সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৩২)

ইচ্ছামণি

পর্ব ৩২

১৩
অতীনের আসতে দেরি হবে। গুবলুকে সিঁড়ির দরজা খুলে দিতে গুটগুট করে ওপরে হাঁটা দিল, “জেটিমা..”। চেয়ারে  বসে কার্টুন চ্যানেলে ‘মেক ওয়ে ফর নডি’ দেখতে দেখতে বেশ খানিক্ষণ বাদে খেয়াল হল, রুমা খবর ধারাবাহিক বা মিউজিক চ্যানেলে নাচগান দেখার বদলে কার্টুন দেখছে। খেয়াল হতেও পাল্টাল না।  নডির এই গল্পটা অনেকবার দেখিয়েছে। মা-মেয়ে দুজনেরই জানা। দুষ্টু গবলিনদুটো নডির হেলিকপ্টার চুরি করতে গিয়ে জ্বালানির অভাবে মেঘের ভেতর আটকা পড়েছে মাধ্যাকর্ষণকে কাঁচকলা দেখিয়ে। তবু রুমা দেখে যেতে লাগল। টাইটেল সঙ্গীত গাইল নিজের মনে। নডি শেষ। এরপর অসওয়াল শুরু হল। এই কার্টুন ধারাবাহিকটা বেশ লাগে রুমার। সব কেমন সুন্দর, শুভ, নির্মল। কোনও খল চরিত্র নেই। একটা অক্টোপাস, একটা পেঙ্গুইন আর আর একটি ডেইজি ফুলের বন্ধত্বের গল্প। রোজকার ছোটখাটো ঘটনার প্রবাহেই ছোট ছোট গল্প উঠে আসে। চোর নেই, পুলিস নেই, গবলিন বা অশুভ আত্মাও নেই। নেই দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনের মতো ফর্মুলা। শুধু কতগুলো জীবজন্তু গাছপালার চরিত্রের রোজনামচা। বাচ্চাদের কার্টুন তো এমনই স্নিগ্ধ হওয়া উচিৎ।
চ্যানেল বদলে মহিলা স্পেশাল ধারাবাহিক। শ্বশুরবাড়িতে চরম অবহেলা পেয়েও কেমন নিজের সততা আর মিষ্টি স্বভাবের জোরে ঐ বাড়ির সকলের নয়নের মণি হয়ে উঠল বৌটি, তারই বেকিং পাউডারমিশিয়ে ফেনানো গল্প। মা বা শ্বাশুড়ি সঙ্গে থাকলে এই ধারাবাহিকটা তাদের সঙ্গে বসে দেখে। মাসখানেক আগে শ্বাশুড়ি ঠাকরুণ এই বাড়িতে তিন মাস কাটিয়ে জামশেদপুর ফিরে যাওয়ার পর অন্তত চব্বিশ-পঁচিশটা পর্ব দেখা হয়নি। কিন্তু তাতেও গল্প অনুসরণ করতে অসুবিধা হচ্ছে না, কারণ গল্পটা মূল স্রোত ত্যাগ করে একটা উটকো চরিত্র ঢুকিয়ে একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ছয় বছরের গুবলু পর্যন্ত ধরে ফেলে মাঝখানে কী ঘটে থাকতে পারে এবং কী ঘটতে চলেছে।
ধারাবাহিকটার পথ বেয়ে নিজের শ্বশুরবাড়ির কথা মনে এল। না, রুমা এই বৌটার মতো সহিষ্ণু, ধীর-স্থির, মিষ্টভাষী ও বুদ্ধিমতী কোনওটাই নয়। দূরছাই করলে শাশুড়ির পা জড়িয়ে ধরে মন পাওয়ার চেষ্টা ও করেনি আর করতেও পারবে না। কিন্তু করলেও কি শাশুড়িমাতার মনোভাব বদলাত? রুমা কি ওনাকে ‘মা’ বলে জড়িয়ে ধরেনি চূড়ান্ত অশান্তির সময়? কিন্তু পরিবর্তে সাময়িক মুখমিষ্টি ছাড়া নিজের অবস্থান একটুও বদলাননি। রুমা নিরন্তর মাথা নীচু করে থাকলে হয়তো অতটা খারাপ ব্যবহার করতেন না, কিন্তু অন্যায় ভাবে অতীনকে দোহন, সম্পত্তি থেকে বঞ্চনা বা ওদের মেয়ের প্রতি বৈষম্য – এগুলো একই থাকত, বদলাত না।
