সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শাশ্বতী নন্দী (পর্ব – ৫)

নিশিভোর

পর্ব – ৫

(৭)
সুমনার ফোন ছেড়েই গৌরী চটপট কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। কালকের মধ্যেই দার্জিলিং পৌঁছে যাবে মেয়েটা। ঝিলমিলপুর ওখান থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূর। পদ্মা মারফৎ নিশ্চয়ই বাবাজীর লোকের কানে তারপর ওর পৌঁছনোর খবর পৌঁছে যাবে। আর তারপরই  …
অসম্ভব! সুমনাকে বাঁচাতেই হবে। বড্ড দুঃখী ও। এত কম বয়সে ভালবাসার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। জীবনের প্রতি মায়াও তাই বুঝি ওর তলানিতে ঠেকেছে।
একটু দোনামোনা করেই গৌরী ডিজি সাহেবের নম্বর টেপে। ব্যস্ত আছেন বোঝা গেল, ফোন তুললেন বেশ খানিক পর, ‘ইয়েস’। – গলাটা ভারী।
-স্যার, গৌরী সিনহা হিয়ার।
-হুম।
-আমি কালই স্যার, স্টার্ট করতে চাইছি ঝিলমিলপুর। অ্যাকচুয়েলি সোর্স মারফৎ কিছু খবর পেলাম … সংক্ষিপ্ত ভাবে যতটুকু প্রয়োজন গৌরী ততটুকুই বলে।
-কিন্তু টিম ছাড়া তোমার যাওয়া তো উচিত হবে না। ইউ নিড প্রোটেকশন। শ্যাল আই টক টু এস পি দার্জিলিং?
গৌরী সতর্ক হয়। এভাবে খবরটা চাউর হলে মুশকিল। বিশেষ করে অনুভবের কানে গেলে, সব ভন্ডুল।
তাড়াতাড়ি গলা ঝেড়ে বলে, -‘ওয়ান থিং স্যার, আমার যাওয়ার ব্যাপারটা কনফিডেনশিয়াল রাখতে চাইছি। ওখানে গিয়ে আমিই ওঁদের সঙ্গে কনট্যাক্ট করে নেব। অ্যাকচুয়েলি সিচুয়েশনটা স্টাডি করা দরকার। অপারেশন শুরুর এটাই হাই টাইম কিনা। এমনও হতে পারে অপোনেন্ট একটা ভুয়ো খবর ছড়িয়ে …
-হুম। হতেই পারে। ওকে, যেটা ভাল বোঝ কর। তবে চিন্তা ভাবনা করে প্রসিড করবে। বিকজ ইউ আর দা টিম হেড।
গৌরী উৎফুল্ল। আহ্‌, সবুজ সিগন্যাল তাহলে মিলে গেল। তার মানে কাল সকালেই, জার্নি টু ঝিলমিলপুর। অন্য কোনও যান বাহন নয়, সোজা নিজের অফিস কারে। ড্রাইভারটি চাবুক ছেলে। তার সঙ্গে থেকে আরও ক্ষুরধার। সঙ্গে আর্মস নেওয়াটা জরুরি কিনা একটু ভাবতে থাকে সে।
 পরিকল্পনা অনুযায়ী, ব্লু হেভেন অপারেশনের জন্য কলকাতা থেকে বাছা হয়েছে জনা কুড়ি। এক জন সাব ইন্সপেক্টর, একজন ইন্সপেক্টর। বাকি সব আর্মড ফোর্স। এ ছাড়াও দার্জিলিংয়ে একটা টিম রেডি হচ্ছে। কারণ সমতলের মানুষের পক্ষে পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে চড়াই উৎরাই ভেঙে এনকাউন্টার করা, প্রথম অবস্থায় একটু   ডিফিকাল্ট।
