পরদিন কলেজে অনিরুদ্ধর সঙ্গে দেখা করলাম। মনটা ভারাক্রান্ত ছিল। ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললাম। বাড়ির পরিস্থিতি সব বললাম। অনিরুদ্ধ আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলতে থাকলো ” তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। কিছুতেই তোমাকে হারাতে দেবো না। তোমার ভয় নেই। তোমার সঙ্গে আমি আছি।” ওই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমি কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছিলাম। জড়িয়ে ধরলাম অনিরুদ্ধকে কানে কানে বলে উঠলাম ” ভালোবাসি ভালোবাসি। তোমাকে খুব ভালোবাসি। কখনো ছেড়ে যাবো না।” কিছুক্ষন পর নিজেকে এক ঝটকায় সরিয়ে নিয়ে এক ছুট। অনি পিছন থেকে নাম ধরে ডাকলেও আমি লজ্জায় আর থামতে পারিনি। সাইকেল গ্যারেজ পর্যন্ত আসতে আসতে রিতিমত হাঁফিয়ে উঠলাম। অনি পিছন পিছন দৌড়ে এসে বললো “ধরেছি যখন আর ছাড়ছি না।” আলতো করে কপালে একটা চুমু খেয়ে বললো”পাগলী সুখে দুখে তোমার সাথেই আছি।” আমি মিটি মিটি হাসতে হাসতে বাড়ি চলে এলাম।
বাড়ি এসে মায়ের সঙ্গে সেদিন অনেক গল্পগুজব হৈ হুল্লোর করলাম। সন্ধ্যাবেলায় টিউশন পড়াচ্ছি হঠাৎ মোবাইলে নোটিফিকেশন এলো বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার ডেট ঘোষণা হয়েছে। পাক্কা পঞ্চাশ দিন পর পরীক্ষা। ভয়ে বুক দুর দুর করে কাঁপছে। কোনোরকমে পড়িয়ে বাড়ি ফিরলাম। পাগলের মতো অবস্থা হয়ে গেছে আমার কারণ সিলেবাস তখন ও ৫০% ও শেষ হয়নি। বাড়িতে রিতিমত কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছি। বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো ” তুই পারবি মা। তোর ওপর সেই ভরসাটা আছে।” আমি কেঁদেই চলেছি, বাবা আরোও বললো’ তোর কোনো চাপ নেই। যতদূর ইচ্ছা তুই পড়াশোনা করবি। আমি তোর সাথে আছি। যা এখন মন দিয়ে পড়। মা কিছুক্ষন পর ঘরে গিয়ে বললো এ কটা দিন একটু কষ্ট করে পড়ে নে। তারপর রেস্ট। মাথার মধ্যে থেকে সবকিছু সরিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়।
দেখতে দেখতে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। পরীক্ষা শেষের দিন হল থেকে বেরিয়েই অনিকে ফোন করলাম। ওর ফোন বিজি পেলাম। দু-তিন বার ফোন করলাম। অনি ফোন কেটে দিল। খুব ক্লান্ত বিধ্বস্ত ছিলাম। আসতে আসতে গাড়িতেই ঘুমিয়ে গেছিলাম। বাড়ি পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখলাম অনি ফোন করেছিল। ঘুরিয়ে কল ব্যাক করলাম আবার ফোন ব্যস্ত। আমি ফোন সাইলেন্ট করে চার্জে বসিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাতে বাবা ডেকে ঘুম থেকে তুললো খেতে যাওয়ার জন্য। খেয়ে এসে অনিকে ফোন করলাম। ওর গলা শুনেই বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা হয়েছে। গলাটা নিস্তেজ লাগছে। অনেকবার জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে কিছুতেই বললো না। প্রায় দুঘন্টা কথাবার্তা হলো কিন্তু কথার মধ্যে যে তাল কাটছে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম।
