• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সীমন্তি চ্যাটার্জি (পর্ব – ৯)

স্রোতের কথা

পর্ব ৯

শৌনক শৌনক…
* তুই আমার সাথে এটা করতে পারিস না সীনি…তুই আমাকে এইভাবে একা ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে পারিস না…নোওওও…ইউ কান্ট ডু দিস্ টু মিই… আমরা দুজন প্রমিস করেছিলাম…কেউ কাউকে কোনোদিন ছাড়বো না… আমাদের এত ফিউচার প্ল্যানিং…এত স্বপ্ন…সব… সঅঅব শেষ! এটা কি করে হতে পারে! সীনি প্লিজ্… চল আমরা পালিয়ে যাই…..
** আমার হাত টা ছাড় শৌনক…আমার লাগছে…
* লাগুক…আমার কষ্ট হচ্ছে না?তোর একারই লাগছে? ওঃ তোর কেন কষ্ট হবে বল্?? তুই তো চোজেন্ …তোকে নিয়ে এখন সবাই গল্প বানাবে…তুই হিরোইন হয়ে যাবি…ফেমাস হয়ে যাবি…তাই তো আমাকে ছেড়ে যেতে তোর একটুও বাঁধছে না…
** শৌনক…প্লিজ্ …এ সব কথা বন্ধ কর…তুই ভাবতেও পারবি না আমার এখন কী মনের অবস্থা… আমি কি নিজে এই সিচুয়েশন বেছে নিয়েছি? বল্? না.. কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে আমি কি চাই?
* তাহলে কেন সীনি? কেন যাবি তুই ঐ ভূত পেত্নী দের কলেজে? তুই কি ওদের মতো? বল? তুই তো আমার সীনি…
আমি অসহায়ের মতো শৌনকের লাল হয়ে যাওয়া মুখ আর জল ভরা মায়া মাখা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে রইলাম…কি করে ওকে বলি? আমি কি সত্যিই ওর মতো?কাল যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে…আমার এতোদিনের আমি টা যে আসলে একটা অন্য‌ কেউ…সেটা শৌনক কেন? কাউকেই কি কখনো আমি বলতে পারবো? আমি নাকি ভ্যাম্পায়ার !!আমি নাকি উইচ্ !! আমি লাঞ্চে কি খেয়েছি ?!না রক্ত….. কিসের রক্ত ভগবান জানেন…মানুষের না কি কে জানে…ভ্যাম্পায়ারের কম গল্প তো আর শুনিনি…ওরা নাকি কালো ড্রেস পরে উড়ে উড়ে বেড়ায়…আর মানুষ পেলেই রক্ত খায়…লম্বা লম্বা চার’টে ক্যানাইন দাঁত দিয়ে মানুষের নরম ঘাড় গলার রক্ত খাওয়া ছাড়া আর কিছুই ওরা জানে না।….
কাল ফেরার পর থেকে অন্ততঃ কুড়িবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দাঁত গুলো পরীক্ষা করেছি…নাঃ…সেরকম অস্বাভাবিক তো কিছুই দেখতে পাইনি( দেওয়ালে চড়া টা ভাবলেও তো নিজের ই ভয়ে গা শিউরে উঠছিল )!!
কাল যে কখন ,কিভাবে, কোন মানসিক অবস্থায় রয়্যাল পেন্ট হাউস থেকে ফিরে এসেছি …নাঃ আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি…, মিরান্ডা ম্যাম চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই একজন সার্ভিস আ্যাসিস্ট্যাট আমাকে সসম্মানে পথ দেখিয়ে এক বিলাসবহুল গাড়ি করে অতি যত্নে আমাকে আমার হোস্টেলে পৌঁছে দিয়েছে।
কিন্তু আমি ওসব দেখার অবস্থায় ছিলাম না… আমার মানসিক চেতনা কেমন যেন আচ্ছন্নতার ঘোরে চলে গিয়েছিল। তবে…. হোস্টেলে ফিরে অবাক হয়ে দেখলাম এত কিছুর মধ্যেই সেই লাল লিকুইডের (যেটা নাকি রক্ত…ইয়াক্ ইয়াক্… আমি তো ভালো মতো ওটা খেয়েও নিয়েছি… ) বোতল টা কিন্তু আমি ঠিক নিয়ে এসেছি।