কিন্তু এই মুহূর্তে অন্য এক সম্ভাবনাও মাথা চাড়া  দিচ্ছে। ওখানকার রেজিমেন্ট থেকে কোনও ছেলেকে টিমে রাখাটাও ঠিক নয়। বাবাজীর ভক্তকূল সমস্ত পাহাড়ে ছড়িয়ে আছে। বরং ইন্ডিয়ান রিসার্ভ ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে সে কথা বলে নেবে। ওরা যথেষ্ট ট্রেইন্ড। এ ব্যাপারে অবশ্য ডিজি সাহেবের পরামর্শ দরকার।
ভেতরে খুশির বুদবুদ ওঠে। অনর্গল কথা চলতে থাকে মনে মনে। সুমনা, পৌঁছে যাচ্ছি আমি তোমার কাছে। এভাবে বিপদের কাছে নিজেকে সঁপে দেয় নাকি কেউ? ছিঃ! আরে, জীবন হল নদীর মতো, এক পার ভাঙবে, অন্য পার গড়ে উঠবে।
ফোন লাগবে না জেনেও সে আর একবার ফোনে ধরার চেষ্টা করে সুমনাকে। মেয়েটা যে কী মায়ায় বেঁধেছে। লোক গৌরীর বাইরের খোলসটাই চেনে। কিন্তু অন্তরের টলটলে স্নেহ পুকুরের খবর কে রাখে? সেখানে ভালবাসা একবার ছাপ ফেললে, চিরকাল রয়ে যায়।
নম্বর রিং হচ্ছে। কেউ তুলল না। ঘড়িতে সন্ধ্যা ছটা। সুমনা খুব ব্যস্ত নিশ্চয়ই, ষ্টেশনে বেরোবার তোড়জোড় চলছে। রাতে ট্রেন।
গৌরী ষ্টেশন লিভের চিঠি তৈরি করে, ইমিডিয়েট বসকে জানানোটা বাধ্যতামূলক। অরিন্দমের ঘরের দিকে পা সরতে চায় না। অসহ্য লোকটা! তবু মেনে নিতে হবে, মেনে নিতে হয়। জীবন কি শুধুই মসৃণ পথে হাঁটে? যত রুক্ষ পথ, জীবন ততই গতিময়, অভিজ্ঞ, ধারাল।
ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকতেই প্রথমটায় হকচকিয়ে গেল সে। ভেতরটা অন্ধকার, ছায়া ছায়া। একটা হাল্কা আলো জ্বলছে। অরিন্দম থম মেরে চেয়ারে বসে। সিলিঙয়ের দিকে চোখ, উদাস ভঙ্গি।
গৌরী গলা ঝাড়ে, ‘স্যার?’
অরিন্দমের নজর ঘুরল, ‘হ্যাঁ। আরে তুমি, কী ব্যাপার?’
 -আসব?
-ইয়েস, প্লিজ। – সামনের চেয়ারটা হাত দিয়ে দেখায়।
গৌরী হাতের চিঠিটা এগিয়ে দেয়, ‘স্যার, কাল ষ্টেশন লিভ করছি। তার ইনটিমেশন’।
-সে কী, এত তাড়াতাড়ি! আমার কাছে তো কোনও খবর নেই। তাছাড়া ওখানকার ওয়েদার রিপোর্ট পাচ্ছো না? প্রবল ঝড় বৃষ্টি। রাস্তা ঘাট খারাপ, গেলেই বিপদে পড়বে’।
-আমরা পুলিশের লোক, স্যার। – গৌরী অমায়িক হাসে। – বিপদের সঙ্গেই তো ঘর করি। ঝড়, জল, রোদ, দাঙ্গা, কোনও কিছুর অজুহাত দেখিয়ে এখন অপারেশনটা ডি’লে করার উপায় নেই। ডিজি সাহেবও সেরকমই চাইছেন।
পাল সাহেব চুপ। একটু থেমে বলে, ‘রেখে যাও, দেখছি। বাই দা ওয়ে, তোমার বৃদ্ধ শ্বশুর, অসুস্থ না! কর্তা গিন্নী দুজনেই দার্জিলিং চললে, ওনার কিছু ঘটে গেলে!
