-হুম।- গৌরী চা পানে মন লাগায়। যদিও ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি চলছে, ছোটখাট একটা আমফান এবার সামলাতে হবে।
-খুঁজছিলেন স্যার? – দরজায় দাঁড়িয়েই গৌরী প্রশ্ন করে।
উত্তরে তীক্ষ্ণ একটা প্রশ্ন ছুটে আসে, ‘তুমি সেন্ট্রাল স্টোরে গিয়েছিলে?’
একটু নিরীহ মুখে তাকাল গৌরী, চেয়ারটা সামনে টানে ক্ষীণ শব্দ করে, ‘বসে কথা বলি স্যার?’
প্রত্যুত্তরে অরিন্দমের কাঁচা পাকা-চুলো মাথাটা নড়ল সামান্য -‘সেন্ট্রাল স্টোরে গ্রুপ ডি স্টাফ ছাড়া আর কেউ ঢোকে না। সেখানে তুমি একজন আই পি এস হয়ে … হাউ স্ট্রেঞ্জ! আর ওখান থেকে কোনও ফাইল তোলার আগে আমার পার্মিশন মাস্ট’।
অরিন্দমের চোখ টেবিলে, কিন্তু মুখে অনেক কথা এখনও আটকে আছে। গৌরী দরজা অবধি পৌঁছনোর আগেই, পেছন থেকে শুনল, ‘আবর্জনা ঘাঁটাঘাঁটির দরকার কী? সেটা যখন পরিবার রিলেটেড!’
থমকে গেল তার পা দুটো। তবে মুহূর্তের মধ্যে একটা কথা মাথায় সেঁধিয়ে বসল, জ্যোতিপ্রিয় বা অনুভবের প্রতি অরিন্দম পালের এই মাত্রাতিরিক্ত প্রশয়ের কারণ কী?
রাস্তা চলতে গিয়ে কোনও প্রতিবন্ধকতা এলে, পথ পাল্টানোর অভ্যেস নেই গৌরীর। বরং অমসৃণতার কারণগুলোকে উপড়ে ফেলে একই পথে চলতে সে আগ্রহী। জেদটা তাই চেপে বসল মাথায়। জ্যোতিপ্রিয়র ওই ফাইলে আরও অনেক ভাইটাল কিছু তথ্য ছিল। পুরোটা দেখা হল না। কে কে যুক্ত ছিল ওঁর সঙ্গে, সেটাও জানা গেল না। বিকল্প রাস্তা কী আছে?
সুমনা। হ্যাঁ, এই মুহুর্তে একমাত্র ও। ওদের কাগজ কিছুদিন আগেও নাকি কেসটা নিয়ে নাড়াচাড়া করেছিল।
কিন্তু সুমনার নম্বর যতবারই টেপে, ওপাশটা নীরব। দুটো নম্বরই আশ্চর্যজনক ভাবে নির্বাক! গেল কোথায় মেয়েটা? গতকাল একটু রূঢ় হয়েছিল ওর প্রতি। পরে নিজেই কষ্ট পেয়েছে, আহা, দুখী মেয়ে। প্রথম প্রেমের স্মৃতিগুলো এমন নাছোড়, মুছে ফেলা কঠিন ওর পক্ষে।
ভাগ্যিস, হোটেলের নামটা জানা ছিল, ‘হিল কুইন’। নেটে সার্চ করতেই নম্বর হাজির। কিন্তু খবর যা মিলল, দুশ্চিন্তা দু গুণ লাফিয়ে চড়ল।
-ম্যাডাম তো কোন ভোরে বেরিয়ে গেছেন। একটা গাড়ি এসেছিল নিতে, ওতেই চলে গেলেন।
-কোনও ট্যুরিস্ট কার? বেড়াতে গিয়েছেন কি? জানো কিছু ভাই তোমরা? লাগেজ ছিল সঙ্গে?
