সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৩৩)

ইচ্ছামণি

পর্ব ৩৩

গুবলু একটানা চব্বিশ ঘণ্টা টিভিতে কার্টুন দেখতে পারে। তার কাছে পরাজয় স্বীকার করে রুমাও কার্টুন দেখছে বাধ্য হয়ে।  “মিফি মিফি মিফি ব্রাম, দোস্তোকে সাথ খেলে হাম…”। খরগোশ পরিবারের গল্প। এটাও রোজকার বাড়ির কাজ, স্কুলে যাওয়া, ঠাকুমা দাদুর সঙ্গে দেখা করা, বন্ধুদের সাথে খেলা – এইসব মামুলি ঘটনা দিয়েই সাজানো মৃদু হাস্য রসের পরিবেশনা। নেহাৎ মন্দ লাগে না। একই গল্পের বারবার পুনরাবৃত্তি। তবু সাতাশতম বারও গুবলু একই রকম আগ্রহ নিয়ে দেখছে। বোধহয় একটু অন্যমনস্ক ছিল রুমা। সংবিৎ ফিরলে বাংলা চ্যানেলগুলো খুঁজে নেয়। কতগুলো ধারাবাহিক মা আর শ্বাশুড়ি পর্যায়ক্রমে অভ্যাস করে দিয়েছিল। সেগুলো অনিয়মিতভাবে দেখে।
গুবলুর সাথে দরাদরি করে নিজের চ্যানেল ঘোরাতেই ঐ সেই বিজ্ঞাপণ। সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চার চ্যানেলে ফিরে যাওয়া।
“মা ওগুলো কী?”
“কোনটা?”
“যেটা দেখে তুমি চ্যানেল চেঞ্জ করলে”।
“জানি না সোনা।”
“আমি বলব? ওগুলো বড়দের হাগিস।”
“হতে পারে, আমি জানিনা।”
“জানো না যখন কেনো কেন? তোমার আলমারিতে দেখেছি। খবর কাগজ মোড়া। একটু ফাঁক হয়ে গিয়েছিল। আমি দেখেছি।”
“ও, ওগুলো? ভাইয়ের হাগিস বোধহয়, মাসু ফেলে গেছে।”
“ভাই কি বড়দের হাগিস পরে? দেখিনি তো?”
“আঃ! গুবলু, বড্ড বাজে বকছ। খাবারটা তাড়াতাড়ি শেষ কর। আজ আর পার্কে যাওয়া হবে না। নিজের মনে লুডো খেলো।”
“জানো মা, রশ্নীদিদির কম্পিউটার আছে। সেখানে কত গান শোনা যায়, খেলা যায়।”
“হ্যাঁ, যে অফিসে কম্পিউটার নিয়ে সারাক্ষণ কাজ করছে, তার কম্পিউটার নেই, আর যারা গেমস ছাড়া কিছু জানে না, তাদের আছে। তাও চল্লিশবার তোর বাবাকে ডেকে নিয়ে যায় গণ্ডগোল সারাতে। তোর বাবাকে বল না, স্কুলে কম্পিউটার ক্লাস শুরু হচ্ছে। তোরও লাগবে।”
“মা, তুমি কম্পিউটার চালাতে জানো?”
“শিখেছিলাম। এখন তো সোনা, অনেক নতুন কিছু এসেছে, সেগুলো উইনডোতে মেনু বেস্‌ড বলে শিখতে অসুবিধা হবে না।”
“উইনডো মানে জানলা? মেনু কী মা?”
সর্বনাশ গুবলুর প্রশ্নবাণ নিজেই উস্কে ফেলেছে ওর মা।
“অত সব বোঝাতে পারব না সোনা। আমি কি সব জানি? যদি কেনা হয়, তাহলে সব দেখতে পাবে।”
“মা, রশ্নীদিদির কাছে যাব।”
“বাবু, জেঠিমা এখনও রেস্ট করছে। এখন গেলে বিরক্ত হবে না? আর একটু পরে যেও। সেদিনই বললে আর যাবে না। ওরা নিজে থেকে ডাকলে তাহলেই যাবে।”
“ওরা যদি না ডাকে?”