গৌরীর চোখ চক্রাকারে ঘুরে ওর মুখ জরিপ করল। এত খবর পাওয়ার তো কথা নয় লোকটার! অনুভবের  সঙ্গে যোগাযোগ আছে? উদাস উদাস ভাবটা এখন ওর মুখ থেকে উধাও। আগের সেই কুতকুতে দুষ্টু চাহনী ফিরে এসেছে। -ওকে, তুমি যাও। আমি পরে ডেকে পাঠাচ্ছি।
নিজের ঘরে চলে এসেও উশখুশ করে গৌরী। প্রায় ঘন্টা খানেক পর ডাক এল। ইন্টারকমেই, ‘প্লিজ কাম’। গলাটা মিহি শোনাল। যাক!
কিন্তু ঢুকতেই অন্য মূর্তি। -সরি ম্যাডাম, তোমায় রিলিজ দেওয়া যাবে না। এত পেন্ডিং কেস টেবিলে জমিয়ে রেখেছ!  আমি ডিজিপি র সঙ্গে কথা বলে নিলাম এই মাত্র। উনিও সহমত। তুমি ওই পেন্ডিং ফাইলগুলো আগে শেষ কর’।
গৌরীর চোয়াল শক্ত হচ্ছে। মুঠোয় ধরা মোবাইলটাকে একবার টেবিলে রাখল, পরক্ষণেই তুলে নিল। ভেতরে একটা জ্বালা, অপমান। ফ্যাস ফ্যাস গলায় বলে, ‘স্যার, আপনি তো  জানেন, আমার ওপর একটা মিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রায়োরিটি বেসিসে তো আমাকে ওই কাজটাই নামাতে হবে। এনিওয়ে, আপনি তাহলে আমাকে ছুটি দেবেন না?’
-নো, সরি। চিঠিটা তুলে নাও। রাগ কোর না, আমার হাত পা বাঁধা।
গৌরী দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসে। কপালের রগ দুটো দপ দপ লাফাচ্ছে। একবার কি ডিজি সাহেবকে ফোন করবে? অস্বস্তি লাগছে। বার বার ফোন, এত ব্যস্ত মানুষ! গৌরীকে স্নেহ করেন ঠিকই, কিন্তু পদের উচ্চতাকে তো মান্য করতে হবে।
পরক্ষণেই আর একটা চিন্তা ফিরে এল। অফিস অনুমতি না দিলে যে দার্জিলিং যাওয়াও বাতিল। সুমনার কী হবে? ও কি এতক্ষণে বেরিয়ে পড়েছে ষ্টেশনে! বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়ি ফেরানো যায় না?
তখনই মোবাইল বাজল। স্ক্রিনে একটা ল্যান্ড লাইন নম্বর। হ্যালো বলতেই, ওপাশে একটি মেয়েলি কন্ঠস্বর।
-লাইনে ডি জি স্যার আছেন। হোল্ড করুন, উনি কথা বলবেন।
অবাক হয় গৌরী। হঠাৎ , ডিজি সাহেব নিজে!
-হ্যালো গৌরী?
-ইয়েস স্যার।
-আচ্ছা, এসব কী শুনছি? তোমার হাতে নাকি একশোর ওপরে পেন্ডিং কেস ঝুলছে? এই অবস্থায় তুমি ব্লু হেভেনের জন্য প্রসিড করবে কেমন করে? আমি তো তোমায় খুব সিনসিয়র অফিসার ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি তো আমায় হতাশ করলে।
গৌরী আমতা আমতা করে, কিছু বলতে যায়। কিন্তু ওঁর গলার গাম্ভীর্যে তার সব কথা তলিয়ে যায়।
-শোন, তুমি নিজের ডিপার্টমেন্টের ফাইল আগে ক্লিয়ার কর, আমি ওদিকটা দেখছি কী করা যায়।
মুহূর্তের মধ্যে বুঝি গৌরীকে চুরমার করে কেউ ভেঙে দিল। থম মেরে সে বসে পড়ে চেয়ারে। এটা কী হল তার সঙ্গে? চক্রান্ত? কারা আছে এ চক্রান্তে? অনুভব? নাকি পুরোটাই অরিন্দমের চাল?
