পাষাণ কন্যা অহল্যা আইডি থেকে অনিরুদ্ধ অধিকারীকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিলাম। রাতের দিকে ফেসবুক অন করে দেখলাম অনিরুদ্ধ অ্যাকসেপ্ট করে কতগুলো মেসেজ করেছে। অনিরুদ্ধ কে তখনও বলিনি স্বনামে আমার একটা অ্যাকাউন্ট আছে যেটা এখন ডিঅ্যাকটিভ রয়েছে। অনিরুদ্ধর ওয়াল চেক করতে করতে অজয়কে লিস্টে পেলাম। দু’জনের মধ্যে কমেন্টে বেশ হাসিঠাট্টা চলে বুঝতে পারলাম। মনটা ভারী হয়ে গেলো। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো অনিরুদ্ধ অজয়ের বন্ধু নয় তো?? আমাদের দেখা হওয়াটা প্রিপ্ল্যানড নয় তো?? আমার একটা ভীষন বাজে স্বভাব আছে আমি সব ব্যাপারে একটু বেশিই চিন্তা ভাবনা করি। আর নিজের মন গুমরে মরি। সাথে মেজাজ খারাপ আর পড়াশোনা লাটে। নিজের মনেই বললাম অনিরুদ্ধর থেকে যতক্ষণ না ব্যাপারটা জানছি শান্তি নেই। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো মাত্র একদিনের পরিচয়েই ছেলেটাকে এসব বলা ঠিক হবে ?? এসব ভাবতে ভাবতে কল করলাম অনিরুদ্ধর ফোনে। কল ওয়েটিং দেখালো। পরপর তিনবার ফোন করলাম কিন্তু কল ওয়েটিং। ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমিয়ে পড়লাম। কারণ শত চেষ্টাতেও আজ পড়াশোনায় মন বসবে না বোঝা যাচ্ছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম অনিরুদ্ধ হোয়াটসঅ্যাপে বিশাল বিশাল দুটো মেসেজ করেছে যেখানে ব্যাখা করেছে কেন ফোন করতে পারেনি। আমি ওই মেসেজ দুটো পড়ে ফিক করে হেসে ফেললাম। ফ্রেশ হয়ে পড়তে যাচ্ছি ঢেপ্সীর সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়ে গেল। রিমার সঙ্গে গল্প করছিল। আমাকে দেখা মাত্র তার চোখে মুখে একটা তীব্র ক্ষোভের প্রকাশ ফুটে উঠেছে লক্ষ্য করলাম। পরিস্থিতি হালকা করার জন্য আমি রিমাকে বললাম আমি এগিয়ে যাচ্ছি তোর জায়গা রাখবো তুই সময় মতো চলে আসিস। স্যার কিন্তু আজ তাড়াতাড়ি পড়াতে শুরু করবে। আস্তে আস্তে শুনলাম ঢেপ্সী রিমাকে বলছে যারে যা তোর বেষ্টি তোকে ডাক পাঠিয়েছে, তুই কি আর আমার কাছে থাকবি? রিমা ব্যাচে এসে গজগজ করতে করতে আমাকে বললো “তোকে কি ঢেপ্সীর সামনে কথাগুলো আমাকে বলতেই হতো? তুই কি চুপচাপ আসতে পারিস না ? তোর জানিস তো বহুৎ দোষ আছে। ও তোকে যখন এতটাই ঘেন্না করে তোর তখন ওর সঙ্গে এত কথা বলার জন্য মন ছটফট করে কেন?” আমি বললাম “নারে আমার ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য কোনো রকম কোনো ইচ্ছা আর আসে না।” রিমা খেঁকিয়ে উঠলো “বলিস না তো আমি। খুব ভাল করেই জানি তুই এখনো পর্যন্ত ওর কিভাবে ভালো চাস। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ অজয় মোটেও ভালো ছেলে না। জঘন্য ছেলে যত রকম একজন মানুষের মধ্যে খারাপ গুন থাকতে হয় অজয় এর মধ্যে সব আছে। আর ঢেপ্সী ভাবে যে অজয়ের ওর থেকে তোকে বেশি পছন্দ। তাই অজয় ওকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলে। কিন্তু তুই যে এসবের মধ্যে নেই সেটা ও বিশ্বাসই করতে চায় না। তাই ঢেপ্সীর তোর প্রতি এত রাগ।” আমি গা ছাড়া ভাব নিয়ে বললাম “ছাড়। ভালো লাগছে না।”