“তাহলে আমি পার্কে নিয়ে যাব। অবশ্য আজ অনেকগুলো কাজ আছে। আচ্ছা, একটু পরে আমিই রশ্নীর কাছে নিয়ে যাব। যদি রশ্নীদিদি বাড়ি না থাকে, যদি বিলুদাদা না থাকে বা বিজ়ি থাকে, তা হলে কিন্তু জেদ কোর না। জেঠু খুব রাগী কিন্তু।”
বাড়িওয়ালাদের ওপরতলার আর রুমাদের নীচতলার মধ্যে একটা দরজা আছে, সোজা সিঁড়িতে খোলে। রুমা একটু ভেবে দরজাটা খুলে দিল। গুবলু গুট গুট করে ওপরে চলল।
দরজায় ঘণ্টি। অতীন নিশ্চই। হ্যাঁ, অতীনই। হাতে স্ন্যাক্‌সের একটা প্যাকেট। মুখে হাসি। গিন্নিও হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা করে গ্রীলের তালা খুলে দিল।
বেশ কিছুদিন ধরে খুব হাসিখুশি মেজাজে আছে বৌটা। উৎসাহ ভরে ঘরের কাজ করছে। যাদুবলে যেন বদলে গেছে ঘরের সাজসজ্জা। কোথাও ধূলো নেই, সব কিছু জায়গামতো। অফিশিয়াল ফাইল ভর্তি একটা পেন ড্রাইভ বাড়িতেই হারিয়েছিল। সেটাও পাওয়া গেছে। কলমদানীতে লেখা পড়ে এমন একাধিক পেন। অতীনের মেজাজও শরিফ। এইটুকুই তো চাওয়া। ও তো চাকরি করা স্বাবলম্বী মেয়েই বিয়ে করতে চেয়েছিল। রুমা রোজগারের বদলে খরচা করে চলেছে বলে অতীনের তো কোনও অভিযোগ নেই। ভবিষ্যৎ নিয়ে অত ঘাঁটাঘাঁটি ওর পোষায় না। বর্তমানটা উপভোগ করি না আগে।
রুমার সঙ্গে কথা কাটাকাটির অবকাশও ঘটছে না। ও নিজের জগতে তন্ময় হয়ে নিজের সাথেই কথা বলে চলেছে। এটা অবশ্য ওর পুরোনো অভ্যেস – নিজের মনে বকা। নতুন যেটা তা হল, অতীনের প্রয়োজনগুলো মিটিয়ে দেওয়া ছাড়া কোনও আলাপ আলোচনা করছে না। টাকা-পয়সা নিয়ে, খবর নিয়ে, রাজনীতি বা সাহিত্য নিয়ে, বরের অফিসের হালহকিকত নিয়ে, এমনকি বদলির আশঙ্কা নিয়ে … কোনও কিছুতেই যেন কোনও বক্তব্য নেই। নিজের কবিতা, চিঠি, প্রবন্ধ পড়িয়ে জ্বালাতনও করছে না। অতীনের তাতে খুব অসুবিধা না হলেও “জানো” বলার পর বাকিটা শোনার মতো মনযোগী শ্রোতা না পেলে একটু রাগ হয়। অবশ্য সময়মতো খাবার, খবর কাগজ পত্রিকা বা বই পড়ার অবকাশ, আর দরকারি জিনিষপত্র হাতের নাগালে পেয়ে গেলে অভিযোগের কিছু থাকে না। আর, আর একটা ব্যাপারে বৌ কতটা সাড়া দেবে সেটা এ কদিনের মধ্যে পরখ করা হয়নি। অতীন নিজেই এত ক্লান্ত থাকে – বালিসে মাথা ঠেকালেই ঘুম। পাগলির রাতে ঘুম না এলে অনেক সময় আদর পেয়ে যায়। তখন মাঝরাতে খুনসুটি শুরু করলে পাশের ঘরে যেতে হয় ঘুম ছেড়ে উঠে। বেশ কিছুদিন যাবৎ সেটাও হচ্ছে না।