    কতক্ষণ একভাবে সে চেয়ারে বসে আছে, খেয়াল হয় নি। ফোনের আওয়াজেই হুঁশ ফিরল। অলস চোখে তাকাতেই ট্রু কলারে নাম, বিকাশ গুপ্তা। কে বিকাশ গুপ্তা? বোতাম টিপে আওয়াজটাকে নীরব করে দিল। সব কিছু কেমন অর্থহীন মনে হচ্ছে।
    আবার বাজছে ফোন, সেই একই নম্বর। বিরক্ত হয়েই কলটা নিল, স্পিকার অন করে কেজো স্বর ফোটাল গলায়, ‘হ্যালো’।
    -হ্যাল-ওওও। – একটা চিকণ স্বর ওপাশে।
    -হ্যালো, কে? –গৌরী কানে মোবাইল তোলে।
    -আমি আশা। তুমি চিনছ না! পুলিশ আংকেলের সঙ্গে একবার এসেছিলে, অনেক টফি নিয়ে। চিনলে?
    মুহূর্তের মধ্যে যেন এক ঝাপটায় অনেকখানি বাতাস ঢুকে এল ঘরে। -হ্যাঁ, আশা। চিনতে পেরেছি। কেমন আছো তোমরা?
    পাশ থেকে কেউ যেন বলে দিল, বলো ভাল আছি। আন্টিকে নমস্তে বলো। কিন্তু আশা সে সব শেখানো বুলির দিকেই গেল না। বরং হি হি হাসতে হাসতে বলে উঠল, ‘জানো আমরা এখন কোথায়? শুনতে পাচ্ছ? টক টক টক টক। – আশা মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ করে শোনাছে।
    গৌরী মোবাইলটা কানে চেপে ধরে আছে। বেশ লাগছে কথাগুলো।
    -নমস্তে মাডাম। – লক্ষ্মী বলছি, আশার মা। – লক্ষ্মী বোধহয় মেয়ের থেকে ফোন কেড়ে নিয়েছে। – কেমুন আছেন আপনি? স্যার কেমুন আছেন? ডারজিলিঙে শুনলাম খুব বারিস চলছে। আশা ঊষা বার বার আংকেল আংকেল নাম করছে, ফোন করেছিলাম, লাগল না লাইন। তাই আপনার নম্বরটা, স্যারই দিয়ে গিয়েছিল যাওয়ার আগে।
    -ভাল করেছ। স্যার ঠিক আছেন। তোমরা এখন কোথায় গেছো?
    -আর বলবেন না মাডাম, আজ আমাদের দোকান বন্ধ থাকে। মেয়ে দুটো সেই সকাল থেকে বায়না ধরেছে, ঘোড়ায় চড়বে। ওর বাপও বলল, চল। গড়ের মাঠে তাই নিয়ে এসেছে। এখন ঘোড়ার গাড়িতে সবাই।
    পাশ থেকে বাচ্চার ঘ্যান ঘ্যান কানে আসছে। লক্ষ্মী বিরক্ত, ‘ছাড়, আমি আর একটু কথা বলি’।
    গৌরী হাসে, ‘দাও না, ওর কথা আর একটু বাকি আছে মনে হয়’।
    -হ্যালো, আমি ঊষা। – এই গলায় যেন আর একটু  চিনি মেশানো। -আমরা এখন ঘোড়া চড়ছি। তারপর ভেলপুরি খাব। তুমি আসবে?
    গৌরী হেসে উঠল, ‘না, অন্যদিন আসব। তোমরা আজ খুব আনন্দ কর’।
    -এরপরে যেদিন আসবে, আমাকে বেশি লজেন্স দেবে, দিদিকে কম। ও সেদিন বেশি নিল।
    এবার শব্দ করে হাসতে শুরু করে গৌরী। আশা আর ঊষা। সত্যিই কী মিষ্টি। ওরা ফোন ছেড়ে দেওয়ার পরও অনেকক্ষণ বুঝি হাসিটা লেগে রইল ঠোঁটে। এক সময় রোহিত দরজায় নক করে, ‘আসব ম্যাডাম?’
