সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৩১)

ইচ্ছামণি

পর্ব ৩১

বাড়িওয়ালির গজগজানি এইসব যুক্তি শোনার পরেও থামতে চায় না। কিন্তু আজ আর কথা বাড়াল না। কেমন বিনা বাক্য ব্যয়ে রুমা ভেবে ছাদের চাবি দিয়ে দিল ঐ মেয়েটাকে! ঘরের মধ্যেই দরদরে ঘাম আর ঘামাচির চিড়বিড়ানি। রোদে বেরোতে হল না বলে বেজায় আনন্দে এক চক্কর নেচে নিল রুমা। ওপরে গিয়ে শুধু গুবলুকে নিয়ে এল।
গুবলু বলল, “কী হয়েছে মা? ছাদে গিয়ে ঘেমে গেছ?
“কোথায় আবার ছাদে গেলাম?..” এই যাঃ! মুখ ফস্কে বেরিয়ে যাচ্ছিল। গুবলু তো নিজের মাকেই দেখেছে ছাদে যেতে।
ফিরে এল আঙুর কন্যা ঝটপট। “এবার কী কাজ?” এই সেরেছে ভূতুড়ে জগাইয়ের কেস হল না তো?
“ঘর গোছাও তো। বসার জায়গা, ছোট আলমারির মাথাটা সব জবরজং হয়ে আছে। কত কিছু খুঁজেই পাই না।”
“আগে ম্যাডাম গুবলুকে নাইয়ে খাইয়ে নিলে ভালো হয় না? ধূলো উড়বে, আরও অগোছালো থাকবে কিছুক্ষণ। আপনি যখন মেয়েকে নিয়ে বিশ্রাম করবেন, তখন না হয় আমি ঝেড়েপুঁছে সাফ করে রাখব।”
“মা, তুমি কার সাথে কথা বলছ?”
“নিজের মনে”। দ্বিতীয় রুমাকে রুমা ছাড়া বোধহয় আর কেউ দেখতে পাবে না। না পেলেই মঙ্গল। পাঁচ কান হবে না।
মনটা তবু গুটিয়ে গেল। ঘুম ভেঙে উঠে যদি দেখে পাথর কন্যা নেই, তাহলে? তাছাড়া সময় অপকর্ম করে সটকানো সহজ। একে কি বিশ্বাস করে সে সুযোগ দেওয়া উচিৎ?
মেয়েটা আবার থট রিডিং করল, “ভয় পাবেন না। পাথরটা থাকতে আপনার ভালো ছাড়া মন্দ করব না। মেয়েকে স্নান করিয়ে খাইয়ে নিন। আমি আসি।”
কোনও স্পেশাল ইফেক্ট ছাড়াই আঙুরকন্যা রুমার হাতের মুঠোয় ধরা পাথরে সিঁধিয়ে গেল। পাথরটাকে দুরু দুরু বুকে একটা রুমালে বেঁধে রুমা নাইটির পকেটে রাখল। এই রাত পোষাকটায় আবার একটা পকেটও আছে। তবে বড় ঢোলা।
গুবলু বাড়ি থাকলে সকালে দেরি করে ওঠে। যেমন আজ উঠেছে নটায়। দুপুরে কিছুতেই ঘুমোবে না জানে। ঐ মেয়েটা তো নিঃশব্দেও কাজ সারলে পারত। তা না, বুবলুর ঘুমোনো পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। মানে কাজগুলো করবেই না। এদিকে রুমার নিজের চোখ বুঁজে আসছে। বিকেলে পার্কে নিয়ে যাওয়ার টোপ দেখাতে, কী আশ্চর্য বুবলু ঘুমিয়ে পড়ল। কন্যার এই ব্যতিক্রমী ঘুমে রুমা বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠল।
ওই মেয়েটা ঘরে ঢুকতেই রুমা প্রশ্ন করল, “তোমায় কী বলে ডাকি বলো তো।”
“আপনার যা ইচ্ছা।”
“তাহলে ইচ্ছামণি বলি। মাণিক্য বা মণি যদিও লাল, তবু ওই সবজে পাথরটাকে মণি বললে ভুল হয় না, কত গুণের।”
ইচ্ছামণি কাজ শেষ করে বলল হঠাৎ বলল, “ম্যাডাম আপনার চুল আঁচড়ে দেব?”