পড়ে বাড়ি ফেরার সময় অনিরুদ্ধ ফোন করলো। ওর সঙ্গে গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরে এলাম। অনিরুদ্ধ কলেজ আসতে বললো। আমি নাহু নাহু করলেও শেষ পর্যন্ত বললাম যাবো। আমি বুঝতে পারছিলাম ছেলেটা হেসে হেসে কথা বললে আমার বেশ ভালোই লাগছে কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো অনিরুদ্ধ অধিকারী অজয়ের বন্ধু নয় তো? ঠাকুরের কাছে মনে মনে প্রার্থনা করলাম আশঙ্কা যেন সত্যি না হয়। রেডি হয়ে কলেজ গেলাম। অনিরুদ্ধকে ফোন করলাম। জবাব দিলো লাইব্রেরিতে এসো। লাইব্রেরী শুনেই সেদিনের ঘটনাটা মনে পড়ে গেলো। লাইব্রেরী যেতে যেতে দেখলাম দোতলার ফাঁকা একটা ঘরে অজয় আর একটি মেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে বসে গল্প করছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম নাহ্ ওটা তো ঢেপ্সী নয়। ব্যাপারটা ভালো করে বোঝার জন্য ওড়না দিয়ে মুখটা বাঁধলাম। ফোন নিয়ে খুটখাট করতে করতে ঘরে ঢুকে যেতেই ওরা আমার আচমকা আগমনে চমকে উঠলো। ওরা একে অপরের সাথে আলিঙ্গনরত অবস্থায় ছিল, দুজন দুদিকে ছিটকে বেরিয়ে গেল। আমি অতিদ্রুততার সঙ্গে সরি বলে বেরিয়ে এলাম।
তারপর লাইব্রেরীতে অনিরুদ্ধর কাছে গেলাম। কিন্তু মনে মনে আশঙ্কা হচ্ছিল অজয় পিছু নেবে না তো? যদি টের পায় আমিই ছিলাম তবে তো তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে দেবে। অনিরুদ্ধকে বললাম কলেজে ভালো লাগছে না চলো অজয়ের বাঁধে গাছের ছায়ায় বসে বসে গল্প করবো। অনিরুদ্ধ দ্বিরুক্তি করলো না রাজি হয়ে গেল। দুজনে চলে গেলাম সাইকেল চালাতে চালাতে। এটাসেটা অনেক গল্পগুজব হলো। অনিরুদ্ধ এমএসি পড়ছে ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। ওর পচ্ছন্দের সঙ্গে বলা ভালো চিন্তা ভাবনার সঙ্গে অনেক কিছুই মিলে যায় আমার। ওর স্বপ্ন পুলিশ হওয়া। এসআই পদের জন্য পরীক্ষাটা দিয়েছে। আমাকে অনেক কিছু সাজেশন দিলো পড়াশোনার ব্যাপারে। ছেলেটা ভীষণ ফিটনেস ফ্রিক। জিম, বডি বিল্ডিং এসব নিয়ে আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল। তারপর হঠাৎ কী খেয়াল হলো ওর ফোনের গ্যালারি থেকে কিছু ছবি দেখাচ্ছিল যেখানে বেশ কয়েকটা ছবিতে দেখলাম অজয় আর অনিরুদ্ধ একসাথে। আমি আর কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করে ফেললাম এই ছেলেটা তোমার কে হয়? অনিরুদ্ধ বললো “আরেহ এটা তো অজয়, আমার পরিচিত। একসাথে জিম করি রোজ। তুমি ওকে কীভাবে চিনলে?” আমি পরিস্থিতি হালকা করার জন্য বললাম ” না না চিনি না তো। এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। অনিরুদ্ধ হাসতে হাসতে বলল আমার বন্ধুর কিন্তু একটা নয় অলরেডি চার-পাঁচটা গার্লফ্রেন্ড আছে। আমি অবাক হয়ে বললাম মানে? সে বললো “মানেটা তুমি বুঝবে না। এবার তোমার যদি ওকে