বাইরে থেকে মন কে না হয় এটা বোঝালাম মিরান্ডা ম্যামের অর্ডার আমি কি করে না করার সাহস পাই…কিন্তু নিজের অন্তরের গভীর গোপনে আমার নিজের ও কি সেই অপূর্ব স্বাদের লোভ নেই? এত অপূর্ব স্বাদের একটা জিনিস কি করে রক্ত হতে পারে !!এক আধবার আঙুল কেটে টেটে গেলে রক্ত বন্ধ করার জন্য আমার নিজেরই রক্ত হয়ত কখনো নিজের মুখে ও দিয়েছি …কিন্তু সেই রক্ত তো নোনতা নোনতা বিশ্রী আঁশটে গন্ধ যুক্ত…এই অমৃতের মতো স্বাদ তো তার কোনোভাবেই নয়।জানি না কিচ্ছু জানি না, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না… যতো ভাবছি ততই মাথার ভিতর টা কিরকম করে উঠছে …আমিই কেন?হে ভগবান… সবসময় আমার সাথেই কেন এরকম অস্বাভাবিক জিনিস ঘটে !! আমার কি অপরাধ?
এই সব ভেবে ভেবে কাল সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারি নি…আজ সকালে হোস্টেল ওয়ার্ডেন আমার ঘরে এসে ( এতদিন যাকে দরকার তাকে নিজের অফিসে ডেকে পাঠাতেন, এই প্রথম বোধহয় উনি নিজে থেকে কোনো স্টুডেন্টের ঘরে এলেন… ) বললেন প্রিন্সিপল্ ম্যাম আমাকে এক্ষুণি দেখা করতে বলেছেন…
প্রিন্সি ম্যামের অফিসের দিকেই যাচ্ছিলাম…রোদে তাকাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল…তাই হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে হাঁটছিলাম…কখন যে শৌনক এসেছে দেখতেই পাইনি…ও আমাকে একটা হ্যাঁচকা টান মারতে চমকে উঠেছি…কিন্তু ও কোনোদিকে না তাকিয়ে আমার হাত ধরে টেনে আমাদের সেই আড্ডা মারার নির্জন জায়গাটা যেটা লাইব্রেরি বিল্ডিংএর ঠিক পিছনের পার্ক টার লেকের পাশে…আমাদের বহুদিনের স্মৃতি জড়ানো রাঁদেভূ … সেইখানে নিয়ে এসেছে…
“শৌনক…প্লিজ্ একটু বোঝার চেষ্টা কর… কোথায় পালাবো বল্ ? যেখানেই যাবো , সেখানেই ধরা পড়ে যাবো, …আর কোনো উপায় নেই রে…ধরে নে আমাদের জার্নি এই অবদি ই ছিল… এটা ই আমাদের ডেস্টিনি…এটা আমাদের মেনে নিতেই হবে।”
‘মানি না …মানি না… আমি কিছুতেই মানবো না কেউ তোকে আমার থেকে কেড়ে নিতে পারবে না সীনি…কেউ না…কেউ না…’
শৌনক আমাকে এক টানে কাছে এনে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার কাঁধে মুখ গুঁজে দিল…
এখন আমার মুখ টাও শৌনকের গলার এক পাশে…ওর গা থেকে হালকা একটা পুরুষালি পারফ্যুমের গন্ধ আর তার সাথে শৌনকের নিজস্ব একটা গন্ধ মিশ্রিত হয়ে আমার নাকে এসে ধাক্কা মারলো…তবে সব ছাপিয়ে আর একটা মাতাল করা গন্ধ ওর শরীর থেকে উপচে উঠছে…ঠিক…ঠিক সেই বোতল টা থেকে পাওয়া কালকের সেই লাল পানীয়টার মতো একটা গন্ধ… কিন্তু যেন আরো মন মাতানো… আরো পাগল করা…উফ্… আমার শরীরের মধ্যে যেন একটা বিস্ফোরণের মত কিছু ঘটলো… আমি নিজের অজান্তেই শৌনককে আরো ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে ধরলাম…আসলে সেই গন্ধ টা আমি আরো আরো ভালো করে পেতে চাইছিলাম…
শৌনক হয়তো ভাবলো আমি ওর ইমোশনের রেসপন্স দিচ্ছি…ও ও আমাকে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো… আমি নিজের অজান্তেই আস্তে আস্তে শৌনকের গলায় মুখ নাক ঘষতে শুরু করলাম…শৌনক অস্ফুট আওয়াজ করে উঠলো…আর…ঠিক তখনই আমি অনুভব করলাম আমার মুখের ভিতরের পরিবর্তন টা…আমার চারখানা ক্যানাইন দাঁত ই আস্তে আস্তে মুখের বাইরে বেরিয়ে আসছে…আর…আর…শৌনকের নরম গলায় ওগুলো বসিয়ে যদি ওদের কাজ ওদের করতে না দিই…তাহলে আমি হয়তো মরেই যাবো। ওঃ মাঃ