    -হ্যাঁ।
    -আজ বাড়ি যাবেন না ম্যাডাম? সাড়ে সাতটা বেজে গেছে।
    গৌরী ঘড়ির দিকে তাকায়, তাই তো! সঙ্গে সঙ্গে বেল বাজাল, ‘অ্যাই গাড়ি রেডি করতে বল। সরি, তোমাদেরও আজ ডিটেন করালাম’।
    -ইটস ওকে ম্যাডাম। আমাদের অভ্যেস আছে। কিন্তু আপনি আজ অপারেশনের ব্যাপারে কিছু ডিসকাস করলেন না তো।
    গৌরী হাসল, ‘এবার বোধহয় ডিসকাশনটা পুরোপুরি থেমে যাবে। আপাতত আমাকে অন্য কাজ দেওয়া হয়েছে’।
    রোহিত হতভম্ব, সব শুনতে চাইল। শোনার পর আপন মনে মাথা দোলায়। চোখ মুখ ফ্যাকাসে।  একসময় বলেই ফেলে, ‘ছোট মুখে বড় কথা হলে, মার্জনা করবেন ম্যাডাম। আপনাকে এই মিশনের কৃতিত্বটা পেতে দেবে না বলেই একটা লবি কাজ করছে। ওরাই আটকে দিল। এই অপারেশনটা না হলে কিন্তু একটা গোল্ডেন চান্স আমরা হারাব। বাবাজী সেদিন, যে বেশেই হোক, ঝিলমিলপুর পৌঁছবেই’।
-তাহলে তোমার সাজেশন কী?
-আপনি আবার ডিজি সাহেবের সঙ্গে কথা বলুন। একটা ছোট খাটো অপারেশন সেদিন চালাবই আমরা। আমাদের টিমে তো ইন্সপেক্টর একজন থাকবেই। সেই লিড দেবে। এখান থেকে আপনি গাইড করবেন।
    বাড়ি ফিরতে একটু রাতই হল। এর মধ্যে আরও বার কয়েক আশা ঊষার ফোন এসেছে। ওর বাবা ভিডিয়ো কল করে দিয়েছিল। ঊষা দেখাল, ‘এই দেখো লাল আইসক্রিম খেয়ে আমার পুরো জিব লাল’।
আশা অমনি ছোঁ মেরে ফোন নিয়ে বলে, ‘জানো কী হয়েছে? ভেলপুরিটা খেতেই পারল না ঝালের চোটে। ভেউ ভেউ করে কী কান্না। তাই তো বাবা আবার ওকে লাল আইসক্রিম কিনে দিল’।
মেয়ে দুটোর মুখে যেন খই ফুটছে। একসময় ওর মা কেড়ে নিল ফোন। বলল, ‘মাডাম, আর একটা কথা তখন জানানো হয় নি। স্যার আমাদের একটা লোনের ব্যবস্থা করে দিয়ে গিয়েছিল। মানেজারবাবুর সঙ্গে সেদিন গিয়ে দেখা করেছি। বলেছে, টাকা অ্যাকাউন্টে ঢুকে যাবে। স্যারকে আমাদের সবার তরফ থেকে নমস্তে বলবেন। ওই টাকাটা পেলে আমার চা দোকান আর একটু সাজিয়ে নেব। আর একটা ঘর ভাড়া করে উঠে যাব। তবে ওদের বাবার এখন সামান্য রোজগার বেড়েছে। অনেক শো রুমে গিয়ে গাড়ি সারাই করছে। সবই স্যার যোগাযোগ করে দিয়েছে’।
খাওয়া দাওয়ার পর ব্যালকনিতে এসে বসল গৌরী। মনে আনন্দ আর বেদনা ফিফটি ফিফটি চলছে। ভাগ্যিস আশা ঊষার ফোন এল।
কলকাতা এখন ঘুমিয়ে আছে। অল্প কিছু আলো, বিন্দুর মতো টিপটিপ জ্বলছে। তবে আকাশে মুঠো মুঠো  তারা। গৌরীর মন ভরে যাচ্ছে। আকাশতারার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে , ‘এত তাড়াতাড়ি আমাকেও নেভানো যাবে না’।
তার এই লড়াই সমাজের বহুরূপীদের বিরুদ্ধে, ভন্ডদের বিরুদ্ধে। শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে। কেউ পরাস্ত করতে পারবে না।
গৌরী স্টাডিতে ঢুকে পড়ল। নতুন করে ছক কাটতে লাগল তার অপারেশনের।
(৮)
আজ অবাক করল সুমনা। ভোর ভোরই ফোন। গলার স্বরে তুমুল খুশি।
-গৌরী, পাহাড় চড়ছি এখন। পাকদন্ডী পথ। উল্টোদিকে মায়ের  লাল টিপের মতো সূর্যটা উঠি উঠি করছে। কী দারুণ!
