সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ২১)

ইচ্ছামণি

পর্ব ২১

“উম্‌ম্‌ম্‌। এখন তো শুকনো চুমুর সময়”। রুমা ঠোঁট মুছে বলল। অফিস বেরোনোর আগে বৌয়ের ঠোঁটে আলগা ঠোঁট ছুঁইয়ে  যাওয়ার আভ্যসেটা প্রায় ছেড়েই গিয়েছিল। আজ অনেকদিন পরে আবার ইচ্ছে হল।
“তোমার কোন সময় ভেজা চুমুতে সম্মতি থাকে?  যতগুলো ভাষা জানি, একমাত্র বাংলাতেই চুমুকে ঠিকঠাক ডেসক্রাইব করা আছে। চুমু খাওয়া। কিন্তু তুমি তো বড়দের মতো মুখ খুলে চুমু খেতে জানো না, ঠোঁট টিপে চুমু মাখতে চাও।”
খিলখিল করে হেসে উঠল রুমা। বিয়ের এত বছর পরও মুখ লালাভ হল। “বাঃ! এইবাক্‌ধারার যথার্থতা তো আগে ভেবে দেখিনি। তবে তারপরেও বলব, অমন নালঝোল মাখানো ব্যাপারটা আমার মোটেও ভালো লাগে না। তোমার খেতে ভালো লাগতে পারে, আমার মাখাটাই পছন্দ”। অতীনকে জড়িয়ে ধরল রুমা। “আজকে তাড়াতাড়ি আসতে পারবে? একটু বেরোব। পুজোর কেনা কাটা আছে।”
“দেখছি” বলে অতীন জুতো পরতে বসল বাইরের ঘরের ডিভানে। রুমার ডায়রি পড়ে আছে। যেখানে সেখানে ফেলে রেখে সারা বাড়ি তোলপাড় করে খুঁজবে। ডায়রির পাতার ভাঁজে একটা পেন গোঁজা। উঃ! এখানে সেখানে পেন ঢুকিয়ে রেখে দরকারের সময় একটাও পেন পাওয়া যায় না। রুমার ডায়রি এর আগেও পড়েছে অতীন। দু একটা ব্যতিক্রম ছাড়া মোটামুটি অতীনের পরিবারের মুণ্ডপাত যে ওর ডায়রির প্রতিপাদ্য, তা একরকম জানাই। তবু কৌতুহল বশত পেন গোঁজা পাতাটা খুলল অতীন। নুতন কিছু সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে মনে হচ্ছে। মুখের ভেতর তখনও রুমার মুখ থেকে তুলে নেওয়া লবঙ্গ। কবিতা? দু পাতা জুড়ে? এখানে? কবিতার ডায়রি তো অন্য একটা। একদম গোছানো নয়। জুতো পরার আগে এক হাতে ধরে আলগোছে পড়তে শুরু করল।
শ্রীমতী খাই খাই                                             ১.১২.২০০৩
শ্রীমতী খাই খাই           মাছ খাই মিষ্টি খাই
দুধ ঘি– দু নয়নে          যা দেখি সব চাই।
ভেটকি চিংড়ি ট্যাংরা চাওয়া
নিদেনপক্ষে তেলাপিয়া
না পছন্দ রুই কাতলা      চলে একান্ত অগত্যাই।
বয়স আশি ছুঁই ছুঁই                 নিরামিষে রুচি কই?
রেড মিট মানা বলে        চিকেন টেঙরি? তাই সই!
লালা আটার রুটি খেলে     অম্বলে বুক জ্বলে-
কচুরি সিঙ্গাড়া নিয়ে এলে   হজমে কোনও কষ্ট নাই।
মুড়ি খেতে দাঁতে লাগে
         কুচো নিমকি তাই তো আগে
অতিথির দোহাই দিয়ে      কৌটো কৌটো ভরা চাই।
বাচ্চা হয়েছে বলে          বৌকে যত্ন করার ছলে
ঘিয়ে ভাজা লুচি বেলে      নিজের খানকয় চাইই চাই।
ছেলের ভাঁড়ে ভবাণী হলে
নাতনির টাকায় হাত পড়লেও
না বোঝার ভান করে       চর্ব্যচোষ্যে আপত্তি নাই।
নিজের সংসার হলে        এক চামচেই চলে
কোথাও সুবিধা পেলে       খাঁটি দুধের চা চাই।
রাঁধুনিকে হাত করা
ছেলে-বৌকে চেপে ধরা
         বিশ্রাম দেওয়ার ছলে       হেঁসেল থেকে দূর ছাই!