-না, না। লাগেজ সব রুমের ভেতর। ওনার কোন জান পহেচেনের সঙ্গে বোধহয় দেখা করতে গিয়েছেন, ওরাই গাড়ি নিয়ে এসেছিল।
গৌরীর ভ্রু দুটো কুঁচকে কাছাকাছি চলে এসেছে। মানে? কারা গাড়ি পাঠিয়েছিল সুমনাকে তোলার জন্য? কার সঙ্গে ও বেরিয়ে গেল?
সবাই মিলে এ কী ষড়যন্ত্র শুরু করেছে তার সঙ্গে! একটুও শান্তিতে থাকতে দেবে না।
মোবাইল বাজছে।
-হ্যালো ম্যাডাম, জেড এগেইন। -হরিবাবুর গলা চনমনে। -এখন আমার হাতে গরম গরম চা। এবার জম্পেশ করে বসে শোনাব আজকের গল্প। সে এক থ্রিলিং এক্সপিরিয়েন্স মশাই। ওহ্, সরি ম্যাডাম, স্লিপ অফ টাং। বেগ ইওর পার্ডন।
গৌরী হাসি চাপে, এ যে দ্বিতীয় ফেলুদার জটায়ু।
হরিবাবু শুরু করল, ‘তখন বেলা একটা দেড়টা হবে। আপনাকে ভিডিয়ো করতে করতে লাইন কেটে গেল। ঠিক করলাম আলো থাকতে থাকতে আশপাশটা দেখে আসি। তা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হাঁটছি তো হাঁটছি, জনশূন্য পথ। কতখানি এগিয়ে এসেছি, খেয়াল নেই, একসময় দেখি পথ বন্ধ, ভাঙাচোরা রাস্তা, তারপরেই গভীর জঙ্গল প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওপাশে কোনও নদী বইছে, কলকল শব্দ। পিছিয়ে আসব কিনা ভাবছি, হঠাৎ বারো চোদ্দোর এক রোগাটে মেয়ে সামনে হাজির, হাতে সরু কঞ্চি, সঙ্গে এক পাল ভেড়া। পরনে ছেঁড়া কালো কোট, মাথায় টুপি। ফর্সা রক্তশূন্য মুখ, আমায় দেখে আরও ফ্যাকাসে হয়ে উঠছে’।
গৌরী মনে মনে হাসে, ওই তো প্যাকাটে চেহারা। হরিবাবুকে দেখে আবার ভয় !
-তা, মেয়েটিকে অমন ভয় পেতে দেখে আমার কেমন সন্দেহ হল। এমন নির্জন, দুর্গম রাস্তায় ও কেন? সামনে তো কোনও বসতিও নেই। তাহলে কি ও কোন সোর্সের কাজ করে? এখানে মেষপালিকা সেজে … হয়তো পাহারাদারি চালাচ্ছে।
গৌরী টানটান হয়। পয়েন্ট!
-এরপর মন দিয়ে শুনুন ম্যাডাম, পুরো থ্রিলার। – হরিবাবু গলা ঝাড়ল, – আমি সঙ্গে সঙ্গে একটা বেচারা ভাব ফোটালাম চেহারায়। হিন্দী, ইংরেজি বাংলা, সব কিছু মিশিয়ে একটা জগাখিচুড়ি ভাষায় বোঝাতে লাগলাম, ঘুরতে ঘুরতে পথ হারিয়েছি। কী যে করি! আমাদের টুরিস্ট দলটা ছেড়ে এসেছি অনেক পেছনে। কী ভাবে ফিরব? নার্ভাস লাগছে।
কথা বলতে বলতে পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বার করলাম। বলি, দারুণ খিদে পেয়েছে গো মেয়ে। কোনও দোকান পসারের খোঁজ দিতে পারো? যদি কাছেপিঠে থেকে কিছু খাবার এনে দাও ভাল হয়। একটু খাবার আর একটু জল। ব্যস, আর কিছু না। তেষ্টায় গলা ফেটে যাচ্ছে। এত চড়াই উৎরাই ভেঙেছি।
গৌরীর গালে হাত, ‘তারপর?’