পছন্দ হয় সেটা তোমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার কিন্তু ভেবে দেখো আমার মত একটা ছেলেকে বাদ দিয়ে তুমি কি ওর দিকে ঝুঁকবে? আমি রাগ দেখিয়ে বললাম “ইয়ার্কি মেরো না তো। সিরিয়াসলি বলো ওই ছেলেটা কেমন?” অনিরুদ্ধ ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলো ” কী ব্যাপার বল তো, তোমার একে নিয়ে এতো আগ্রহ কেন?” আমি “কিছু না আজ বাড়ি চলো পরে বলবো” বলে ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম।
বাড়ি ফিরে পড়তে বসলাম। ব্যাগ খুলতেই দেখলাম একটা চিঠি যার প্রতি ছত্রে ছত্রে রয়েছে আমার স্তুতি। বুঝতেই পারলাম এটা কার কাজ। কিন্তু মনটা খচখচ করছিল তাই চিঠিটা সেভাবে পাত্তা দিলাম না। ফোন সাইলেন্ট মোড করে পড়তে শুরু করলাম। পড়া শেষ করে যখন ফোন হাতে নিলাম দেখলাম অনিরুদ্ধর নম্বর থেকে পঁয়ত্রিশ টা মিসড কল। পাত্তা দিলাম না সেভাবে। ফোন চার্জে বসিয়ে সিনেমা দেখতে শুরু করলাম টিভিতে। বিকাল বেলায় বাড়িতে মায়ের এক বান্ধবী এসেছিল। মাকে তার কাছে আমার গুণের বর্ণনা দিতে শুনলাম। গভীর সন্দেহ হলো মা নিশ্চয় কিছু ফন্দি এঁটেছে। সেই বান্ধবী যেতেই মাকে চেপে ধরলাম। মা সটান বলে দিলো “তোমার বিয়ে দেওয়া হবে।” আমি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলাম কিন্তু সেইসবে মা বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করলো না। আমি রাগে গজগজ করতে করতে ফোন আর হেডফোন নিয়ে ছাদে চলে গেলাম। ইউটিউব থেকে গান শুনছিলাম। রিমা ফোন করলো ফোন ধরতেই চাপা গলায় বললো “খবর শুনেছিস অজয় কলেজে ভোটে দাঁড়িয়েছে?” “জানি না আগ্রহ নেই ফোন রাখ এখন” বলেই দুম করে ফোনটা কেটে দিলাম।
ভীষন কান্না পাচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম না চাইতেও চোখ ভিজে যাচ্ছে। মায়ের কথাগুলো বুকে বিঁধেছে তীব্রভাবে। একেক করে মনে পড়ে যাচ্ছিল আমার প্রথম প্রেমের স্মৃতি। রোহিতের সঙ্গে সম্পর্কটা বেশ ভালোই ছিল। আসলে ছোট বয়সের প্রেমে আবেগের বাড়বাড়ন্ত একটু বেশিই থাকে। রোহিতের সঙ্গে চার বছরে হাতে গুণে পাঁচ বার দেখা হয়েছিল আমার সাথে। বেশ হাসিখুশি ছিলাম আমরা। লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপ ছিল আমাদের। দুজনেই ছটফট করতাম কিন্তু দেখা করার উপায় নেই। ওর মামারবাড়ী ছিল আমার বাড়ির পাশেই। সেখান থেকেই পরিচয়ের সূত্রপাত। বছরে একবার বা কোনো কোনো বছরে দুবার মামারবাড়ী এলে আমাদের দেখা হতো। নিজস্ব ফোন ছিল না তখন। মায়ের ফোন থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে সপ্তাহে দুই তিন বার কথাও হতো। আমাদের প্রেমটা ছিল গভীর। তার মৃত্যুর পর তাই আজও তার জায়গাটা অন্য কাউকে দিতে পারিনি। সেদিনটা এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে। সকালবেলায় আমি ঘরে পড়ছিলাম। মা হাঁফাতে হাঁফাতে বাড়ি এসে বাবাকে বললো “ওগো শুনছো পাশের বাড়ির মহুয়ার ছেলে রোহিত গতকাল রাতে সুইসাইড