সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সীমন্তি চ্যাটার্জি (পর্ব – ১৫)

স্রোতের কথা

পর্ব – ১৫

[পরিচয়ের শুভারম্ভ…নাকি…??]

“আর দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নাও… তারপর বিগ্ হলে চলে এসো, সেখানে অন্য ফ্লেজলিংরা আর বাকী’রা আছেন… ওখানে ইন্ট্রোডাকটরি রিচুয়াল আর ডিনার হবে…আর একটু ড্রেস-আপ করে এসো…যা সব ছিরি…”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে সিলভিয়া… (স্যরি ম্যাডাম সিলভিয়া) থামলো…
“কি- কিন্তু ম্যাডাম আমি তো রাস্তা চিনি না…”
সিলভিয়া বিরক্ত মুখে কিছু বলতে যাচ্ছিল…তার আগেই আর একজন উদয় হলেন… সিলভিয়ার ঠিক উল্টো রূপ… সিলভিয়া রোগা কালো লম্বা..আর ইনি হলেন ফর্সা মোটা বেঁটে…ফুলো ফুলো হাসি মুখ…
“ইসপ্যামার রাস্তা চেনা কি এত সোজা ফ্লেজলিং?এ হোলো ম্যাজিকাল প্লেস..আমরা এত বছর থেকেও…”
কথা কমপ্লিট করার আগেই সিলভিয়া ঝামরে্ উঠলো
“ঐ এসে গেছে বাজে বকতে…তোকে না ফ্লেজলিং দের সাথে এত কথা বলতে প্রিস্টেস আলিশা বারণ করেছেন…”
“তুই চুপ কর তো।মোটেই বারণ করেন নি একটু বুঝে শুনে কথা বলতে বলেছেন শুধু…তা ছাড়া তুই তো মনে হয় আসল কথাটাই বলতে ভূলে গেছিস..”
বলতে বলতেই সেই দু’নম্বর বিচিত্র মহিলা আমার দিকে ফিরলেন….
“হেইল নিক্স !!!!” এটা কে রে!!!এত্ত মিস্টি দেখতে…এর মুখ টা তো একদম গডেস হেকেটির মতো সুন্দর..!!
” হুঁহ্…তোর তো সবাইকেই এক এক জন গডেসের মতো দেখতে লাগে…দিন সাতেক আগে যখন ‘আলোহা মুখার্জি’ এসেছিল…তখন তো তোর ওকে গডেস্ নিক্সের মতো লেগেছিল…তার আগে ‘কিয়ারা খান’ কে গডেস কালীর মত লেগেছিল,যত্তসব!!আবার যখন আলোহা মুখার্জি তোর মুখে মেয়োনিজ ছুঁড়ে মারলো তখন তোর ওকে ‘মেডুসার মতো লেগেছিল।”
“ঐ শয়তান মেয়েটার নামও নিসনি।উঃ, গডেস’রা আর মেয়ে পেলো না!ঐ বজ্জাত মেয়েটাকেই স্পেশাল পাওয়ার দিতে হোলো…আমাদের হাড় জ্বালাতে।”
“কথা বুঝে শুনে বল্ সিনথিয়া, ওর মেন্টর কে জানিস তো? হাই প্রিস্টেস স্বয়ং…”
ওঃ ,এনার নাম তাহলে সিনথিয়া…
সিনথিয়া আমার কাছে এগিয়ে এল…
“কিন্তু একে তো দেখে, গুড গার্ল ই…”
সিনথিয়া কথা শেষ করতে পারলো না… সিলভিয়া হাঁ হাঁ করে উঠলো…
“ওই…তুই চুপ করবি?? তোর মনে হওয়া তোর কাছে রাখ…যে কাজ করতে এসেছিস, সেই কাজ কর্ আগে।আমি অন্য ফ্লেজলিংগুলো কে দেখে , কে কে এখনো যায়নি তাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করি।তুই একে ভালো করে বুঝিয়ে দে বিগ ডাইনিং কাম ইভেন্ট হল টা কোন দিকে…তারপর কাল থেকে ও একাই সব জায়গায় যাবে ”
সিনথিয়া আমার দিকে ফিরলো,
“তোমার নাম কি গো বাচ্চা??”