পরদিন নটার দিকে ঘুম থেকে উঠে মায়ের সঙ্গে রান্না করছিলাম। স্নান করে গল্পের বই পড়ছি অনি ফোন করে বললো ” প্লীজ আজ বিকালে একবার দেখা করতে পারবে? প্লীজ না বলো না। ঠিক পাঁচটার সময় গঙ্গার ধারে এসো।” এইটুকু বলেই ফোন রেখে দিলো আমি হ্যাঁ বা না বলার সুযোগ পেলাম না। আমি বই পড়ছি আর ভাবছি ” ধুর বাবা এমন কী হলো যে এতো জরুরী তলব”। এমন সময় মা হাঁফাতে হাঁফাতে ঘরে এসে বললো ঢেপ্সীর বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে শুনেছিস? আমি চমকে গেলাম কিছুক্ষণের জন্য জাস্ট ভুলে গেলাম ঢেপ্সী ও তার পরিবার আমাদের সঙ্গে কী দুর্ব্যবহারটাই না করেছে। মা বললো তোর বাবা হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সময় ছিল এবং এখনও ওখানেই আছে। আমি বললাম বেশ টাইম টু টাইম ফোন করে খবর নিও। আমি ঢেপ্সীর নম্বরে ফোন করলাম। ফোন ধরেই অঝোর ধারায় কেঁদে উঠলো। আমি সান্ত্বনা দিলাম কিছু হবে না চিন্তা করিস না বাবা সুস্থ হয়ে যাবে।
আমি ঢেপ্সীদের বাড়ি গেলাম। যাওয়ার আগে অনিকে ফোন করে বললাম আমার বান্ধবীর বাবা ভীষণরকম অসুস্থ তার বাড়িতেই যাচ্ছি। অনি বললো আমার সঙ্গে যাবে। দুজনে ওদের বাড়ি গেলাম। ঢেপ্সীর মা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে কাঁদছে। কাকিমাকে শান্ত করে কিছু খাওয়ালাম। আমরা যখন গেলাম তখন অজয় ওখানে উপস্থিত ছিল। কিন্তু ওই যেন থাকতে হয় আছে এরকম একটা গাছাড়া ভাব ওর মধ্যে। বসে বসে পাবজি খেলছিল। অজয় যেহেতু অনিকে আগে থেকেই চেনে তাই দুজনে বাগানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল কারণ ওদের ড্রয়িংরুমে তখন অনেক লোকজন ছিল। আমি মাঝেমাঝে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে ওদের গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করছিলাম। শেষবার যখন উঁকি মারলাম দেখলাম অনি হাত পা নেড়ে অজয়কে কিছু বোঝাচ্ছে। অজয় উত্তেজিত হয়ে ওর দিকে তেড়ে তেড়ে আসছে। চকিতে ও ধাক্কা দিয়ে অনিকে আমগাছের সঙ্গে ঠেসে ধরে গলাটা চেপে ধরেছে। আমি এক দৌড়ে ওখানে গেলাম। আমাকে দেখামাত্র অনি চিৎকার করে বললো ” কেন এসেছো এখানে?যাও ভেতরে যাও। আমি ঠিক আছি।” এই ঘটনার কুড়ি পঁচিশ মিনিট পর আমি আর অনি ঢেপ্সীদের বাড়ি থেকে চলে এলাম।
সারা রাস্তা অনি একটা কথা বললো না আমার সঙ্গে। চুপ করে গুম হয়ে থাকলো। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। আমি মাকে সব বললাম ওদের বাড়িতে যা যা হয়েছে শুধুমাত্র অজয় আর অনির কথাটা গোপন করলাম। বাবা ফোন করেছিলাম ঢেপ্সীর বাবার কন্ডিশন ক্রিটিক্যাল। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শুনে ভীষন মন খারাপ হয়ে গেল। মা খেতে দিলো কিন্তু বিশেষ কিছু খেতে পারলাম না। কিছু ভালো লাগছিল না। বিকালে মায়ের সঙ্গে ঢেপ্সীর বাড়ি গেলাম। অজয়ের বাবা মা এসেছে দেখলাম। ওনাদের আচার আচরণ আমার খুব একটা ভালো লাগছিল না। কথাবার্তায় ধূর্ততা, শঠতা মনে হচ্ছিল। আমি অজয়ের মাকে আড়াল থেকে ওয়াচ করছিলাম। ওনার একটা ফোন এলো আর উনি বেরিয়ে গেলেন। আমিও পিছু নিলাম। স্পষ্ট শুনতে পেলাম উনি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে কাকে যেন ফোনে বলছেন ” বুড়ো মরলে হয়। একমাত্র মেয়ে, অগাধ সম্পত্তি সবকিছু তখন আমার ছেলের কব্জায়। সারাজীবন আমাদের আর ভাবতে হবে না। ওই উদ্দেশ্য নিয়েই তো এই মোটা মাগীর সঙ্গে আমার ছেলে সম্পর্ক রেখেছিল। আমি তো সবই জানি প্রথম থেকেই।” কথাটা শুনেই দপ করে মাথাটা জ্বলে উঠলো। উনি দেখে ফেলার আগেই আমি চুপচাপ নিঃশব্দে ওই জায়গা থেকে সরে এলাম। মনে মনে ভাবছি ঢেপ্সীর জীবনে কী ভয়ঙ্কর বিপদ নেমে আসতে চলেছে। ভদ্রমহিলা ফিরে এসে হঠাৎ করে আমার সঙ্গে খেজুরে আলাপ করতে চলে এলেন। আমি পাত্তা দিলাম না বিশেশ একটা, অনি ফোন করলো আমি মাকে বলে বেরিয়ে গেলাম।