-পয়সার যে কী মহিমা! ও ছোঁ মেরে নোটখানা নিয়ে কোটের পকেটে পুরল। চারদিক তাকাচ্ছে, ভয় ভয় ভাব মুখে, যেন কেউ দেখে না ফেলে। তারপর কী যেন ফিসফিস করল ভাঙা হিন্দিতে, তখনই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি।
-এই সেরেছে! আর ভেড়ার পাল?
-ও হো, ম্যাডাম। আপনি দেখছি ভেড়াগুলোর প্রতিই বেশি চিন্তিত। তারা আরামেই হেলেদুলে সার দিয়ে চলেছে। কেউ একটু খাদের দিকে বেশি ঝুঁকে গেলে সে মেয়ে দূর থেকেই হ্যাট হ্যাট আওয়াজ দেয়, আবার ওরা সোজা রাস্তায় হাঁটে। যাক, তারপর শুনুন। পাহাড়ি বৃষ্টি, চারিদিক ধোঁয়া। আমার তখন সত্যিই দিশেহারা অবস্থা। মেয়েটা আমার একটা হাত ধরে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের একটা খাঁজের দিকে। তারপর ইশারায় পাহাড় চড়তে বলে। ছুটতে ছুটতে বেশ খানিকটা ওপরে একটা ভাঙাচোরা ঘরের সামনে আমায় নিয়ে থামল এবার ও। ওদিকে আমি তো যাই যাই অবস্থায়। এই বয়সে, ওভাবে ছোটা! মেয়ের বোধহয় মায়া হল দেখে। ওই ঘরের দাওয়ায় একটা ভাঙা টুলে বসতে দিয়ে বলে, বৃষ্টি একটু পরেই ধরে যাবে, তখন পথ চিনিয়ে নিয়ে যাব। খবরদার একা এখান থেকে বেরোবার চেষ্টা কর না। আমি এই ভেড়ার পালকে এক জায়গায় ঢুকিয়ে ফিরে আসছি।
-মেয়েটা কী ভাষায় কথা বলছিল?
-ভাঙা ভাঙা হিন্দি। ধরা যায়। এদিকে বাইরে অঝোর বৃষ্টি। আর ঘরের ভেতর ভূতুড়ে অন্ধকার। আমার করার কিছু নেই। বসে আছি, নির্জন জায়গা! কেউ গলা টিপে মেরে ফেললেও দেখার কেউ নেই।
-হা হা হা। থ্যাঙ্কু ম্যাডাম। সব ওই পাহাড়ি ক্ল্যাইমেটের কারসাজি, বুঝলেন তো। আমায় পুরো চাঙ্গা করে ফেলেছে। নইলে অতখানি সাহস বুকে নিয়ে … যাক গে, মূল প্রসঙ্গে ফিরি। – হরিবাবু গলা খাঁকারি দেয়। – আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল জায়গাটা আদতে জনমানবশূন্য নয়। আশেপাশেই অনেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, আমি দেখতে পাচ্ছি না, ওরা কিন্তু দেখছে।
গৌরী ঠোঁট কামড়ে শুনে চলে।
-একটু পরেই সেই মেয়ে এসে হাজির। হাতে এক গ্লাস গরম চা আর কয়েকটা পেল্লাই সাইজের বড়া। আমার তখন সত্যি পেট চুই চুই দশা। গোগ্রাসে গিলছি। এবং নিশ্চিত হলাম, সামনা সামনি কোনও ঘাঁটি আছে এদের। যেখান থেকে এসব খাবার এল।
-মেয়েটির থেকে কিছু কি বার করতে পারলেন? – প্রশ্নটা গৌরীর মগজে ছোটাছুটি করছিল। মুখ দিয়ে বেরিয়েই এল। – প্রমাণ আছে কি যে ওখানে একটা আততায়ীদের ডেরা আছে?