“আমি স্রোতস্বিনী…ম্যাডাম…”
“ওরে…ওরে সিলভিয়া…দেখ…এই মেয়ে আমাকে ম্যাডাম বলেছে…..আর ঐ আলোহা তো নাম ধরেই…আর ওর চ্যালা দুটো আরো বজ্জাত…”
বলতে বলতেই সিলভিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বাকি কথা গিলে নিল সিনথিয়া…”
“সিলভিয়া আমার দিকে ঘুরলো…এই মেয়ে…কি যেন নাম…সো…স্রো…সোঁ…যাকগে মরুকগে… তুমি কি পেলে ??”
আমি কিছুই বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম….
“এ কোথাকার ন্যাকা রে!!!! বলি এই যে রাম ঘুম দিলে… ঘুমের মধ্যে কোন্ গডেস তোমাকে ব্লেসিং গিফ্ট দিলো??” তার উপরই তো নির্ভর করবে কে তোমার মেন্টর হবে..”
কিছুই বুঝতে না পেরে আমি এখনো হাঁ….
“ধূর ছাই মরুক গে, আমার কি….এই নাও, এই ক্লাচ্ ব্যাগ টা ধরো…”
সিলভিয়া আমার হাতে একটা ছোট্ট সোনালি রঙের ব্যাগ গুঁজে দিল…
“এটার মধ্যে যেটা পেয়েছ সেটা নিয়ে ,ফ্রেশ হয়ে ভদ্রসভ্য একটা ড্রেস পরে নিয়ে তাড়াতাড়ি এসো বাপু দেরী হলে কপালে দুঃখ আছে…”
সিনথিয়া ফুট্ কাটলো….”হ্যাঁ বাপু…ডেরেস টা একটু ভালো দেখে পোরো…ঐ আলোহার মতো আবার টু পিস্ বিকিনি পরে চলে এসো না…”
আমি কি বলবো বুঝতে না পেরে তাকিয়েই থাকলাম
সিলভিয়া করিডোরের দিকে ঘুরে চলে যেতে যেতে আমার দিকে কথা ছুঁড়ে দিয়ে গেল…
“বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়ে না থেকে সিনথিয়ার সাথে তাড়াতাড়ি চলে এসো”
সিলভিয়ার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে সিনথিয়া নিজের মনেই বললো…”সবেতেই সর্দারি…. আমি দু মিনিটের ছোটো কিনা…. আমি যে ডেপুটি হাউস সুপারভাইজার…আমাকে যেন পাত্তাই দেয়না”
বলতে বলতেই বোধহয় সিনথিয়ার মনে পড়লো আমি দাঁড়িয়ে আছি…. আমার দিকে ফিরে গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বললো …..
“যাও গো মেয়ে… আমি,মানে ইয়ে, তোমার ম্যাডাম দাঁড়িয়ে আছি… তাড়াতাড়ি করো…কি পেয়েছ…এই ব্যাগে ভরতে ভুলো না..ওটাই কিন্তু আসল…”
আমি ঘরে এসে ভালো করে চার দিক দেখলাম….কি ভরবো,সেটাই তো বুঝতে পারছি না ছাই…
ইসপ্যামার ঘর গুলো সত্যিই অপূর্ব…ঘরের শেপটা একটা পেন্টাগনের মতো….তাতে একটা বিশাল কিং সাইজ বেড, ওয়ার্ডরোব, ড্রেস চেঞ্জের জন্য একটা ছোটো আ্যান্টি রুম, বাথটাবওয়ালা ওয়শরুম….কি নেই….আর রয়েছে একটা বিশাল রেফ্রিজারেটর…যাতে থরে থরে সাজিয়ে রাখা বিভিন্ন রকম সুখাদ্যের সাথে লাল তরলের বোতল গুলোও থরে থরে সাজানো…. এবং আমি জানি ওগুলোতে কি আছে….
