• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব – ৭)

কু ঝিক ঝিক দিন

৭.

সেই বিশ্রী দম-আটকানো কুয়াশা আর নেই/নেই সেই একটানা তুষার-বৃষ্টি,
হঠাৎ জেগে উঠেছে-
সূর্যের ছোঁয়ায় চমকে উঠেছে ভূস্বর্গ।
দুহাতে তুষারের পর্দা সরিয়ে ফেলে
মুঠো মুঠো হলদে পাতাকে দিয়েছে উড়িয়ে,/ডেকেছে রৌদ্রকে,
ডেকেছে তুষার-উড়িয়ে-নেওয়া বৈশাখী ঝড়কে,/পৃথিবীর নন্দন-কানন কাশ্মীর।
কাশ্মীরের সুন্দর মুখ কঠোর হল
প্রচণ্ড সূর্যের উত্তাপে।/গলে গলে পড়ছে বরফ-/ঝরে ঝরে পড়ছে জীবনের স্পন্দনঃ/শ্যামল আর সমতল মাটির
স্পর্শ লেগেছে ওর মুখে,
দক্ষিণ সমুদ্রের হাওয়ায় উড়ছে ওর চুলঃ/আন্দোলিত শাল, পাইন আর দেবদারুর বনে/ঝড়ের পক্ষে আজ সুস্পষ্ট সম্মতি।/কাশ্মীর আজ আর জমাট-বাঁধা বরফ নয়ঃ
সূর্য-করোত্তাপে জাগা কঠোর গ্রীষ্মে
হাজার হাজার চঞ্চল স্রোত।
তাই আজ কাল-বৈশাখীর পতাকা উড়ছে/ক্ষুব্ধ কাশ্মীরের উদ্দাম হাওয়ায় হাওয়ায়;/দুলে দুলে উঠছে
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ঘুমন্ত, নিস্তব্ধ
বিরাট ব্যাপ্ত হিমালয়ের বুক।
সুকান্ত ভট্টাচার্য্যর লেখা ‘কাশ্মীর’ নামে এই কবিতাটার মধ্যে দিয়ে কাশ্মীরের প্রতি আমার প্রেম, ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল।আমার কাছে সেই আশির দশকে কাশ্মীর মানে একদিকে নন্দন কানন অন্যদিকে ভূস্বর্গ। আর কাশ্মীর মানেই শীত নামার মুখে সুন্দর সুন্দর পুরুষের দল,যারা কাপড়ে মুড়ে নিয়ে আসত শাল,পশমিনা। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই তাদের আসা শুরু।লাল টকটকে চেহারা,লম্বা,টিকালো নাক।আর কী সুন্দর করে হিন্দি বাংলা মিশিয়ে তাদের কথা বলা।সাধারণত পাড়ায় এরা অন্য দিন এলেও আমাদের বাড়িতে আসত রবিবার বা কোনো ছুটির দিন।সেই দিনগুলোতে আমি ভাবতাম স্বর্গের থেকে দেবতারা নেমে এসেছে আমাদের ঘরে।এতটাই ভালো দেখতে ছিল তারা।মা কাকিমা, কখনো কখনো বাবাও তাদের সাদা কাপড়ের মধ্যে বাঁধা শালের সম্ভার দেখত।একটা একটা করে তারা বের করত সেই অপরূপ সুন্দর শাল,পঞ্চো,পশমিনা,কাশ্মিরী সিল্ক,শালের শালোয়ার কামিজের পিস।আমি ভেবে পেতাম না কাকে দেখব!তাদের নাকি জিনিসগুলোকে!তারা আমাদের জন্য নিয়ে আসত শুকনো ফলের কুচি।আর জাফরান।সচারচর মা খুব একটা জিনিস কিনত না।কিন্তু এদের থেকে একটা দুটো শাল কেনা হয়েই যেত।এরাও আমার মা বাবাকে খুব ভালো বাসত।তার একটা কারন ছিল বাকিরা যখন ধারে কিনত, বাবা পুরো টাকাটাই দিয়ে দিত একেবারে।বাবার এ বিষয়ে পরিস্কার বলা ছিল,নিজ বাসভূমি থেকে এতদূরে মানুষ গুলো এসেছে কেবল রুটি রোজগারের তাগিদে।কোনো বাকি রাখা যাবে না।পরের শীতে যখন আসবে তখন এখন নেওয়া জিনিসের দাম দিলে তাদের চলবে কী করে!তাদেরও তো পরিবার আছে!
কাজেই মা তার সামর্থ্য মত যেটাই কিনত তার দাম তখনি দিয়ে দিত।ফলে তারাও মাকে ও বাবাকে বেশ খাতির করত,এবং অন্যান্যদের যে দামে দিয়েছে বা দিচ্ছে তার তুলনায় কিছু টাকা কম নিত।