তবু সব কি ভালো থাকার উপায় আছে? রুমার পিঠে, কোমরে, কাঁধে যন্ত্রনা হচ্ছে, মাথা ঘুরছে, মুখ চোখ গায়ের রং সবই কেমন বসে যাচ্ছে। দেখাচ্ছি দেখাব করে ডাক্তারের কাছে যাওয়া হচ্ছে না। নিজেরাই ডাক্তারি করে ওষুধ কিনছে। অতিরিক্ত পরিশ্রম হচ্ছে কি বৌটার? এতটা তো অভ্যেসও নেই। সংসারের কাজ নিয়ে ঝগড়া বাধে বলে কাজটা হয়ত গুছিয়ে করছে, কিন্তু ধকল সইতে পারছে না।
অথচ মেজাজ ফুরফুরে। অসুস্থতা নিয়ে হাসিখুশি থাকবে, এমন কষ্ট সহিষ্ণু মেয়ে তো নয় রুমা; বরং একটু আওবাতালেই। একমাত্র মেয়ে হবার পর শাশুড়িকে টেক্কা মারার জন্য শরীরে অত অসুবিধা নিয়েও অতি সক্রিয় ছিল। নইলে, যেহেতু অতীন গৃহকর্ম পারে, তাই অল্প মাথা ঘোরা, চারটে হাঁচি এসব অজুহাতেও বরের হাতে সংসার তুলে দিয়ে রুমাকে টুক করে বিছানায় গড়িয়ে নিতে দেখা গেছে। আর এখন? এসব পাত্তাই দিচ্ছে না। অতীন হাত লাগাতে গেলেও বাধা দেয়। চোখের নিমেষে, কিছুটা চোখের আড়ালে সব করে ফেলছে। অনেক সময়ই অতীন সকালে ঘুম ভেঙে উঠে দেখে রুমার রান্না শেষ। সব পরিপাটি। শুধু নিজের সঙ্গে কথা বলাটা অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে।
ছেলেদের চোখে এত খুঁটিনাটি ধরা পড়ে না। মুখ ফুটে না বললে মেয়েদের কষ্ট অসুবিধাগুলোর কথা বুঝে নেওয়ার দরকার তাদের নেই। বস্তুত কষ্ট পেতে দেখলে তারা আশঙ্কিত ও বলা যায় বিরক্তই হয় – এই রে! এবার নিজের গেঞ্জি, জাঙ্গিয়া, মোজা, রুমাল, শার্ট, প্যান্ট – এসব বুঝি নিজেকেই ব্যাবস্থা করতে হবে। কিন্তু অতীনের মধ্যে একটা মেয়েলি মমত্ববোধ আছে। রুমা রাগ করে দুপুরে না খেয়ে থাকলে, রাতে ফ্রীজ খুলে টের পেয়ে যায় বেশির ভাগ। তাই বৌটার মুখের রং আর চোখের অভিব্যক্তি দেখে খটকা লাগে। এভাবে নিজেকে নিংড়ে দেওয়াটা রুমার অভিমান নয়তো? রুমাকে হাসিখুশি দেখালেও ওকে অনেক বেশি অন্যমনস্ক লাগে আজকাল।
“তোমার শরীর ঠিক আছে তো? আগে তো এত কাজ করতে দেখিনি। রেগে মেগে বেশি কাজ দেখাতে গিয়ে হয়ত আমাকেই বিপদে ফেলবে। ডাক্তার, বদ্যি, অফিস কামাই।”
“কুঁড়েমি করলেও দোষ, আবার খাটলেও দোষ? তা এত দিনে চোখে পড়ল?”
“তুমি হপ্তাখানেক ধরে অস্বাভাবিক খাটছ দেখছি। চোখেমুখে তার ছাপ পড়ছে।”
“হপ্তাখানেক নয়, চোদ্দদিন। তবে খাটনি নিয়ে ভেব না। আমি ঠিক আছি।”
“তুমি দিন গুণে রাখছ নাকি?”