অন্যমনস্ক ভাবে সব কিছু দেখতে দেখতে বিছানার কাছে রাখা আমার ব্যাগ টা খুলে জামাকাপড় বার করতে যাবো….ঠিক তখনই জিনিস গুলোর দিকে আমার নজর পড়লো… আমার স্যাটিনের কভার দিয়ে মোড়ানো বালিশের পাশেই রাখা আছে….
একটা ‘ছাই ছাই রঙের স্বচ্ছ পাথর দেওয়া রূপালি ধাতুর তৈরী আংটি’…..’একটা লতা পাতা শেকড়ের মতো জিনিস দিয়ে তৈরি চ্যাপলেট’ (মাথা ঘিরে পরার মুকুটের মতো একটি গয়না)….,একটা টাটকা তাজা বিশাল বড় পদ্মফুল’……আর ‘একটা টকটকে লাল অপূর্ব দেখতে , হিবিসকাস্ বা জবা ফুল’….
আমার এক নিমেষে একটু আগে দেখা স্বপ্ন টা (সত্যিই কি স্বপ্ন?!!) মনে পড়ে গেল….
কিন্তু কথা হচ্ছে ,আমি কোন্ টা নিয়ে যাবো?? সিলভিয়া রা তো বারবার “জিনিসটা জিনিসটা” বলছিল… ‘জিনিসগুলো’ তো বলে নি…
কিন্তু আমি তো কোনো মায়ের আশীর্বাদ ই ফেলে যেতে পারবো না, আমার চার’জন মা ই যে আমাকে বড়ো ভালোবেসে এগুলো দিয়েছে….যা হয় হোক , আমি চার’টে জিনিসই মাথায় ঠেকিয়ে ব্যাগে ঢোকালাম…
“কই গো মেয়ে…হলো তোমার???” বাইরে থেকে অধৈর্য্য সিনথিয়ার গলা ভেসে এল…
কোনো মতে একটা গোলাপি হুডি আর ব্লু জিনস্ পরে…মুখে দিম্মার বানানো খানিকটা ক্রিম আর আমার পছন্দের প্রিয় গোলাপী লিপবাম টা ঘষে নিলাম… আমার ঢেউ খেলানো ,বাদামী রঙের অজস্র চুল এলোমেলো হয়ে খোলাই রইলো…এখন অত চুল আঁচড়ানোর মতো সময় নেই…
বাইরে আসতেই , সিনথিয়া মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো….”বাঃ…এই বার ঐ শয়তান মেয়েটা আর ওর চ্যালা গুলো জব্দ হবে… সোঁত, তুমি এই সিঁড়ি দিয়ে নেমে সোওওজা এগিয়ে যাও পূব দিকে…দেখবে গডেস্ নিক্সের বিশাল স্ট্যাচুর পাশে যে আলো ঝলমলে বিরাট কাসল্ টা.. উপরে ‘স্যল কমিউনুটেয়ার’ লেখা আছে…তার নীচের বিশাল হলটায় ঢুকে যেও… আমি একটা জিনিস করতে ভুলে গেছি…একটু প্রিস্টেস ডায়ানার সাথে দেখা করে আসি…কি পারবে তো??”
নিজের মনে হাঁটতে হাঁটতে….চারপাশটা দেখছিলাম কি অপূর্ব ইসপ্যামার ভিতর টা…যেন একটা ফুলের বাগানে, সাজানো জঙ্গলে ঘেরা বিশাল শহর…. আশেপাশে ইতস্ততঃ ছড়ানো বিশাল বিশাল কয়েকটা ছোট বড় কটেজ এবং কাসল্… রাস্তার দুপাশে স্নিগ্ধ আলো…অথচ তার উৎস অজানা… আধুনিকতা ও প্রাচীনতার সুষ্ঠু মেলবন্ধন।
“হাই…স্রোত… ওয়েলকাম হোম….”
চমকে ফিরে তাকালাম….আর সপ্তমবার তার মুখোমুখি হলাম…ব্ল্যাক টি-শার্টে এরিক কে অসাধারণ সুন্দর লাগছে…
“তোমাকে ঠিক এই ফুলটার মতই ন্যাচরাল ,পবিত্র আর সুন্দর লাগছে…”
বলতে বলতেই এরিক পাশের ঝোপ থেকে হাত বাড়িয়ে একটা আধফোটা গোলাপ তুলে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলো….