-সত্যিই দারুণ। – গৌরীও সঙ্গত করল।
-আর একটা পাখি যেন এ পাহাড়ের গাছ বসে ও পাহাড়ের পাখিকে শিস দিয়ে ডাকছে। ভোরে উঠেই তার প্রেম পেয়েছে। বোঝ! হো হো হো।
গৌরী শোনে আর হাসে। যাক, মেয়েটার কাছে অনেকদিন পর খুশি এল।
-শুনতে পাচ্ছ, একটা কলকল শব্দ। ঝরণা, সামনেই। ফোন ছেড়ো না, ঝরণার একটা ছবি তুলে নিই। জানো বিয়ের আগেই ভিকির সঙ্গে একটা ট্রিপ সেরে ফেলেছিলাম, কেউ জানত না, লুকিয়ে লুকিয়ে, হি হি হি। কী এক্সাইটিং ট্রিপ। এই দার্জিলিঙ্গেই।
গৌরী বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। কানে হেড ফোন, ব্যালকনিতে বসে বসে ওর কথা শুনে যায়। মনে হচ্ছিল ঝরণাটা এসে পৌঁছেছে তার সামনে।
-একবার কী হল শোন, আমি জেদ ধরলাম, সারা রাত ঝরণার কাছে বসে থাকব। সেদিন ছিল ফুটফুটে জ্যোৎস্না। ভিকি টেনে হোটেলে নিয়ে গেছে।
সুমনা এখন নিজেই যেন ঝরণা। কথার ফোয়ারায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। তবু ছন্দপতন ঘটাতেই হল, ‘সুমনা, আর কতক্ষণ লাগবে পৌঁছতে?’
-যতক্ষণ লাগে লাগুক না, আমার তাড়া নেই। নেমেছি নিরুদ্দেশের পথে।
-তুমি এই সিমটা পাল্টে নাও, অন্য সিম লাগাও। আমাকে নম্বরটা জানিয়ে দিও। ওই নম্বর আপাতত বন্ধ রাখো।
সুমনার কানে কথাগুলো যেন ঢুকলই না। গৌরী আরও দু চারটে পরামর্শ দিতে চাইল। কিন্তু ও যে ঘোর কাটিয়ে উঠবে না বলেই পণ করেছে। থাক। গৌরী ফোন ছেড়ে দেয়। মুহূর্তগুলো নিয়ে ও খানিকটা সুখী হোক।
আজ একটু দেরিতেই গৌরী অফিস পৌঁছল। ডিজি সাহেবের সঙ্গে দেখা করাটা জরুরি। কিন্তু কপাল মন্দ। আজই ওঁর নানান ব্যস্ততা। চিফ সেক্রেটরির সঙ্গে মিটিং, কখন ভাঙবে, বোঝা কঠিন।
তবে অপ্রত্যাশিত ভাবে একটা কান্ড ঘটে গেল। ডিজি সাহেব মিটিং রুম থেকে বেরিয়ে হ্নতদন্ত হয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন। হঠাৎ মুখোমুখি গৌরী, একটু অবাক হয়ে চাইলেন। ইশারায় জানতে চান, কী ব্যাপার?