রুমা হাসল।
“দেখো বাপু, চেহারার লক্ষণ কিন্তু ভালো নয়। চিন্তা কি এমনি এমনি করি? ভুগতে তো আমাকেই হবে।”
“তা কী করে সম্ভব? আমি তো রেস্টেই আছি।”
“বা বাঃ! তুমি কবে থেকে এত কাজের হলে গো? সারা দিন চর্কিপাক দিয়েও বলছ রেস্টে আছি। তোমার দিবানিদ্রা? সেটা বজায় আছে তো?”
“বললাম না, এত ভাবতে হবে না।”
“ভাবতে না হলেই ভালো। ইনফ্যাক্ট কাজ একপ্রকার এক্সারসাইজ। তবে ওভার এক্সারসাইজও ভালো নয়। কাজগুলো তাহলে পেত্নী করে দিচ্ছে?”
অতীন খবরের কাগজে ডুবে গেল। অফিস থেকে ফিরে একটু নিজের মতো বিশ্রাম করার সুযোগ এটুকুই। মেয়েটা “বাবা, বাবা” করে ঘাড়ের ওপর ঝাঁপালে ভালো লাগে ঠিকই, তবে পরের বাড়ি গিয়ে নিরুপদ্রবে টিভি আর কাগজের সুযোগ করে দিলে, তার সদ্ব্যবহার করতে বোধহয় একটু বেশিই ভালো লাগে।
অতীনের এই কাগজ বই নিয়ে উদাসীন হয়ে যাওয়াটা রুমার সহ্য হয় না। ব্যাস্! হয়ে গেল, বৌয়ের স্বাস্থ্যের প্রতি দরদ দেখানো? এই খাটাখাটনিটাই তাহলে স্ত্রীদের কাছে প্রত্যাশিত? কিন্তু রুমার পেটটা যে ফাঁপছে। গত চোদ্দ দিন ধরে এমন গুরুত্বপূর্ণ আর আশ্চর্যজনক ঘটনা সে বরকে লুকিয়ে রেখেছে, ফোন করে মা-বাবার বা বোনের কাছেও ফাঁস করেনি। এত গোপনীয়তা রুমার পোষায়? বিয়ের আগে যেমন মাকে কিচ্ছুটি লুকোত না, বিয়ের পর তেমনি বর। এমনকি পর পুরুষের প্রতি সামান্য টান জন্মালেও বোধহয় অতীনকেই আগে জানাতে হবে। আজ একটু সুযোগ ঘটছিল। কিন্তু অতীনের জেরা ফুরিয়ে গেল যে। আর যেন কিছু জিজ্ঞাস্য নেই। ওর কি বাড়ি ঘরের ভেতরের পরিবর্তন একটুও আশ্চর্যজনক লাগছে না? মনে হচ্ছে না রুমার একার পক্ষে কী ভাবে সম্ভব?
অতীনের ওপর বেশ খনিকটা রাগ, ইচ্ছামণিকে হারানোর খানিকটা ভয়, অতীন পাছে অবিশ্বাস করে তাই জড়তা, গুবলু পাছে ওপর থেকে কথার মাঝে ফিরে আসে তার তাগাদা নিয়ে রুমা অতীনকে ঠেলল, “এ্যাই একটা কথা জানাব, কাউকে বলবে না বল।”
“উঁ – ?”
“একটা কথা।” রুমা গলা চড়াল। “কাউকে বলবে না বল। নিজেও অবিশ্বাস করবে না। গুবলুকেও বোল না। পাঁচকান হলে আমাদের সুখের দিন শেষ হয়ে যাবে।”
অতীনের ভাবান্তর নেই। তাহলে কি এড়িয়ে যাবে? রুমা খানিকক্ষণ চুপ করে ভাবল।
অতীন মুখ তুলে বলল, “কী বলছিলে?”
“একটা কথা আছে। পাঁচকান করা যাবে না।”
“কথাটা কী? আর পাঁচকান করা তোমার স্বভাব, আমার নয়”।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।