করেছে।” কিছুক্ষণের জন্য আমার পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠেছিল। আমি ঠিক শুনলাম তো?? পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে মায়ের ফোন থেকে রোহিতকে ডায়াল করে গেলাম। কিন্তু ফোন বন্ধ। মা বাবা কেউই জানতো না আমাদের সম্পর্কের কথা। ভেবেছিল চেনা পরিচিত বলে কান্নাকাটি করছি। পরে শুনেছিলাম ওর বাবার চাকরিটা চলে গেছিল। অসহায় হয়ে পড়েছিল ওর পরিবার। তাই অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। নীচ থেকে ধূপের গন্ধ শঙ্খের আওয়াজ ভেসে আসছে। মা সন্ধ্যা দিচ্ছে তুলসীতলায়। আমি চোখের জল মুছে অতীতকে তালাবদ্ধ করে আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলাম।
বইখাতা নিয়ে বসলেও উদাস চোখে বাইরে তাকিয়ে আছি। মা সাড়ে সাতটার দিকে ঘরে এসে জানিয়ে গেলো আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি এবার থেকে যেন কলেজ এবং টিউশনের বাইরে রাস্তাঘাটে খুব একটা সময় না কাটায়। আমার ধিঙ্গিপনা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। আমি চুপচাপ শুধু কথাগুলো শুনে গেলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম “ঠিক আছে আমার বিয়ে হয়ে গেলে তোমার যদি মনে হয় সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে তবে তোমাদের খুশির জন্য আমি সেটাই করবো। তোমাদের কথা্য কোনদিন অবাধ্য হয়নি আজও তার অন্যথা হবে না।” মা মুখ ঝামটা দিয়ে বললো “মুখে বড় বড় ডায়লগ দিস না। ওই সমস্ত ডায়লগের কথায় আমার মন গলবে না। আমার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। তোর পায়ে শেকল না পরালে তুই শান্ত হবি না আমি ভালোমতোই বুঝতে পেরেছি।” মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। হোয়াটসঅ্যাপ অন করলাম একবার।অনিরুদ্ধ মেসেজ করেছে দেখলাম, পড়লাম কিন্তু উত্তর দিলাম না। The Guide থেকে নোটস লিখতে শুরু করলাম। রাতেখেতে বসে বাবা-মাকে আমার বিয়ের কথা বলতেই বাবার সঙ্গে মায়ের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ বেধে গেল। বাবা কোনমতেই বিয়ে দিতে রাজি নয় আর মা বাবাকে বুঝিয়ে চলছে বিয়েই হচ্ছে একমাত্র শেষ উপায়। আমি কোন উচ্চবাচ্য না করে চুপচাপ খেয়ে ওপরে চলে এলাম। নিজের ঘর বন্ধ করে পড়তে বসলাম কিন্তু কোনমতেই পড়া হচ্ছে না। হঠাৎ কি মনে হল অনিরুদ্ধকে একটা ফোন করলাম। অনিরুদ্ধ ফোনটা রিসিভ করেই বললাম ” সে দেবী আপনি কি আপনার একনিষ্ঠ ভক্তের ওপর কূপিত হয়েছেন? আপনার ভক্তের দোষ কোথায় দেবী? পথ দেখান মোরে।” আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম ” মন ভালো নেই। বাড়িতে ঝগড়া হচ্ছে।” অনিরুদ্ধ ইয়ার্কি থামিয়ে বললো “কী হয়েছে বলা যাবে আমাকে?” মনে মনে চিন্তা করলাম মা যে কোনো মুহূর্তে ঘরে চলে আসতে পারে তাই বললাম কাল দেখা করো সব বলবো। শুভ রাত্রি জানিয়ে ফোন রেখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।