হরিবাবু হাসে। খুব প্রাঞ্জল হাসি। -‘ওয়েট ম্যাডাম, ওয়েট। শুধু শুনে চলুন। -খক খক খক। আবার গলা ঝাড়া। – আমি তখন হাঁ ভাতের মতন বড়া কটা খাচ্ছি। দেখি মেয়েটির চোখে মায়া মায়া ভাব। সঙ্গে সঙ্গে ভেবে নিলাম এই মায়াকেই এনক্যাশ করতে হবে। খাওয়া শেষ, ওকে ধন্যবাদ দিয়ে বলি, আমার প্রাণটা বাঁচালে হে। আসলে পেটে আলসার আছে তো। আলসার বোঝ? এক ধরনের ঘা, ওতে পেট খালি রাখলেই যন্ত্রণা শুরু হয়। মাঝে মাঝে অজ্ঞানও হয়ে যাই। যাই হোক, আর একটা উপকার করে দাও বাছা। পথটা পার করে দাও। নইলে কোথায় যেতে কোথায় চলে যাব। বলেই কচকচে আরও তিনটে একশো টাকার নোট একটু আড়াল করেই ওর হাতে গুঁজে দিই। তোমার এই উপকার কোনদিন ভুলব না।
-মেয়েটা নিল টাকা?
-নেবে না মানে? ওরা খুব অভাবী ম্যাডাম। আর এই অভাবের সুযোগেই তো এদের দিয়ে নানা দুষ্কর্ম করানো হয়। টাকা পেয়ে ওর চোখ চকচক করছে। আমি মিনমিন করে বলি, বহু ডাক্তার দেখিয়েছি বুঝলে। শেষমেশ শুনলাম এখানে ঝিলমিলপুরে এক বাবাজীর আশ্রম আছে, ওই আশ্রমের মাটি নাকি খুব পবিত্র মাটি। পেটে লেপে দু ঘন্টা বসে থাকলে ঘা শুকিয়ে একেবারে চাঙ্গা।
গৌরী মোবাইলটাকে কানে চেপে রেখেছে। একটা কথাও যেন কানের বাইরে চলে না যায়। হরিবাবু তো গুরুদেব লোক!
-ঝিলমিলপুর আর বাবাজী। মাত্র এই দুটি শব্দেই যেন মেয়েটা শক খেল। আমার ডান হাতের কব্জি খিমচে ধরে ফেলে, না, না। খবরদার না আঙ্কেলজি। ও পথে একদম না। খুন হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি। তুমি ভাল লোক, তাই বলছি। ডাক্তার দেখিয়ে রোগ সারাও।
-কেন গো! আমার বেচারা মুখ। শুনেছি কাল বাবাজীর জন্মদিন। বহু ভক্ত দূর দূর থেকে আসবে। আমি একটু পায়ের ধুলো নেব আর আশ্রমের মাটি মাখব, এজন্যই তো এখানে আসা।
মেয়েটি চুপ। একবার চোখ দুটো ছোট করছে, আর একবার আমায় জরিপ করছে। কিছু বলবে কী বলবে না ধরনের ভাব মুখে। তারপর ফিসফিস করে বলেই ফেলল, ‘ওখানে গিয়ে কিচ্ছু লাভ নেই। আসল বাবাজীকে থোড়ি পাবে? সে পালিয়ে বেরাচ্ছে বনে জঙ্গলে। অন্য এক নকল মানুষ বাবাজী সেজে আশ্রমে থাকবে। আজই দেখো না, রাত বারোটায় যুদ্ধ লাগল বলে। বাবাজীর জন্মদিন পালন হবে। তাকে ধরতে শ শ পুলিশ রেডি। সবগুলো মরবে, বাবাজীর লোকেরা ছক কষেই রেখেছে। ওদের হাতে …