ম্যাডাম এর জন্য দুনিয়া হারাতে রাজি। আলমারিতে ঝুলন্ত চাবি একেবারে বিছানার তোষকের নীচে ভেতর দিক করে রেখে মাথার চুল এলিয়ে দিল। মাথায় দ্বিতীয় রুমার মধুর স্পর্শে ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার আগে কেবল শুধোতে পারল, “তোমার নাম কী? কী বলে ডাকব?”
“যা খুশি। আমি আপনার ইচ্ছাপূরণের দাসী।”
“তাহলে ইচ্ছামণি বলে ডাকি। দেখ যেন মণিটা কেড়ে নিয়ে ফুড়ুৎ হয়ে যেও না”।
সন্ধ্যে সাড়ে ছটা নাগাদ ঘুম ভাঙল। যেন ঘোর কাটল। কিন্তু এতক্ষণ ঘুমিয়েও তরতাজা লাগছে না, কেমন ক্লান্ত ভাব। দুপুরে বেশিক্ষণ ঘুমোলে অবশ্য অনেক সময় ঝরঝরে লাগার বদলে গা ম্যাজম্যাজ করে। বাথরুমে গিয়ে গা ধুলো। বেরিয়ে এসে খাবার তথা বসার ঘর দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। ইচ্ছামণি ফ্রীজের মাথায় রাখা একটা ফুলদানীতে টব থেকে ফুল পাতা কেটে এনে সাজিয়েছে। সেই রুমার ছোটবেলার মতো। তখন নকল ফুলের এত চল ছিল না। বাগানের ফুল পাতা ডালপালাই ফুলদানীতে শোভা পেত।
ইচ্ছামণির উপস্থিতি টের পেয়ে চটকা কাটতে প্রশ্ন করল, “তুমি গুবলুকে বিকেলের খাবারটা খাওয়াতে পারবে? ও টের না পায় যেন।”
ইচ্ছামণি হেসে কাজে লেগে গেল। জিজ্ঞাসা করল, “চা করে দেব?”
“না, তুমি গুবলুকে যদি একটুক্ষণ হ্যান্ডেল করতে পার তো আমি আরও একটু গড়িয়ে নিই।”
টিভিতে মশগুল মেয়েটা টেরই পেল না, নকল মায়ের হাতে খাচ্ছে। অবিকল রুমার গলায় গান ধরেছে ইচ্ছামণি, “জ়রাসি আহট হোতি তো ইয়ে দিল সোচতা হেয়, কহী ইয়ে ও তো নহী…”। মদনমোহনের সুরে লতা মঙ্গেশকর। রুমার বড় প্রিয় গান।
গানের গলাটা ভারি সুরেলা আর মিষ্টি ছিল রুমার। হয়ত এখনও আছে। কিন্তু বাবাকে বহুদিন পর্যন্ত একা দাদু-ঠাকুমার ও ছয় ভাইবোনের বিশাল সংসার টানতে হয়েছে বলে ছেলে মেয়েদের পড়াশুনোর খরচটাই কোনওমতে জুটিয়েছেন। গান বা আর কোনও শিক্ষানবিশির কথা ভাবতে পারেননি। বা ভাবলেও পরমাত্মীয়দের খোঁটার ভয়ে ভাবনাটা মায়ের সঙ্গে আলোচনার বাইরে অন্যত্র প্রকাশ করেননি। অথচ ছোট কাকা চাকরি পেয়েই একখানা হারমোনিয়াম কিনে সুর সধনায় মত্ত হয়েছিল। তার সংসার টানার দায় ছিল না। মাথার ওপর দাদা আছে। দাদারাও বলা যেত, যদিনা অন্য ভাইরা যে যার নিজেরটুকু আগলে রাখত আর যৌথ পরিকাঠামো থেকে শুধু সুবিধাটুকু নিত। তা সেই কাকার হারমোনিয়ামে পিসিদের স্পর্শ করার অনুমতি থাকলেও, রুমাদের তিন ভাইবোনের হাত দেবার অধিকার ছিল না।
গানের খুব সূক্ষ্ণ সুক্ষ্ণ কাজগুলো বাদ গেলেও বা একটু এধার ওধার হলেও মূল সুর ধরে রেখে গাইলে নিজেরই কান জুড়িয়ে যেত। ইদানিং রুমা গান গায় না। বহুদিন পর অপরের ঠোঁটে ‘নিজের গলায়’ গান শুনে চোখ ভিজে গেল। গুবলুর বোধহয় এতে টিভি দেখাতে ব্যাঘাৎ হচ্ছিল। ইচ্ছা থেমে গেল। ভেজা চোখের পাতা থেকে কয়েটা ফোঁটা নেমেই এল। ঈশ্বর, ও কি স্বপ্ন দেখছে? স্বপ্ন হলে তাড়াতাড়ি ভেঙে দিও না। আর বাস্তবে হচ্ছে ভাবলে তো নিজেরই মন বুক ধড়ফড়ে উত্তেজনার পাশাপাশি মদির আলস্যে এই ঘোরটা ধরে রাখতে চাইছে।