ভাবতে কী আশ্চর্য লাগে, শ্বশুরবাড়ি থেকে তিন মাসের বাচ্চা শুদ্ধু পাণিহাটির ভাড়া বাড়িতে এসে পড়ার সময় শাশুড়ি ঠাকরুন বার বার বলে দিয়েছিলেন, “অন্তু গিয়েই সর্বক্ষণের লোক রাখিস। ও একা পারবে না।” ননদেরও একই বক্তব্য। জামশেদপুরে মুখেভাত না দিয়ে জামশেদপুর থেকে ফিরে আসায় ননদ ও ননদাই দুজনেই রুমার ওপরই রীতি মতো অসন্তুষ্ট তখন। হার হাইনেসের তো কোনও দোষ থাকতে পারে না। সবাই সম্মিলিতভাবে উঠে পড়ে লাগল এটা প্রমাণ করতে যে, রুমার দ্বারা গৃহকর্ম ও বাচ্চা দেখা দুটো একসাথে কিছুইতেই সম্ভব নয়। রুমার প্রয়োজন থাকুক না থাকুক মায়ের নির্দেশে ননদ মাঝে মাঝে গুবলিকে স্নান করাতে বা পরিদর্শনে এলে রুমার মন্দ লাগত না, কিন্তু এসে কথায় কথায় রুমাকে দোষারোপ ও তার জেরে অপ্রিয় প্রসঙ্গের অবতারণা হোত।
দিনরাত কেন, রান্নার মানুষই পাওয়া যায়নি মাস দুয়েক। রুমা নিজের সাংসারিক দক্ষতার প্রমাণ দিতে চমৎকার কর্মচঞ্চল ছিল। তার পর মা বাবা আসার পর জনসংখ্যা বাড়তে পুরোনো কাপড় কাচুনিকেই রান্নায় বহাল করল। এই মুসলমান মেয়েটিকে অতীনের মা প্রথম হেঁসেলে ঢোকান নিজের উদারতা জাহির করতে এবং অবশ্যই ছোটো বৌকে টাইট দিতে। রুমার আপত্তি ছিল জাতের কারণে নয়, মেয়েটা পাঁচ বাড়ি সারাদিন কাপড় কেচে বেড়াত আর নিজে বাসি কাপড়ে থাকত বলে। কাচাটা পরিস্কার হলেও রান্নার পক্ষে ঠিক পরিচ্ছন্ন মনে হয়নি। শ্বাশুড়ি যেখানে এত শুচিবাইগ্রস্ত, কুলীনকন্যা ছোট-বৌয়ের হাতে পর্যন্ত খেতে যাঁর অরুচি, তিনি কী করে ট্রেনে চেপে ও পাঁচবাড়ি খেটে আসা বাসি পোষাক পরিহিতা লাভলির হাতে খেতেন, তার ব্যাখ্যা তিনিই দিতে পারেন। মেয়েটা অবশ্য সরস্বতীদেবীর খুব বস ছিল কারণ রুমার সংসার থেকে দেবীর সৌজন্যে অনেক কিছু প্রাপ্তি ঘটত। রুমা সকন্যা শাশুড়ির সাথে জামশেদপুর যাত্রা করলে ওর রাঁধুনির কাজটা যায়, কিন্তু কাপড় কাচা জারি থাকে। আবার ঠেকায় পড়ে রান্নার কাজে রাখলেও রুমা আর রুমার মা দুজনেই অনেক কিছু করে নিতেন ওর ঘাঁটা মাখা এড়াতে। তখন ছিল দুর্ধর্ষ গরম। তার মধ্যেও রুমা ছিল অক্লান্ত। সামান্য পাঁচ মাসের বাচ্চার বাহানায় বাড়তি খরচে মত ছিল না তেমন। তাই লাভলিকে বাড়িওয়ালারা কাঠি করে তাড়ানোয় খুব একটা দুঃখিত হয়নি। তাছাড়া ক্ষতিপূরণ বাবদ অতীন আপৎকালীন তৎপরতায় একটা কাপড় কাচা বাক্সযন্ত্র কিনে ফেলেছিল।
