সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে হেমন্ত সরখেল (পর্ব – ১)

তাপ – উত্তাপ

পর্ব – ১

‘পারলে, একবার রোদ্দুর হয়ো, জীবনে যে বা যারাই আসুক, এতো অন্ধকার নিতে পারবে না |’
‘আর উত্তাপ দিও ঐ রাস্তার উলঙ্গ শিশুটাকে…’
মনে মনে আওড়াই | নির্ঝর-এর কথা মনে পড়লে, ওর রোদ্দুর হওয়ার মশবিরা মনে পড়লে | ওর কাছে শেষটায় একটা কালো ঘুটঘুটে অন্ধকারের তাল ছাড়া কিছু ছিলাম না আমি | কাজেই, অবজ্ঞায় ছুঁড়ে দেওয়া অভিশপ্ত শব্দশ্মশান যত্নে রেখেছি আজও |
যেমনটা হয় আর কী! সেকেণ্ড ইয়ার আমার, ও ইলেভেন-এ ভর্তি হলো। কী দেখতে মাইরি ! হেলেন কেলার ফিকে | অ্যান্টিক বস্তু যদি শো কেস-এ থাকে পথচারী উঁকি মারবেই | আর এটা নিতান্ত অঘটন যে, ওর ভর্তির জন্য পার্টির তরফ থেকে ব্যাপারটা জি.এস. হিসেবে আমাকেই দেখতে হলো | ধন্যবাদ অন্তে ‘পুনর্বার মুলাকাত হোনা মাংতা’ শুনে মিষ্টি হেসে চলে গেল | নিতাই’দা ক্লার্ক, খবর পাঠিয়ে দিলাম নির্ঝর গায়েন-এর ফি-বুকটা যেন কারো হাতে না দ্যায় | নিউ ক্যান্ডিডেট হিসেবে জিত পক্কী! তবে তার জন্য কিছু তো হাতে রাখতে হয়! ফি-বুকটা রইল |
যতটা সহজ ভাবা হয়েছিল, ততোটাই কঠিন ছিল সেবারের ইলেকশন। নির্ঝরকে জেতাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হলো | কারণ, ও মুখ হলসা | ক্যান্টিনে, লাইব্রেরির সামনের বারান্দায় ওকে ঘন্টার পর ঘন্টা বুঝিয়েও অবস্থাটা বদলানো যায়নি | ক্লাসের অধিকাংশ স্টুডেন্টরা ওকে অপছন্দ করতো | টাস টাস কথা, কাউকে রেয়াত না করা,অহেতুক অপমানজনক মন্তব্য করে বসা ওর ছবিটাকে মেঘে ঢাকছিল | তবুও, লেলিহান রূপের টানে পুড়তো ছেলেগুলো, ওরা জানতো, জি.এস. ওর কাঁধে হাত রেখেছে | মুখে যতটুকু সম্ভব, সেটুকু ছাড়া কাছাকাছি আসার চিন্তাও বিপজ্জনক | বললে হবে? খরচ আছে | অলি বিনে ফল ধরে না গাছে | ও ঘন হচ্ছিল, আমি গলছিলাম |
দু’মাস বাকি ফাইনালের | কিস্স্যু পড়া হয়নি | একটু না বসলে চলছে না | বাড়ির অর্থনীতি বাবার ট্রাম কোম্পানির মতোই ঢিকির ঢিকির | দু জোড়া চোখ অনেক আশা নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকে আমার মুখ | ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলে দ্যায় | ফিরে তাকালেই বুঝতে পারি এই ঝুপ করে নিচু হয়ে গেল ওরা | একটু পরেই মা ব্যস্ত হয়ে পড়ে মিথ্যে কাজে | বাবা নেই ভোল্টেজে পেপারটা খুলে সমানে চশমাটা ঠিক করে চলে | আমার বইয়ের অক্ষরগুলো সিকি আধুলি কয়েন থেকে বিভিন্ন সংখ্যার নোটে পরিবর্তিত হয় | বুঝি, এবার তেল চাইছে ঘানি | অভাবের তীক্ষ্ণ ডাক ওঠে কোনো কোনো দিন মাঝ রাতে পাশের ঘরের টালির চালের নিচে, ‘না থাকলে আমি কী করবো ? ফুরিয়ে গেছে | আমি তো আর ডাল বেচে দিইনি বোসের দোকানে ! সে তো মাসের প্রথমেই দেড় কেজি কিনেছিলে ! প্রতিদিনই চাই! খোঁজ নাও ? কী দিয়ে কী করি ?’
‘ আস্তে! বাবু জেগে যাবে !’
‘যাক, এবার তো শুনুক ! আর কতো পড়বে !’
অ্যাতো চেপে কি দীর্ঘশ্বাস ছাড়া যায়! তবু অভ্যাস করি,ভেঙে ভেঙে,ক্ষেপে ক্ষেপে আলতো করে ঘরের স্তব্ধ বাতাসে মিশিয়ে দিই | বুড়ো মানুষটার বিড়ির ধোঁয়ার মতো সরু হয়ে মশারির গা ঘেঁসে ভাসতে থাকে লজ্জা | কষে বলি নিজেকে, ‘অনেক হয়েছে,আর নয়, এবার পড়তেই হবে,নইলে রেজাল্ট হবে না…’
হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে এল আমার ক্লাসে | সবে ডায়রিটা হাতে নিয়েছি বেরোব বলে, কব্জিটা চেপে ধরে টেনে বার করে নিয়ে এল সবার সামনে থেকে, ‘চলো,কথা আছে।’ সকলেই জানে ওকে, কেউ ঘাঁটায় না, কী বলে ফেলবে কখন! আকুপাংচার হয়ে যাবে প্রেস্টিজের | সোজা লাইব্রেরির বারান্দায় | প্রায় চারটে বাজে, গুটিয়ে নিচ্ছে কলেজ নিজেকে | বারান্দাটা শুনশান | ঠেসে ধরলো আমায় দেয়ালে | কলার মুঠোয় ধরা | আমি ‘থ! নিজেকে মিশিয়ে দিচ্ছে যেন, নিশ্বাস ঘন! টের পাচ্ছি ওর বুকের চাপ আমার দেহে | চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করে বললো, ‘কাল থেকে সন্ধেবেলা এক ঘন্টা করে আমায় এডুকেশনটা পড়াবে | নইলে পাশ করতে পারবো না | ঠিক ছ’টায়, আমাদের বাড়িতে | মনে থাকবে তো? ঠিক ছ’টা, আমার অপেক্ষার যেন বাঁধ না ভাঙে, খেয়াল রেখো |’
‘কিন্তু আমারও তো পড়া আছে ! কিছুই কমপ্লিট হয়নি এখনও…’- পেছন থেকে বলার চেষ্টা করলাম। সিঁড়িতে পা রাখার আগে সর্পিল ভঙ্গিতে ঘুরে বললো,’তোমার মতো মেরিটোরিয়াস নই আমি,কাজেই গুরুত্ত্বটা পাবো এটা আর নতুন কী!’ আর একটাও কথা খরচ না করে নেমে গেল নিচে,দাঁড়িয়ে রইলাম চুপচাপ | কিছু বলার নেই, যেতেই হবে | জানি,এখানে একটু পেতে হলে দিতে হয় অনেকটা |
দিলাম | শিক্ষণ-বুদ্ধি-অন্তর্দৃষ্টি-পাঠ্যক্রম’এর চক্করে খাবি খেতে লাগলো আমার দাক্ষিণাত্য-রাজসিংহ | রজনী’র অন্ধত্ব, বইয়ের পাতা থেকে উঠে ছেয়ে ফেললো মন-মস্তিস্ক-বোধ, গ্রাসের কবলে চারিত্রিক ঋজুতা | কমলাকোয়া ওষ্ঠের প্রবল তারণে উড়তে লাগলাম সামুদ্রিক তুফানগ্রস্থ বিদ্ধস্ত জাহাজের ভগ্নাংশের মতো | হঠাত এক কালবৈশাখীর সন্ধেয় একে একে খুলে গেল পাপড়ি, পেলবে-কাঠিণ্যে ধুন্ধুমার সে যুদ্ধের সাক্ষী ছিল না কেউ, শুধু দুর্দমনীয় বৃষ্টির ছাঁট ভিজিয়ে দিচ্ছিলো দুটো মাথা, জলের ছিটেয় ভিজছিলো আমাদের চুল,মুখ | সেদিন জেনেছিলাম, জলকণায় অ্যাতো সুখ লুকানো থাকে | ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে বাস্প হয়ে উড়ে যাচ্ছিল দুটো পুড়তে থাকা শরীর থেকে | দুটো ঝড়ই একসঙ্গে থেমেছিল সেদিন | হতাশা, হ্যাঁ, হতাশা নিয়েই সেদিন ভিজতে ভিজতে ফিরেছিলাম বাড়ি |
কী হারিয়েছি আমি ? পুরুষের কিছু হারায় নাকি ? এটাই শুনে এসেছি বন্ধুদের মুখে,গর্বোক্তি | পুরুষ বীর, বীরভোগ্যা বসুন্ধরা | সম্ভোগে নিঃস্ব হয় নারী | আমার তো উল্লসিত হওয়া উচিত! বন্ধু’রা আমার জায়গায় হলে অবশ্যই হতো, কিন্তু আমি পারছি না | সেই কৈশোর থেকে নিজেকে বেঁধেছি, ‘অর্থহানি হানি নয়, স্বাস্থ্যহানি কিছু ক্ষয়,যার গেল চরিত্র তার সবটুকুই লয়’- না, না, উচিত হয়নি, একদম না ! অথচ যেদিন প্রথম গেলাম,সেদিন থেকেই প্রলুব্ধ করে চলেছে নির্ঝর | অহেতুক খসেছে বুকের কাপড়, নির্লিপ্ত থেকে উতসাহ জুগিয়েছে আমার ভেতরের লোলুপ রসনাকে | পেছন থেকে অযাচিত স্পর্শে বারবার দ্বৈরথে টেনে আনতে চেয়েছে আমায় | আমন্ত্রণমূলক অভিসন্ধিতে আমার মাঝে তৈরি করেছে নেশা | গায়ের গন্ধ চিনতে পারছিলাম ওর | রমনতৃপ্ত মুখের হাসি যেন বলছিল, বিজয়ী আজ ও ! আর আমি ? আজকের পর, কপর্দকশূন্য এক পোষ্য! যেন এই স্খলনটুকুই ওর কাম্য ছিল ! নাঃ! এখন আর দোষবিচারে লাভ নেই | শেষ করেছি নিজেকে, নিজে হাতেই | ওজ বিলিয়ে দিয়েছি শ্মশানে |

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।