বিকেলের জল খাবার, রাতের রান্না সেরে ফেলতে না ফেলতেই অতীন এসে পড়ল। ইচ্ছামণিও টুক করে পাথরটায় গিয়ে লুকোল। দুজন রুমাকে একত্রে কেউ দেখে ফেললেই গণ্ডগোল। অবশ্য আঙুরমণি আর কারও চোখে ধরাও দেবে না। তবু সতর্কতা। যতক্ষণ বর আর বাচ্চা বাড়িতে, ততক্ষণ খুব সাবধানে ফাঁকি মারতে হবে। মেয়েটাকে ভুজুংভাজাং দিয়ে ভোলানো যায়; কিন্তু বর? অতীনের কাছ থেকে কিচ্ছু গোপন করতে পারে না রুমা। এই পাথর-রহস্য! উফ্‌! একদিনেই যা উত্তেজনা হচ্ছে। পাথরখানা হাউসকোটের পকেট, বুকশেলফ্‌এর তাক, আলমারির লকার, কোথাও রেখে স্বস্তি হচ্ছে না। এত সুখ কি রুমার পোড়া কপালে সইবে?
গুবলু মাঝে মাঝেই প্রশ্ন করে যাচ্ছে, “কার সাথে কথা বলছ, মা?”
কিন্তু ঈশ্বর হোক, বা অলৌকিকত্ব- কিছু একটা আছে  নিশ্চই। না হলে পৃথিবীতে এত দুঃখী অত্যাচারিত, আরো আরো গভীর সমস্যায় জর্জরিত মানুষ থাকতে রুমা ইচ্ছামণিকে পাবে কেন? হয়ত আরও কারও কারও কাছে এমন যাদু আছে। তারা ব্যাপারটা গোপন রেখেছে। নিশ্চয়ই তাই। না হলে যে ঈশ্বর-প্রকৃতির সুবিচারটাই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে যায়। নাকি সে পেয়েছে তার বিশেষ মানসিক শক্তির জন্য? সে বরাবর এমন কিছু চেয়েছে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা, না ভগবানের করূণা, না লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশীর্বাদ কোনটা? হে ঈশ্বর এ সুখ স্থায়ী হবে তো?
রুমার ঈশ্বর বিশ্বাস যুক্তি-বুদ্ধি দ্বারা সমর্থিত নয়। বিপদে পড়লে ডাকে। আর ডাকে গলা, নাক ও শ্বাসনালীতে কষ্ট অসহনীয় হয়ে গেলে। টাকরা ও গলার মধ্যে যেন তলোয়ারবাজি চলে, শূল ফুটে থাকে – এমন জ্বালা। জ্বর হয় না। কিন্তু জ্বালার চোটে মনে হয় ওষুধ নয়, একটু সায়ানাইড পেলে ভালো হয়। আজ অবশ্য অ্যাজ়িথ্রোমাইসিন শুরু হবে। এই অ্যান্টিবায়োটিকটার সন্ধান বছর দুয়েক হল পেয়েছে। গুবলুর শিশু চিকিৎসক রুমা কষ্টের চোটে মরিয়া হয়ে স্টেরয়েড খায় শুনে লিখেছিলেন। নইলে ছিল বিটাডাইন কিংবা ওকাডাইন দিয়ে দিনে বারো থেকে পনেরো বার গার্গেল, আর নিরুপায় হলে স্টেরয়েড। স্টেরয়েড খেলে গলা নাকের কষ্টের সঙ্গে হাঁচিটাও সেরে যায়।
এই রে! আবার হাঁচি শুরু হল? পর পর পঁচিশ-ছাব্বিশটা। অ্যালার্জির ওষুধ খেয়ে নিল। হাঁচি বন্ধ, নাকের বদ্ধতা কাটা, গলার জ্বালাভাব কমা –এত কিছু থেকে মুক্তির আরামে মাথাটা হাল্কা লাগছে। ঝিম্‌ ঝিম্। ঘোর ঘোর।
আজকের দিনটা কেমন অলীক মনে হচ্ছে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।