণে তোকে জন্ম দিয়েছিলাম!? আমার কপালেই তোর মত মেয়ে জুটেছে। তোর মতো মেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। বাবা রেগে গেলো এই সমস্ত কথাবার্তা শুনে। মাকে উদ্দেশ্য করে বললো ‘তুমি থামো। এখানে বাইরের লোকজন আছে আর আমি সমস্ত ঘটনাটা আগে শুনবো তারপর সিদ্ধান্তে আসবো। তার আগে পর্যন্ত তুমি আর একটা কথাও বলবে না।’ বাবার সঙ্গে মায়ের তর্কাতর্কি লেগে গেলো। এমন সময় ঢেপ্সির কাকা আমাদের বাড়িতে হাজির। বাবাকে বলল ‘দাদা আপনি কিছু মনে করবেন না। আমার দাদার ব্যবহারে আমি ভীষণ লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী ।আপনি ক্ষমা করে দিন। দাদার মাথা ঠিক নেই তাই আপনার সঙ্গে এই দুর্ব্যবহার করেছে। আমি ঢেপ্সির কাকিমার কাছ থেকে সফটা শুনেছি। এখানে আপনার মেয়ের কোন দোষ নেই। বৌদি দাদাকে আপনার মেয়ের সম্বন্ধে উল্টাপাল্টা বলে উত্তপ্ত করেছে। আপনার মেয়ে সত্যিই নিরাপরাধ। এই সমস্ত কিছুর জন্য আমার ভাইঝি নিজেই দায়ী। আপনার মেয়ের এখানে সত্যিই কোনো হাত নেই। আমি বলছি আপনারা দয়া করে ওর সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করবেন না।’ এই কথা শুনে মা একটু শান্ত হলো। তারপর বাবাকে বলতে শুরু করলো ‘শোনো আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি পড়াশোনা করিয়ে আর কোন দরকার নেই। গ্রাজুয়েশন শেষ হয়ে যাবে, তুমি ছেলে দেখতে শুরু করো। ওর বিয়ে দিয়ে দেবে ব্যাস অনেক পড়াশোনা হয়েছে পড়াশোনা করতে গিয়েই যত বিপত্তি। পরিবারের মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি। কী হবে এমন পড়াশোনা করে!? থাক, বিয়ে করে ঘর সংসার করুক। মেয়ে হয়ে জন্মেছে একদিন তো সেসব করতেই হবে।’
এই সমস্ত কিছু শুনে তো আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম কাঁদতে শুরু করে দিলাম। দাদু আমাকে ইশারায় চুপ করতে বললো তারপর দাদু মা-বাবাকে দু’জনকেই চুপ করিয়ে দিয়ে বললো এখন‌ই কোনো সিদ্ধান্ত নয়। ঠান্ডা মাথায় পরে ভাবনা চিন্তা করা যাবে। অনেক রাত হলো চলো খাওয়া দাওয়া করি। বাবার বন্ধুরাও মাকে বললো বৌদি রাগের মাথায় মেয়েটার বিয়ে দেবেন না। বিয়ে সারাজীবনের ব্যাপার। একটু ভুলচুক হয়ে গেলে আপনার আফসোসের অন্ত থাকবে না।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।