গৌরী ফিসফিস করে বলে, ‘আই নিড ইওর হেল্প স্যার। যার জন্যই ছুটে এসেছি। আমি মিটিং শেষ হওয়া  পর্যন্ত অপেক্ষা করব, বাট কথাটা আপনাকে জানাতেই হবে’।
ডিজি কিছু ভাবলেন, বলেন, ‘তুমি অফিসে যাও, আমি এদিকটা ফ্রি হলেই ফোন করছি’।
-ওকে স্যার।
নিজের অফিসে পৌঁছেই গৌরী ইন্সপেক্টর হরি ঘোষকে ডেকে পাঠায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘরের দরজায় একটা ভাঙা চোরা মুখ, ‘মে আই কাম ইন, ম্যাম?’
-আসুন হরিবাবু, প্লিজ কাম।
লম্বা চওড়া একটা স্যালুট করে হরিবাবু। তারপর খুব সন্তর্পনে, চেয়ার টানার ক্ষীণ শব্দটুকুও যেন না হয়, এমন কায়দায় নিজের সরু দেহটাকে আর একটু গুটিয়ে বসে পড়ল জড়সড় হয়ে।
-আজ এখুনি একটা মিটিং ডাকতে হবে হরিবাবু।  বিষয় বস্তু আমি লিখে দিচ্ছি।
হরি ঘোষ একটু কাত হল, একবার ডানে, তারপর বাঁ-য়ে। -‘একটা কথা বলব ম্যাডাম, উইথ ইওর কাইন্ড পারমিশন?’
গৌরী সোজাসুজি তাকাল। হরিবাবু কলারের বোতামে হাত রেখে মাথাটাকে দুদিকে ঘোরাল। -বলছিলাম কী, এ কাজটা বরং অন্য কাউকে দিয়ে করান প্লিজ। আমি আগে কখনও  …
-আপনার পুরো নাম কী হরি বাবু?
হাত জোড়া করে হরি, ‘আমাকে বাবু বলবেন না প্লিজ ম্যাম। গোটা নাম হরিবল্লব ঘোষ’।
গৌরী হেসে ওঠে, ‘বাহ্‌, সুন্দর! অর্ধেক করে রাখেন কেন তাহলে? আর একটা কথা, আপনার শরীরটাও দিন দিন অর্ধেক হয়ে যাচ্ছে। তবে মন আপনার মজবুত। কোন সমস্যা চলছে কি?’
হরি বল্লভের হাত আবার কলারের বোতামে, দু পাশে মাথা ঘোরাতে ঘোরাতে বলে, ‘সুগার, ম্যাডাম সুগার। কাজে এনার্জি পাই না। সব কিছুতেই ভীতি।  টেনশন’।
ঠোঁটের ওপর একটা আঙুল রেখে গৌরী একদৃষ্টে তাকিয়েই থাকে হরিবল্লভের দিকে। এই সময়ে যে কোনও মানুষই অস্বস্তিতে পড়ে, সেও পড়ল। ঘন ঘন দু পাশে মাথা নেড়েই চলেছে। গৌরী হাসল মনে মনে। বেচারা!
-আপনার লেখা রিপোর্ট আমি পড়েছি। অত্যন্ত গোছানো, এবং টু দি পয়েন্ট। – বলেই গৌরী হাসল।   – শুনুন হরিবল্লভ, ওহ্‌, আপনার নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে দেখছি জিব জড়িয়ে যায়। জানেন, আমি অনেকের নামকেই ছেঁটেকেটে ছোট করে ডাকি। -বলেই ও একটু চিন্তা করে। -ক্যাপ্টেন ডাকলে কেমন শোনাবে? ইয়েস, আমি আপনাকে ক্যাপটেন বলেই ডাকব। এখন থেকে ব্লু হেভেনের ক্যাপ্টেন আপনি। মোস্ট সিনিয়র অফিসার, এবং আপনার মধ্যে ধীর স্থির একটা ভাবও আছে। দলকে পরিচালনার ভার আমি আপনাকেই দিতে চাই। তবে কথা দিচ্ছি, খুব ভারী কিছু আপনার ওপর চাপাব না’।
হরি ঘোষ স্ট্যাচু। সামান্য নড়াচড়াও বন্ধ। বলে, ‘আমার ওপর একটু বেশিই ভরসা করে ফেলছেন না তো ম্যাম? আমি কি এত কিছুর যোগ্য?’