কথা শেষ করতে পারে না মেয়েটি। দূরের জঙ্গল থেকে তখন নিশ্চুপে এক দঙ্গল ছেলে লাইন দিয়ে বেরিয়ে আসছে। বৃষ্টিও থেমে চারিদিকে চকচকে রোদ। মেয়েটা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারা করে, চুপ। তারপর আবার ফিসফিস করে, ওদের দিকে মোটেও তাকাবে না এখন। আর কিছু জিজ্ঞাসাও করবে না আমাকে।
হরিবাবু হাসছে তখনও -আমাদের পুলিশের চোখ ম্যাডাম, ততক্ষণে দেখে ফেলেছি, ওই ছেলেপিলেদের হাতে পিস্তল। এবং কয়েকজনের হাতে এ-কে সিরিজের বন্দুক।
মেয়েটা বলে, চলো, তোমায় আমাদের সীমানা পার করে দিই। খবরদার এ পথে আর কখনও আসবে না। আমি ছিলাম, তাই প্রাণে বেঁচে গেলে, নইলে আজ তোমার ঘরে ফেরা হত না।
হরিবাবুর চায়ের গ্লাসের টুংটাং শব্দ কানে এল। তার মানে কি গল্প শেষ? কিন্তু চা পান করতে করতেই এবার সে দৃপ্ত কন্ঠে বলে, ‘আমার ধারণা এলাকায় একটা কিশোর বাহিনী তৈরি করেছে বাবাজী, যেখানে অস্ত্র শিক্ষা চলছে। এবং এই ঘাঁটিতে অনেক অস্ত্রও মজুত আছে। যদি অতর্কিতে একটা রেইড চালিয়ে দেওয়া হয় … অবশ্য এগুলো আপনাদের বড় বড় মাথার সিদ্ধান্ত। আমার কথা আমি বললাম’।
হরিবাবু ফোন ছাড়ার পর অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে গৌরী। রীতিমত রুদ্ধশ্বাস, রোমাঞ্চকর কাহিনী যেন শুনল। ল্যাপটপ অন করে গুগল ম্যাপটা খুলল সে এবার। একটা ব্যাপারে নিঃসংশয় হওয়া দরকার। এই তো, দার্জিলিং সীমানার শেষ প্রান্তে একটা নদী। রোঙ্গিত। হ্যাঁ, রোঙ্গিত নদীই বয়ে যাচ্ছে দার্জিলিং সিকিম সীমানা বরাবর। পাশেই ঘন জংগল। সব মিলে যাচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গে অনুভবকে ফোন লাগাল। তার আগে অবশ্য নিজের সঙ্গে কিছু বোঝাপড়া করে নিয়েছে। ওপাশে ফোন বেজে গেল, অনুভব তুলল না। কিন্তু মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই একটা আননোন নম্বরে কল এল। গৌরী বোঝে, অপারেশনের দায়িত্ব পাওয়ার পর অনুভব সাবধানী। চেনা নম্বরে কথা বলছে না।
অনুভবের হাল্কা ফুরফুরে গলা শোনা গেল। অবশ্য বরাবরই ও ঠান্ডা মাথার মানুষ। এই ব্লু হেভেনের দায়িত্ব নিয়ে এখন যেন বরফের পাহাড়। মোবাইল ধরেই হাসছে, ‘ছেলেপিলেদের ওপর এত মায়া, বরের প্রতি তার ছিটেফোঁটাও যদি থাকত! এখন কত ফোন আসে তোমার!’