সেই সময় একবার রুমার বাবা এবং বাবার কারণে মা সে সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখাতেন, তাঁর কাছে রুমাকেও দেখানো হয়। ওনার ওষুধে জীবনটাই যেন বদলে গিয়েছিল। হড়বড়ে মেয়েটা ধীরে ধীরে না চেঁচিয়ে কথা বলতে শুরু করেছিল। অকারণ উৎকণ্ঠা নেই। বিরক্তি নেই। কানের সামনে চাকুম-চুকুম করে খেলেও তেমন রাগ লাগছিল না। কাজের মেয়ে আটা মাখার আগে ঠিক মতো হাত ধুলো কিনা, বাচ্চার খিচুড়ির সব্জিগুলো ঠিক মতো পরিস্কার করে ধুয়ে রাঁধল কিনা – এসব তুচ্ছ চিন্তারাশিসহ শ্বশুরবাড়িতে থাকার অধিকার জন্মাবে কিনা, নিজস্ব ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব কিনা -এসমস্ত উদ্বেগকুলও লঘু হয়ে গিয়েছিল। কী শান্তি! কী আরাম! ‘রিল্যাক্সড্‌’ ভাবে মনের আরামে বাঁচা যে কী সুখের সেই প্রথম যেন টের পেয়েছিল রুমা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এই ওষুধগুলো পেলে ভালো হোত। হয়ত অতিরিক্ত উৎকণ্ঠার কারণে সহপাঠী ও সিনিয়রদের কাছে দ্বারা তাকে যতটা হ্যানস্থা হতে হয়েছিল, তেমনটা হোতই না। কিন্তু রুমা ভেবে দেখেছে এই মনের আরামটাই তামার কুঁড়েমির আকর হয়ে গেল। এখন এই কুঁড়েমিটাই তাকে বেশি বাস্তব বিমুখ করে তুলেছে। আবার সেই বাস্তব বিমুখতা যে হঠাৎ দৈব প্রশ্রয় তথা পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে যাবে, কে জানত? প্রদীপের দৈত্য বা জিন কিংবা আরেকটা রুমা যে কর্মকুশল, ব্যক্তিত্বময়ী ও প্রভাবশালী – এমন চরিত্র শুধু তার কল্পনায় ছিল, নিজের গল্পের চরিত্র করার পরিকল্পনাতেও ছিল না।
টিভির কমেডি শোগুলোতে দেখায় এইরকম জিনের আমদানি হয়ে মালিকের কী নাকাল অবস্থা হচ্ছে। জিনগুলোর অতিরিক্ত প্রভুভক্তি ও কর্মদক্ষতা কাজের চেয়ে অনর্থ ঘটাচ্ছে বেশি। কিন্তু ইচ্ছামণি আসার পর থেকে রুমার সংসারটা যেন নতুন ছন্দে গতি পেয়েছে। ঠিকঠাক সময়ে রান্না, নিয়মিত ঘর ঝাড়পোঁছ, গুবলুর যত্ন, পড়াশুনো, বিকেলে খেলাতে ও বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, অতীনের প্রয়োজন – সব কিছু সুশৃংখল। অতীন অবশ্য তাও রুমার স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে বলে খুঁতখুঁত করে, ব্যায়াম করছে না বলে রাগ করে, একঘেয়ে জলখাবার দেখলে বিরক্তি প্রকাশও বাদ দেয় না। তা করুক। সবাইকে খুশি করা তো ভগবানেরই অসাধ্য, পাথরের জিন পারবে কেমন করে? কিন্তু রুমা যে আরামে থেকেও গৃহশান্তি বজায় রাখতে পেরেছে সেটাই কম প্রাপ্তি নাকি?
গুবলু নীচে এসে এক রাশ অনুযোগের সুরে বলল, “আমাকে কেন ওপরে পাঠালে? রশ্মীদিদি নেই। বিলুদাদা বিজ়ি। জেটিমা শুয়ে আছে। জেটু বলল আজ যাও।”
তবে গুবলুর মা কিছুদিন ধরে বেশ খোশ মেজাজে আছে। পার্কে নিয়ে যাচ্ছে। মন দিয়ে পড়াচ্ছে রোজ, এটাই যা মুশকিল। বিকেলে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে টেনে তুলে দিচ্ছে। শনি রবিবার তেলে দলাইমলাই করে তবে মাথা ভিজিয়ে স্নান করানো, নাচের স্কুল। কোনও ফাঁক নেই। শুধু নিজের মনে কীই যে বলে? যেন কাউকে কিছু করতে বলছে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।