তাদের সঙ্গে বাবার গল্প হত সেখানকার সাহিত্য, শিল্প সংস্কৃতি নিয়ে।তাদের মুখেই প্রথম শুনেছিলাম কাশ্মীরী পন্ডিতদের কথা, যাদের বাধ্য করা হয়েছিল কাশ্মীর ছেড়ে জম্মু বা অন্য কোথাও চলে যেতে।তারা আফশোস করত,বাবাজান,আল্লা জানে আমরা এমন চাইনি।কিন্তু আমরা তাদের আটকে রাখতেও পারিনি।কারন যারা হামলা চালায় তাদের হাতে অনেক অস্ত্র। আর তারা আমাদেরকেও ছাড় দেয় না।আমরা মুসলিম হতে পারি,কিন্তু ইনসানিয়াৎ হারাইনি।অথচ দেখো আমরাও শান্তিতে নেই। ভূস্বর্গ এখন নরক।
এই কাশ্মীরী পন্ডিত, মুসলিম,হিন্দু এসব বিষয় নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগলেও তা কখনো জানতে চাইনি।কারন আমি তাদের দেখতেই মগ্ন থাকতাম।একবার একটা রানী রঙের স্যুট আমি নিয়েছিলাম তাদের থেকে।রোজ সেটা দেখতাম আর ভাবতাম এরা যখন এত সুন্দর এদের বউরাও নিশ্চয়ই আরো সুন্দর। কিন্তু হায়,এরা কখনোই এদের বউ বাচ্চা নিয়ে আসত না।অবশ্য এদের বাচ্চাদের সাদা কালো ছবি মাঝে মাঝে ঝোলার মধ্যে থেকে বের করে দেখাত।
আমার তাদের প্রতি এই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা লক্ষ করেছিল কাকিমা।সে আমাকে সর্বদা চোখে চোখে রাখত।এইসময় শোনা গেছিল আমাদের পাশের পাড়ার একটি মেয়ে এদের কারোর সঙ্গে পালিয়েছে। তাকে আর পাওয়া যায়নি।পরেরবার যখন এরা এসেছিল তখন প্রচুর জেরার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।অবশেষে পুলিশ কাশ্মীর থেকে নিয়ে এসেছিল সেই মেয়েটিকে।মেয়েটি বলেছিল,সে যথেষ্ট সুখে আছে তার কাশ্মীরী বরের সঙ্গে, এবং তার সাথেই থাকতে চায়।তারপর ধীরে ধীরে আবার শালওয়ালাদের যাতায়াত শুরু হল।কিন্তু আমার উপর কাকিমার নজরদারি বন্ধ হল না।
আমি কখনো তাদের সঙ্গে পালাবার কথা ভাবিনি,কারন কাশ্মীরে খুব শীত।আর আমি একদম শীত পছন্দ করি না।তা বলে কী তাদের দেখাও অপরাধ ছিল!জানি না।তবে আজ যখন নিগার সাহিবা কিংবা রুমো বা হিমা নায়েকের কবিতা পড়ি তখন সেই শালওয়ালাদের জন্য ভীষণ মন খারাপ করে।জানতে ইচ্ছে করে কেমন আছে তারা?আদৌ কী বেঁচে আছে?কিংবা বেঁচে থাকলেও তাদের কী মনে আছে কলকাতার এক এগারো বারো বছরের মেয়ে শীত পড়ার মুখে তাদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত,ঝোলা থেকে তাদের পসরা বের করার আগেই তাদের হাতে তুলে দিত জল মিষ্টি, আর মনে মনে কাশ্মীর নামে এক আশ্চর্য পৃথিবীকে দেখত তাদের চোখ দিয়ে।
নাকি আমার শৈশবের সেই কাশ্মীর এখন এমন হয়ে গেছে যেমন লিখেছেন নিগার সাহিবা-
সমস্ত বর্ণমালা, শব্দ, গান, গল্প, কলম, লেখার প্যাড,
বইয়ের গাদা, ফুল, বাগান, পাপড়ি, পাতা, গন্ধ, রঙ, রোদ, ছায়া, দেয়াল, দরজা, জানালা, বারান্দা, প্রতি সন্ধা –
সকাল – বিকাল – রাত – সারাক্ষণ,
চুপিচুপি আটকে থাকা;
আমার মালিকানাধীন সবচেয়ে ছোট জিনিসটিও আমি তরবারির নিচে রেখেছি ।
আমি আত্মহত্যা করবো
আমার কাছে থাকা প্রতিটি মুহূর্তের আমি সংরক্ষণ করছি।
সংরক্ষণে আমার কলহ
আমি চিৎকার করছি:
ওঃ তুমি- যারা মরে যাচ্ছ, আমাকেও সঙ্গী করে নাও !
যারা বেঁচে আছো, আমাকে শক্ত করে ধরে রাখো।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।