-একটা ইনফরমেশন দেওয়ার ছিল। – গৌরী সরাসরি প্রসঙ্গে আসতে চায়। – আমাদের হরিবাবু …বলেই সবটা জানায় সে। -সুতরাং বি কেয়ারফুল, ওখানে কিন্তু বাবাজীর ডামিকে আজ সাজিয়ে গুছিয়ে জন্মদিন পালনের ছক তৈরি হচ্ছে। কারণটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। শিকারের লোভ দেখিয়ে শিকারিদের স্পটে টেনে আনার ছক।
অনুভব হেসেই চলে, -হরিবাবু তো মার দিয়া কেল্লা করে দেখাল। আজ একটা ঝামেলা বাঁধাবার চেষ্টা চালাবে বাবাজী বাহিনী, এটা আন্দাজ ছিল। কিন্তু নকল বাবাজীর প্ল্যানটা মাথায় ক্লিক করে নি। সোর্স মারফৎ খবর পেয়েছিলাম,ওরা এখানে ওখানে আর ডি এক্সের মতো বিষ্ফোরক রেখে আসার তালে আছে। পরে সেগুলো রিমোটের মাধ্যমে ফাটানো হবে। এতে পুলিশের নজরও এড়ানো যাবে। কিন্তু ওই চক্রটাকে আমি ধরে ফেলেছি। ওরা আপাতত পুলিশি হেফাজতে।
অনুভব কথা শেষে বেশ বিগলিত ভাব দেখাল, ‘দেখো গৌরী, অপারেশনে না থেকেও কতখানি তুমি এই অপারেশনের সঙ্গে জুড়ে আছো। আই ওনার ইওর স্পিরিট।
-তাই! রিটার্ন গিফট কিছু দাও। – গৌরী হাসে।
-কী গিফট চাও বলো না। আরে, তোমার সঙ্গে কি আমার ডিলের সম্পর্ক? সারা জীবন বুঝলেই না আমায়। বলো কী করতে হবে? – অনুভব আজ উদার পুরুষ।
-সুমনাকে খুঁজে দাও। আমার সিক্সথ সেন্স বলছে, ও কোনও বিপদের মধ্যে আছে। আমি সুমনার কোনও খবর পাচ্ছি না।
অদ্ভুত ভাবে চুপ করে রইল অনুভব, একসময় বলে ওঠে, ‘সরি, সুমনার জন্য কিছু করা সম্ভব নয়। ও অ্যাডাল্ট। ইচ্ছাকৃত ভাবে কেউ যদি বিপদ ইনভাইট করে, আমার কিছু করার নেই’।
মানে! একটা মানুষ মুহূর্তের মধ্যে এরকম পাল্টে যায়? অনুভব, সত্যিই তোমায় বুঝতে আমি ভুল করি নি। ফোনটা ছেড়ে দিতেই চাইছিল গৌরী, তার আগেই অনুভব ওপাশ থেকে হিসহিস করে বলে ওঠে, ‘সুমনা স্বেচ্ছায় নিজেকে বিপদের মধ্যে তলিয়ে দিয়েছে। ওর খোঁজ নেওয়া মানে, বাবাজীর সঙ্গে ফালতু আর একটা কমফ্রান্টেশনে জড়িয়ে যাওয়া। আর একটা কথা, তুমি পুরনো ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি বন্ধ কর। অফিসটা তোমার বাড়ি নয়, ওখানকার নিয়ম নীতি মেনে চল, এতে তোমারই মঙ্গল। শুধু শুধু কিছু শত্রু পারচেজ করছ’।
নিজেকে বড় অসহায় লাগল গৌরীর। সুমনার জন্য কি কিছু করা সম্ভব নয়? ও সত্যিই তলিয়ে যাবে?
বাড়ি ফিরেও স্বস্তি পায় না। সুমনার নম্বর ট্রাই করবে কি করবে না, ভাবতে থাকে। ঠিক তখনই মোবাইল বেজে উঠল, হিল কুইনের নম্বর। সুমনার হোটেল। বুকের ভেতরটা কেউ যেন খিমচে ধরেছে। হঠাৎ হোটেল থেকে কেন? ওরা বলেছিল কোনও খবর থাকলে জানাবে।
-ইয়েস গৌরী সিনহা স্পিকিং।
-কী ব্যাপার? তুমি নাকি আমায় নিয়ে ভারি চিন্তিত? – ওপাশে সুমনার গলা, ও হাসছে। – আমার ফোন বন্ধ। হোটেলের লাইন থেকে বলছি।
-কোথায় ছিলে সারাদিন! – গৌরী রাগে ফুঁসছে। – এত ইনসেন্সেবল লেডি তুমি! আমায় কি পাগল করে দেবে তোমরা সবাই মিলে?
