• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব – ১২)

কু ঝিক ঝিক দিন

১২.

সর্বপ্রথম টেলিফোন আবিষ্কার করেছিলেন আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল। যাদের বাড়িতে টেলিফোন ছিল তারা হ্যালো বলে কথা শুরু করতেন। কারণ গ্রাহাম বেলের প্রেমিকার নাম ছিল মার্গারেট হ্যালো! এবং পরবর্তীতে বেল তাকে বিয়ে করেছিলেন। সে হিসেবে টেলিফোন কলের উত্তর দেওয়ার জন্য একটি শব্দ ব্যবহার করতে গিয়ে বেল তার প্রেমিকার প্রতি নিজের ভালবাসা প্রকাশের নিদর্শন স্বরূপ ‘হ্যালো’ শব্দটি ব্যবহার করেন।
কিন্তু বাবা বলেছিল, এটা পুরোপুরি ভুল গল্প।
আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল টেলিফোন আবিষ্কার করলেও ‘হ্যালো’ সম্ভাষণটি বলার প্রচলন তৈরি করেছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী বৈদ্যুতিক বাতির আবিষ্কারক থমাস আলভা এডিসন।
প্রথম যে টেলিফোন আবিষ্কার করা হয়েছিল সেখানে মূলত কোনো রিং বাজার ব্যবস্থা ছিল না। টেলিফোন ব্যবহার করাই হতো ব্যবসায়িক কাজে, যেখানে একপাশের টেলিফোন লাইনের সাথে অপর পাশের লাইন মূলত সবসময় উম্মুক্ত হিসেবে থাকতো। তাই কখনো কথা বলার প্রয়োজন পড়লে একপাশের ব্যক্তিকে অপরপাশের ব্যক্তিকে নিজের কথা বলার প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করতে কিছু একটা বলে ডাকা বা সম্ভাষণ করার প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজন উপলব্ধি করে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল ‘অ্যাহয়’ (ahoy) শব্দটি প্রচলন করার আহবান জানান। কিছু সময় ধরে ‘অ্যাহয়’ কে টেলিফোনের সম্ভাষণ হিসেবে ব্যবহার করাও হয়। ১৮৭৭ সালের ১৮ জুলাই থমাস আলভা এডিসন ‘প্রিন্সিপাল অব রেকর্ডেড সাউন্ড’ আবিষ্কার করেন। সেসময়ে তার পরীক্ষানিরীক্ষার কাজে তিনি যে শব্দটি বারবার উচ্চস্বরে ব্যবহার করেছিলেন তা হলো ‘Halloo’। সেই থেকেই হ্যালো শব্দের শুরু।
১৮৭৮ সালে নিউ হেভেন, কানেকটিকাটের ডিস্ট্রিক্ট টেলিফোন কোম্পানি সর্বপ্রথম একটি ফোনবুক বের করে। সেসময় তাদের মোট ৫০ জন টেলিফোন গ্রাহক ছিল। তাদের প্রকাশিত সেই ফোনবুকে সকলের ফোন নাম্বারের পাশাপাশি ফোন ব্যবহার করার কিছু নির্দেশনাও দিয়ে দেয়া হয়েছিলো। তারা সেখানে তাদের গ্রাহকদের কোনো ফোনকল