ফোকলা দাঁতে কুট কুট     দু-চারখানা বিস্কুট
কেক পেস্ট্রী না পেলে      প্রতিবারই সঙ্গে চাই
[বড় বিস্কুট হলে দু খানা,নোনতা বা ক্রীম দেওয়া হলে চার খানা]
অপরের সমুখে দেখান      শোকাতপা বিধবার ভান
জনগণ চলে গেলে          মুঠোমুঠো গেলা চাই।
বলেন নাকি অভাব-কালে
ছেলেমেয়ে ভাত খেলে
খেতেন নাকি ফ্যান গেলে!  কী জানি? বিশ্বাস হয়না ভাই।
কারণ দেখেছি ভুলে        ভাঙা মুড়ো খাচ্ছি বলে
চার খামি মাছ ঢাকা, তাই!  [এই ঘটনায় এতটুকু অতিরঞ্জন নাই]
যেখানে দেন খরচ          সেখানে ভয় সংকোচ
অন্যের ধসিয়ে আবার       টাকার গরম দেখানো চাই।
বড় ছেলের মুখের চোটে
ওষ্ঠে বুলি না ফোটে।
মেজ ছেলের দুশো টাকা    খরচ হলেও বুক ফাঁকা।
ছোট ছেলে গৌরী সেন,     সে সবের বালাই নাই।
মিথ্যেয় পেট বোঝাই       কথা ঘোরানোয় জুড়ি নাই
কথা দিয়া না রাখাটাই      স্বভাবের যার মাত্রাই
সত্যের তবু বড়াই          জনে জনে করা চাই।
[আমার দেখা সেরা ভণ্ড মিথ্যুক]
নিয়ে অবোধ শিশুকে কোলে          এই দেব সেই দেব বলে
ছলনার অন্ত নাই।
শিশুটি যে ছোট ছেলের     সে আবার কোনকালে
পাওনা পেয়েছে ছাই?
পাতের প্রসাদ ছাড়া        তার কিছু জোটে নাই।
বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে        তার কাছে আসা তাই
মা সম্পর্কে রুমার মনোভাব একেবারে অজানা নয়। কিন্তু এত স্থূল এত কুরুচিকর বর্ণণা! অন্তুর মা কি এতটাই হ্যাংলা, এতটাই লোভী? এতটাই ছোঁচকা, মিচকে, মিথ্যেবাদী? বড় বৌদি যখন মাকে খাওয়া নিয়ে কটাক্ষ করে, “মিথ্যেবাদী মিথ্যুক” বলে তখন গায়ে এতটা বেঁধে না; কারণ তার কথার প্রতিবাদ করার এক্তিয়ার অতীনের নেই, দাদা নিজের একশো কেজির শরীর আর হাজার টনের ব্যক্তিত্ব নিয়ে বৌদির পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু রুমার এত হীন রুচি, আর এত বড় স্পর্ধা!?
 অবশ্য রুমা মুখে কিছু বলেনি, বলার সাহস নেই, নিজের ডায়রিতে ছড়া কেটে রেখেছে। কীই বা বলার আছে শুধু এই কাঁচা কাব্যচর্চায় চিড়বিড়িয়ে জ্বলা ছাড়া? দেখে মেজাজ খিঁচড়ে গেল। তারিখটা বলছে গুবলু হওয়ার মাস খানেকের মধ্যে লেখা, যখন মা আর দিদি বাচ্চা দেখার জন্য ছিল অন্তুর এই ভাড়া বাড়িতে। মা বৌকে যত্ন করবে বলে আর নাতনির মায়ায় অতীনের সংসারে অসুবিধা করে যখন দিনের পর দিন কাটাচ্ছে, তখন রুমা –ছি ছি ছি! মা-টার সত্যিই ভাগ্য খারাপ। অন্যের জন্য করেও মরে, আর প্রতিদানে কারও কাছে মুখ খায় তো কারও কাছে অরুচিকর তাচ্ছিল্য, উপহাস।