সুমনা তবু হাসছে। ‘এত ভালবেসো না গৌরী। কারোকে এভাবে সব দিয়ে ভালবাসতে নেই। কষ্ট পেতে হয়। এই যেমন আমি পাচ্ছি’।
-পদ্মা আর আশিস। * দুই ফুটফুটে প্রেমিক প্রেমিকার আজ গাঁটছড়া বেঁধে এলাম । অভাবের তাড়নায় পদ্মা একটা র্যাকেটের চক্করে পড়ে এই বাবাজীর আশ্রমে পৌঁছেছিল। কিন্তু পরে আবার আশিসের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। মাধ্যম, আশ্রমের ছোট মামনি। সে সত্যিই ভালবাসত মেয়েটাকে। – সুমনা থামে।
-ক্যারি অন। – গৌরীর ভ্রু কুঁচকে আছে।
-আজ পদ্মাকে মুক্ত করে নিয়ে এলাম ওই অভিশপ্ত ঝিলমিলপুর থেকে। ইটস আ গ্রেট অ্যাচিভমেন্ট টু মি। এত শান্তি লাগছে। তবে ওই ছোট মামনির সাহায্য ছাড়া হত না। আগে কথা ছিল বাবাজীর জন্মদিনের রাতে ও বেরিয়ে আসবে। কিন্তু মামনি রিস্ক নেয় নি। আজ ওখানে নাকি খুব বড় গন্ডগোল বাঁধার আশঙ্কা। তাই ভোরেই একটা গাড়ি ভাড়া করে পদ্মাকে সে পাঠিয়ে দেয়। আমি সেই গাড়ি নিয়েই ওকে পৌঁছে দিই আশিসের কাছে। ওরা মন্দিরে বিয়ে করল। আমি সাক্ষী রইলাম সেই বিয়েতে। দুটো ভালবাসা আজ একটা ঠিকানা পেল।
-ওহ, সো নাইস। যেন একটা কবিতা! -গৌরীর গলায় বিদ্রূপ। – আচ্ছা, তুমি জানো না, বাবাজীর নেটওয়ার্ক কত অ্যাকটিভ! লাইটইয়ারের গতিতে তারা ছোটে।
-হুম, জানি। তবু একটা চান্স নেওয়া। আজ একটা জিনিস পরোখ করলাম, পদ্মার ভালবাসার জোর আছে। কীভাবে যে আশিসের কাছে ও-কে পৌঁছতে পেরেছি, তোমাকে বলব আর একদিন।
-শুনতে ইন্টারেস্টেড নই। – গৌরী গম্ভীর। – তাহলে পদ্মার প্রেগন্যান্ট হওয়াটা! সেটা নিছকই গল্প তো! – তোমার কাছে সাহায্য চাওয়া!
-হ্যাঁ। বাবাজীর ছকে তৈরি একটা গল্প। পলাতক হয়েও তার রিমোট কনট্রোলেই সব চলে। তবে পদ্মা সত্যিই ডেসপারেট হয়ে উঠেছিল। শুধু বাবাজী নয়, ওর সাঙাতদেরও কুনজর পড়েছিল মেয়েটার ওপর। গরীব বাড়ির মেয়েদের রূপ যৌবন এক অভিশাপ এ দেশে। তাই আশিসের কাছে সে পৌঁছতে চেয়েছিল যে কোনও মূল্যে। আমি ওর ইচ্ছেটা পূরণ করে দিলাম শুধু। বলো, ভুল করেছি? দুটো ভালবাসায় থৈ থৈ ছোট নদী আজ সাগরে এসে মিলল। আমি ভালবাসার ঘর বাধা দেখতে খুব ভালবাসি জানো। বড্ড কাঙাল এ ব্যাপারে।
গৌরী থমকে যায়। আর রূঢ় হতে ইচ্ছে করল না। শুধু নরম করে বলে, ‘তোমার কাছেও আবার নতুন ভালবাসা ধরা দেবে, দেখো মিলিয়ে’।
-আমি যে ভালবাসার বেসাতি করতে বসি নি গৌরী। আমার প্রথম ভালবাসাই শেষ ভালবাসা। ওকে, গুড নাইট। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। ঘুমোব এখন। তুমি ভাল থেকো, সবাইকে নিয়ে ভাল থেকো।