শুরু করার প্রথমে ‘hulloa’ এর মতো নরম এবং স্ফূর্তিযুক্ত শব্দ দিয়ে কথা বলা শুরু করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। শেষের ‘a’ ছিল অনুচ্চারিত। ফোনবুকে কথা শেষ হলে কি বলে শেষ করতে হবে সে সম্পর্কেও বলা হয়েছিলো। এক্ষেত্রে ‘That is all’ বলে কথা শেষ করার পরামর্শও দেওয়া হয়েছিলো।
কিন্তু আমার এই গল্পে এসব কথা কেন?কারন ১৮৭৮ সালে ৫০জন ফোন ব্যবহার করলেও সত্তরের দশকেও ব্যবহারটা খুব বেশি ছিল না।আমাদের পাড়াতে তো নয়ই।
আমাদের পুরো পাড়াটায় একটা মাত্র ফোন ছিল।সেটা অমর জ্যেঠুর বাড়িতে। সেই বাড়িতেই বাবার যাবতীয় ফোন আসত।তখন হয়তো কেউ দিনের বেলা ফোন করেছেন,বাবা তখন বাড়ি নেই কিংবা থাকলেও তাদের বাড়ি থেকে ডাকতে আসার কেউ নেই, তাকে তখন অন্য একটা নির্দিষ্ট সময়ে ফোন করতে বলা হত।সচরাচর ফোনগুলো নয় রাত নটার পর কিংবা সকাল নটায় আসত।এই ফোনটাও তখন অদ্ভুত এক দেখার বিষয় ছিল।কালো বড় একটা গোলাকার দেহ। তার সঙ্গে সুরের মত লেগে থাকত রিসিভার। সংখ্যা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ডায়েল করতে হত।আর ওই রিসিভারটা ধরেই কানে দিয়ে কথা বলা হত।কখনো সখনো বাবার ফোন ধরতে আমি যেতাম।হয়তো বাবা বলে গেছেন, এমন একটা ফোন আসবে,এই কথাটা তাকে বলে দেবে।সেই সব দিনগুলো আমি অপেক্ষা করতাম সেই দূর্লভ সামগ্রীটা দেখার জন্য।
সেই ফোনে একটি বার্তা এসেছিল।বাবার প্রিয় বন্ধুর ছোটো মেয়ে মুনিয়ার মৃত্যু সংবাদ।বিধান চন্দ্র রায় মেমোরিয়াল হাসপাতালে মুনিয়া ভরতি ছিল।তার ম্যানেনজাইটিস হয়েছিল। বহরমপুরের ডাক্তার ধরতে পারেনি।কলকাতার যখন ভরতি করা হল তখন আর কোনো আশা ছিল না।মুনিয়ার পেটে একটা জরুল ছিল।বাবার বন্ধু- আমাদের কাকু বলত,তার মা মরে মুনিয়া হয়েছে।সেই ঠাকুমার নাকি জ্যোতিষ মতে আরও ছয় বছর সাত মাস আয়ু ছিল।মুনিয়াও ঠিক এই বয়সেই চলে গেল।
মুনিয়ার সঙ্গে তার আগে বার তিনেক দেখা হয়েছে। গান শুনিয়েছে।সে যখন চলে গেল আমার তখন ১০ বোধহয়।তার আগে মৃত্যু সম্পর্কে কোনো ধারনা ছিল না।
আগের দিন বিকেলে আমরা তাকে দেখতে গেছিলাম হাসপাতালে।কিন্তু ছোটো বলে ঢুকতে দেয়নি।অল্প অল্প মনে পড়ে মা চোখ মুছছিল বারবার।কিছু যেন একটা ঘটতে চলছে বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কি সেটা!