মা শুধু শুধু নাতনিকে সোনার চেন দেওয়ার বায়না করে অতীনকে দিয়ে চরম অসুবিধার মধ্যেও অতগুলো টাকা সোনার গয়নার পেছনে খরচ করাল নিজের ভোগে না লাগিয়ে। রুমার কাছে তো ব্যাপারটা গোপন থাকেনি। সে তো ঠারেঠোরে বলেই দেয়, মা মাছের তেলে মাছ ভেজেছেন, ঐ চেন অতীনের টাকা থেকেই হয়েছে। তাহলে তো ঐ টাকা মেয়ের জন্য ফালতু গয়নার মতো কোনও কাজে লাগে না এমন জিনিসে বরবাদ করাটা মস্ত আহাম্মকি হয়েছে। তার বদলে মায়ের চিকিৎসায়, বা মায়ের শখ আহ্লাদ মেটাতেই কাজে লাগানো করা ভালো ছিল। মায়ের যখন হ্যাংলা বলে বদনাম ঘটেই গেছে, তখন রসনার তৃপ্তির জন্যই না হয় ছোট ছেলে ধার-কর্জ করে হলেও আরও আরও টাকা ঢালত। মা তখন রুমা আর অন্তুকে দেখিয়ে দেখিয়ে অনেক লতায় পাতায় আত্মীয়কেও এটা সেটা কিনে দিত বলে বৌয়ের প্ররোচনায় অন্তুরও খারাপ লাগত। এই রকম একটা নীচ মনের মেয়ের কথায় প্রভাবিত হয়ে স্বার্থপরের মতো নিজের মেয়ের কথা ভেবে মায়ের ওপর অভিমান করেছিল? ঠিকই তো। নিজের কণিষ্ঠা নাতনিকে যা দিতে শখ হত মায়ের, সেগুলো শুধু শুনিয়েই শান্তি, সত্যিকারের তো খরচ করার উপায় ছিল না জামশেদপুর থেকে ঐ কটা টাকা এনে। তাই বলে রুমার বিদ্রূপ কুটুক্তিতে অতীন কেন সেভাবে প্রতিবাদ জানায়নি? কেন মনে হয়েছিল, ভাইপো, ভাইজি, বোনপো, বোনঝিদের মতো অন্তুর সন্তানেরও তার ঠাকুমার কাছে একই রকম পাওয়ার কথা? পাওয়া মানে কি শুধু টাকা পয়সা, গয়না-গাটি, বাসন-কোসন, বাড়ির অংশ এইসব স্থূল জাগতিক সম্পত্তি? সেসব বুঝে নেওয়ার কি লোকের অভাব? কিন্তু স্নেহ ভালোবাসা? তার কোনও মূল্য নেই? অন্তুর ওপর মায়ের অবুঝ দাবি যে কী গভীর স্নেহের প্রতিফলন, তা রুমার মতো হিসাবি সংকীর্ণ মনের মানুষ বুঝবে না।
এই ছিরির পদ্য লিখে রুমা কিনা হাহুতাশ করে তার কোনও কবিতা, কোনও প্রবন্ধ বা গল্প কোথাও ছাপে না। একটি কুলীন পত্রিকা’র বাইরে অবশ্য কিছুতে চেষ্টাও করেনি। আর করেও কাজ নেই। বেশ হয়, রুমার কোনও কবিতা ছাপা হয় না। এমন স্থূল ছড়া যে লিখতে পারে, তার কবি স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্যতাই নেই।
নিজের মনের ভাব, অসম্পূর্ণ ঝগড়ার যুক্তিগুলো যে ডায়রিতে লিখে রাখে রুমা এটা তো অতীনের জানাই ছিল। এবং এটাও জানা যে না বলতে পারা বা ঠিক ভাবে বলতে না পারা কথাগুলো লেখার পর সচেতন অনবধানতায় ডায়রি খুলে রেখে অতীনের কৌতুহল জাগিয়ে তাকে দিয়ে পড়িয়ে নেওয়ানোটা রুমার একটা কৌশল। ডায়রিটা যে অতীনের গুষ্টি উদ্ধারের জায়গা তা মোটামুটি জেনে যাওয়ার পর অতীন আর কৌতুহল দেখাত না। ছড়া বলেই একটু জিজ্ঞাসা নিয়ে উঁকি মেরেছিল। কিন্তু এই..? ছিছিঃ! অফিস যাওয়ার আগে কেন যে অযথা কৌতুহল নিরসন করতে গেল?
লবঙ্গটা মুখের মধ্যে তরতাজা ভাব আনার বদলে বিস্বাদে ভরিয়ে দিল। জানলা দিয়ে ফেলে দিল অতীন।

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।