-কাজের মানুষ চিনতে আমার চোখ ভুল করে না। এবার উঠুন। নিজেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করে তুলুন।
হরি বল্লভ বেরিয়ে গেল এলোমেলো পা ফেলে। ভেতরে ভেতরে বেশ নার্ভাস, বোঝা যাচ্ছে।
ওদিকে বেলা প্রায় শেষ, কোথায় ডিজি সাহেবের ফোন? ভুলে গেলেন কি তাকে ফোন করার কথা? নিজেই কি একবার … না থাক। তবে বড় সাহেবের অনুমতি ছাড়া তো কিছু করাও যাবে না। গৌরীর ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। এতখানি এগিয়ে এভাবে পরিকল্পনাটা বানচাল করার মানে কী? বাবাজীর চাল থাকতে পারে কি? তার হাত তো কম লম্বা নয়।
মোবাইলটা তখনই বেজে উঠল। অচেনা নম্বর। বুকটা লাফিয়ে উঠল। ডিজি স্যার কি? কিন্তু ধরতেই ওপাশে সুমনা। -এখন থেকে এটায় পাবে আমায়।
-গুড। হোটেলটা সেফ অ্যান্ড সিকিওরড তো?
-একদম। আজ বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি। তবে আশা করছি, কাল পরশু আকাশ পরিস্কার হয়ে যাবে। জানলার বাইরেই তখন কাঞ্চনজঙ্ঘা স্পষ্ট।
গৌরীর মন চঞ্চল। হু আর হ্যাঁ তে জবাব সারল। সুমনা কিছু আঁচ করেছে নিশ্চয়ই। বলে, ‘গৌরী তুমি আমায় নিয়ে ভাব, কিন্তু তুমি নিজেও তো ভীষণ বিপদের মধ্যে, আমি সব জানি। এনিওয়ে সাবধানে থেকো। আর একটা কথা, – সুমনা কিন্তু কিন্তু করে, -ভেবেছিলাম বলব না।
-তাহলে উত্থাপন করলেই বা কেন? চটপট বলে ফেলো নইলে রাতে ঘুম হবে না। – গৌরী হাসছে।
-এটা যদিও তোমাদের ফ্যামিলি ম্যাটার। – সুমনা দ্বিধা কাটাতে সময় নিচ্ছে।- জ্যোতিপ্রিয় সিনহা মানুষটি থেকে সাবধানে থেকো। বছর পাঁচেক আগে সেক্সুয়াল অ্যাসল্টের একটি কেসে উনি জড়িয়ে পড়েন। আমাদের পত্রিকা নাড়াচাড়া করতে চেয়েছিল। ধামাচাপা পড়ে গেছে। আমি অবশ্য তখন ছোট। কলেজে পড়ি। পরে এই কাগজের দায়িত্ব নেওয়ার পর কেসটা রিওপেন করতে চেয়েছিলাম, তুমুল বাধায় বন্ধ করতে বাধ্য হলাম।
গৌরী চুপ করে শোনে। ঘটনাটা তারও জানা।
-তোমাদের দফতরে একটা ফাইলও উঠেছিল ওই কেসের ব্যাপারে। জ্যোতিপ্রিয়র সঙ্গে তখন অনেক নামজাদা লোকও ফেঁসে গিয়েছিল ওই কেসে। কিন্তু বুঝতেই পারছ, রথী মহারথীদের ব্যাপার। ফাইলটা ক্লোজ করে দেওয়া হয়।
গৌরীর ভেতরে হঠাৎ যেন একটা স্পার্ক জ্বলে ওঠে। সুমনাকে আর কথা বলতে দেয় না। তাড়াতাড়ি ফোন ছেড়ে ও ল্যাপটপ খোলে। বিগত দশ বছরের সব পেন্ডিং কেসগুলো একটু স্টাডি করে নিলে কেমন হয়। জ্যোতিপ্রিয়র সঙ্গে আর কে কে জড়িত ছিল ওই কেসে?
ঠিক সে সময়ই ডিজির ফোন, ‘সরি গৌরী, খুব বিজি ছিলাম আজ। বলো, কী তোমার সমস্যা?’

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।