আমি লজ্জা পেয়ে কি বলবো বুঝতে না পেরে একটু হেসে গোলাপটা নিতে হাত বাড়ালাম….
“এরিইইইইইইক!!!!” হোয়্যা দ্য ফা*…কি চলছে এখানে??”
একটি মেয়ে যেন মাটি ফুঁড়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো….পরনে অসম্ভব দামি এক সিক্যুইনড্ স্মল স্মল স্মল ব্ল্যাক স্কার্ট আর অফ সোলডার রেড ক্রপ টপ্…মোমের মত সুন্দর পায়ে একফুট লম্বা স্টিলেটো,
মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবদি পালিশ করা…
আমি ওকে দেখেই চিনতে পারলাম….সুপার মডেল আ্যাঞ্জেল আলোহা… আমাদের হস্টেলের প্রায় সব মেয়েদেরই ফ্যাশন আইকন..কি কি সব যেন বিউটি প্যাজেন্টেরও উইনার…এর কথাই তাহলে সিলভিয়া রা বলছিলো..!!! এও ইসপ্যামায় সিলেক্টেড!!!
“এরিক… তুমি আমার বি – এফ হয়ে , এই ফুল টা হাতে নিয়ে এই ট্যাকি,ডাউনমার্কেট , বিচ্ টার সামনে ঠিক কি করছো??”
আমার আর এরিকের দু’জনের মুখই নিমেষে লাল হয়ে গেল…. এরিক অসহায় ভাবে বলার চেষ্টা করলো
“আলোহা প্লিজ্”….এরিক কে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে আলোহা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো…উল্টো দিকের আলোতে ওর কানের দু’ক্যারেটের হীরের দুল ঝলসে উঠলো…
আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভালো করে মেপে নিয়ে আলোহা বলে উঠলো..
“ওঃ গডেস্!! ইসপ্যামার স্ট্যান্ডার্ড কি এখানে এসে নেমেছে..এই চিপ্ ন্যাস্টি মেয়েদেরও আজকাল সুপার পাওয়ার থাকছে!!!”
আমার আর সহ্য হোলো না…আমি বলে উঠলাম
“তোমার আচরণ আর ল্যাঙ্গোয়েজ দেখে আমার ও জাস্ট এক্ষুনি এই কথাটাই মনে হলো ,আলোহা অর হুএভার…ইউ আর ”
“কি!!! কি বললি তুই…? ইউ…” আলোহার মুখ টকটকে লাল
“এক্স্যাক্টলি যা তুই শুনলি…”
আমার ঠান্ডা মাথায় উত্তর…
“আর তোর যদি এত ইনসিকিওরিটি থাকে, তোর বি – এফ কে নিয়ে, তাহলে তাকে চেন দিয়ে বেঁধে রাখবি এরপর থেকে..” বলতে বলতেই আমি পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলাম…..
“ওই বিচ্….পালাচ্ছিস কেন?? শোন,…আমি এই গ্রূপের হেড গার্ল আর তোর ক্যাসটিগেশনে আমি তোর কি হাল করবো,…তুই ভাবতেও পারছিস না…”
আমি থেমে পিছনে ঘুরে তাকালাম….
“আমি যখন ভাবতে পারছিনা তখন তুই ই আমার হয়ে বসে বসে ভেবে ফেল্… ইউ ক্রেজি স্লাট…. আর যখন ভাববি….তখন এটাও ভেবে নিস্ যে….আমার থেকে দূরে না থাকলে তোর এই সুন্দর মুখ আর সুন্দর থাকবে না…পুরো জিওগ্রাফি চেঞ্জ হয়ে যাবে “
বলতে বলতেই… রাগে আর বিস্ময়ে কাঁপতে থাকা আলোহাকে …আর লজ্জিত এরিক কে পিছনে ফেলে আমি দৃঢ় পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম…আর একবারও পিছন দিকে না তাকিয়ে…..

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।