সেদিন সারারাত বাবা আর কাকু ছাদে পাইচারি করছিল।খুব ভোরে অমর জ্যেঠুর বাড়ির টেলিফোনে খবরটা এসেছিল।
বাবা আর কাকু তখনি হাসপাতালে চলে গেল।সেদিন আমাদের বাড়িতে একটা অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছিল।রান্না চাপায়নি মা।পাশের বাড়ির কাকিমা আমাদের খাবার দিয়েছিল।
সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল ফোন জিনিসটা না থাকাই ভালো।তাহলে এমন খবর আসত না।
তার চলে যাবার শোক অনেকদিন ঘিরে ছিল আমাদের। ক্রমশ জীবন তার নিজস্ব ছন্দে ফিরে গেল।
আমাদের বাড়িতেও ওরকম একটা ফোন এল।বাবার ঘরে যেখানে বাবা বসত ঠিক তার উপরে একটা বইয়ের তাক।সেখানেই একপাশে রাখা হল তাকে।যখনি সেটা ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠত ছুটে যেতাম।কিন্তু তার আগেই বাবা কিংবা আমাদের সর্বক্ষণের দেখভাল করার সঙ্গী তুলসিদি ফোন ধরত।বাবা না থাকলেও আমাদের ধরার সাহস ছিল না,পাছে বকা খাই।পড়াশোনা একেবারেই না জানা তুলসিদি কিন্তু বাবার থেকে বেশ কতগুলো শব্দ বাক্য শিখে নিয়েছিল।সে ফোন ধরে হ্যালো বলার পরই সময় অনুযায়ী গুড মর্নিং কিম্বা সুপ্রভাত,গুড ইভিনিং, শুভ সন্ধা,ধন্যবাদ কল করার জন্য। আমি স্যারকে সব জানিয়ে দেব,কিংবা আমি কি আপনার কনটাক্ট নাম্বার পেতে পারি,তাহলে তিনি ফিরলে ফোন করে নেবেন… ইত্যাদি….ফোন রাখার আগে সে নিশ্চিত ভাবে বলত আপনার আজকের দিনটা ভালো যাক।
আশ্চর্য ভাবে সে তার সুললিত কন্ঠে এই কথাগুলো বলে যেত।
সবাই জানতো তুলসিদি বাবার লেডি সেক্রেটারি।
আমি অবাক হয়ে ভাবতাম কবে এমন স্টাইলে আমি কথা বলব!
আরও ভাবতাম, যেদিন তুলসি দি বা বাবা কেউ থাকবে না আমি ফোন নিয়ে প্রাকটিস করব কিভাবে কথা বলতে হয়।বাবার ফোন নিয়ে কতবার স্টাইল করে রিসিভার ধরে হ্যালো বলেছি মনে মনে,ঠিক বাবার মতো করে।
মাঝে মাঝে ফোনটা নিশ্চল হয়ে যেত।তখন মেকানিক্স আসত সারাতে।বাইরের টেলিফোনের তারে রিসিভার গুঁজে সে এ প্রান্তে থাকা অন্য ব্যক্তি বা আমাদের বলত, শুনতে পাচ্ছো?কথা বলো,
ভেবে পেতাম না কি বলব!
সে বলত,হ্যালো হ্যালো বলো,নিজের নাম বলো।
তখন মহানন্দে কত রকম ভঙ্গিতে, কন্ঠস্বরে এক নাগাড়ে মাইক টেস্টিং হ্যালো হ্যালোর মতো বলে যেতাম…
দুপুরে এই বড় টেলিফোন ডিরেক্টরি খুলে কত নাম না জানা মানুষকে ফোন করেছি।
একবার বোন অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের নাম্বারে এভাবেই ফোন করেছিল।সে ছিল প্রসেনজিতের দারুণ ভক্ত।কত গল্প সে লিখেছিল তার বুম্বাকে নিয়ে। কত মজার গল্প লুকিয়ে এই প্রাঙ্ক কলের মধ্যে। সে কথাও বলব সময় করে।
এই তো মাত্র তিন বছর আগেও সেখান থেকেই ফোন আসত রাত আটটার আগেই। কখন আসছিস?তাড়াতাড়ি আয়।তুই না এলে মনটা ভালো লাগে না।
আজ তিনবছর সেই ফোনটা আসে না।ফোনটা নীরব হয়ে পড়ে আছে বাবার বসার চেয়ারের সামনে রাখা তাকেতে।
তবু সেই ৫৫৭ ৬৬৯০, আরও পরে তারসঙ্গে ২যোগ হওয়া ল্যান্ড লাইনটা আমার প্রথম মুখস্থ করা নাম্বার- আজও প্রথম দিনের মতোই আশ্চর্য ভালোলাগা নিয়ে বেঁচে আছে মনের খাঁচায়।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।