আমি আস্তে করে জিভ টা দিয়ে শৌনকের গলার পাশ টা একটু চাটলাম…শৌনক আমার নাম ধরে গুঙিয়ে উঠলো…ওহহ্ সীনি…আই লাভ ইউ…আমি মুখটা খুলে আস্তে আস্তে শৌনকের গলাটা আমার আপার জ্ র ক্যানাইন দাঁত টা দিয়ে স্পর্শ করে…ওঃ নোওওওওও
শৌনককে এক ধাক্কায় আমার থেকে দূরে ঠেলে সরিয়ে দিলাম…এতো জোরে…যে শৌনক ছিটকে পড়ে গিয়ে আমার দিকে প্রচন্ড অবাক চোখে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো…
আমি মুখে হাত দুটো চাপা দিয়ে রেখেছিলাম… কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারলাম তার কোনো দরকার নেই…শৌনক আমার থেকে সরে যাওয়ার সাথে সাথেই এক নিমেষেই সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
আমি কাঁপতে থাকা হাত টা ঠোঁটের উপর থেকে সরিয়ে এনে আমার মুখ টা…কপালের উপর থেকে চোখের উপর গড়িয়ে পড়া ঘাম টা ভালো করে মুছে নিলাম…আমার সারা শরীর টা থরথর্ করে কাঁপছিলো… আমার এতো দূর্বল লাগছিলো যে আমি যেন দাঁড়িয়ে থাকতেও পারছিলাম না … আমি তখনো মাটিতে পড়ে থাকা শৌনকের হতচকিত মুখটার দিকে তাকালাম… গলা টা কোনমতে পরিস্কার করে বললাম…’তোর আর আমার মধ্যে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে শৌনক… এভরিথিং ইস ওভার এ্যান্ড ফিনিশড্ বিটুইন আস্…. আজকের পর থেকে তুই আর কোনোদিনও আমার সামনে আসবি না… কোনোদিনও না…যদি আমাকে তুই এতটুকু ও ভালো কোনোদিন বেসে থাকিস…তুই আমার এই ডিসিশন্ কে অনার করবি’…এই বলে আমি এক ঝটকায় পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলাম…আমার চোখ উপচে গড়িয়ে পড়া গরম চোখের জল আমি শুধু শৌনক কেন…কারোকেই কোনোদিন দেখাতে চাইনা
“সীনি এক মিনিট দাঁড়া”…শৌনকের গলায় এমন কিছু একটা ছিল…যা আমাকে থামতে বাধ্য করলো…তবে আমি ওর দিকে পিছন ফিরেই দাঁড়ালাম… নিজের এই মুখ টা শৌনক কে দেখানোর প্রবৃত্তি আর আমার ছিলো না…
“সীনি …তুই কোথায় যাবি, কতদিনের জন্য যাবি…. আমি এখন জানি না…জানতে চাইবো ও না…তবে যাওয়ার আগে একটা কথা ভালো করে জেনে যা…তুই পৃথিবীর যেখানেই…যে প্রান্তেই থাকিস…এমন কি যদি পৃথিবীর বাইরে ও থাকিস… আমি যেদিন ই হোক…যে ভাবেই হোক…তোকে ঠিক খুঁজে বার করবো…আর এটা করা থেকে আমাকে কোনো ভূত…কোনো ভগবান…কোনো অবতার …কোনো মানুষ …কেউ আটকাতে পারবে না…তুই আমার… আমার…টু ইনফিনিটি এ্যান্ড বিয়ন্ড…এই কথাটা মনে রাখিস…

শৌনকের শেষ কথা গুলো আমার কানে খানিকটা অস্পষ্ট হয়ে ভেসে এল… কারণ আমি তখন দৌড়তে শুরু করেছি…আর হাজার চেষ্টা করেও কান্নার শব্দ চাপতে পারছি না…এই অবস্থায় হঠাৎ টের পেলাম…
আমার জিন্সের পকেটে থাকা মোবাইল টা আমার ই মতন কাঁপতে কাঁপতে বাজতে শুরু করেছে।

এবার আমার নিজেকে স্বাভাবিক করার পালা…

‌ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।