সাপ্তাহিক ধারাবাহিক ঐতিহ্যে “কলকাতার চার্চ (কোম্পানীর যুগ)” (পর্ব – ১) – লিখেছেন অরুণিতা চন্দ্র

১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে ২৪ শে আগস্ট তারিখটি কে কলকাতার জন্মদিবস আর জব চার্নক কে কলকাতার পিতা বর্তমান গবেষণার নিরিখে আর বলা যায় না। কিন্তু তাঁতীগ্রাম সুতানুটি, গোবিন্দপুর এবং জেলে অধ্যুষিত বন্দর ডিহি কলকাতার ব্রিটিশ ভারতের প্রথম রাজধানী তথা বর্তমানের তিলোত্তমা মহানগরী কলকাতা রূপে আত্মপ্রকাশের পশ্চাতে শ্বেতাঙ্গ তথা ইউরোপীয় দের অবদান অনস্বীকার্য। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কার্যস্থলরূপে কলকাতার উত্থানের সাথে সাথে বাংলার মাটিতে জন্ম হয় ‘White Town’ এর। যার অধিবাসীরা শুধুমাত্র ইংরেজদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং স্কটিশ, আইরিশ, গ্রীক, পর্তুগিজ, ফরাসী, ডাচ, আর্মেনীয় সহ বিবিধ ইউরোপীয় জাতির অবস্থান প্রাসাদ নগরী কলকাতাকে ইউরোপের এক ক্ষুদ্র সংস্করণে পরিণত করেছিল বললে বিশেষ ভুল হবে না। কলকাতার ইউরোপীয় সমাজের এই বহুমাত্রিক চরিত্র এই সমাজের এক ক্ষুদ্র অংশস্বরূপ কোম্পানির আমলে গড়ে ওঠা কলকাতার গির্জাগুলির ইতিহাস থেকে প্রতীয়মান হয় ওঠে।
ধর্মবিশ্বাস বাদ দিয়ে কোন জাতির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। ইউরোপীয়দের সাথে সাথে তাদের আচরিত খ্রিষ্টধর্ম ও কলকাতার সামাজিক ইতিহাসের আবশ্যক অঙ্গে পরিণত হয়।
সপ্তদশ শতকের শেষার্ধে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্যিক কার্যকলাপের পাশাপাশি কোম্পানীর উপর তার কর্মচারীদের বিদেশের মাটিতে ধর্মাচরণের ব্যবস্থার দায়িত্ব ও বর্তায়। ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানী একজন চ্যাপলিন কে ধর্মীয় দায়দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োগ করে, যিনি বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে কোম্পানির কর্মচারী ও বণিকদের ধর্মাচরণের ব্যবস্থা করবেন। রেভারেন্ড জে. ইভান্স ছিলেন কলকাতায় কোম্পানীর প্রথম চ্যাপলিন। যিনি তার বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রভুত আয়ের পাশাপাশি কোম্পানির যাজক হিসাবে বৎসরে প্রায় একশত পাউন্ড সাম্মানিক লাভ করতেন। ১৬৯২ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানী কর্তৃপক্ষ তাঁকে জানায় ধর্মীয় কার্যকলাপের জন্য তাঁকে অর্থদান কোম্পানির পক্ষে সম্ভব হবে না। ফলে ইভান্স ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে ইংলন্ডে ফিরে যান। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে রেভারেন্ড বেঞ্জামিন চ্যাপলিন হয়ে কলকাতায় আসেন। তিনি কোম্পানিকে চার্চ অব ইংলণ্ডের অধীনে একটি চার্চ নির্মাণের প্রস্তাব দেন এবং কাজ শুরু করেন। কিন্তু তিনি এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন ও দেশে ফেরার পথেই মারা যান। পরবর্তী চ্যাপলিন ১৭০৮ খ্রিস্টাব্দে এই গির্জা নির্মাণের দায়িত্ব নেন এবং ১৫ ই জুন, ১৭০৯ খ্রিস্টাব্দে চার্চ টি স্থাপিত হয়। তৎকালীন গ্রেট ব্রিটেনের মহারাণী Anne কে উৎসর্গ করা হয় বলে চার্চ টির নাম হয় St. Anne’s Church। চার্চের চূড়াটি ছিল সুউচ্চ এবং প্রতি রবিবার গভর্নর কোম্পানির সকল সিভিল ও মিলিটারি অফিসারদের সাথে এই চার্চে প্রার্থনায় যোগ দিতেন। বর্তমান ডালহৌসি স্কোয়ার ও ক্লাইভ স্ট্রীটের প্রান্তে পুরাতন ফোর্ট উইলিয়াম অর্থাৎ বর্তমান যেখানে জিপিও দাঁড়িয়ে সেখান থেকে ৫০ গজের দূরত্বে যেখানে রাইটার্স বিল্ডিং অবস্থিত সেখানেই এই গীর্জাটি স্থাপিত ছিল।
১৭৩৭ খ্রি: কলকাতার বুকে যে ভয়াবহ সাইক্লোন বা বর্তমান গবেষকদের মতে সুনামি আছড়ে পড়েছিল তাতে চার্চের শিখর টি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের জুনে বাংলার তদানীন্তন নবাব সিরাজ উদ দুল্লার কলকাতা আক্রমণের সময় কোম্পানীর সৈন্য রা গীর্জার দেওয়ালের পশ্চাতে আশ্রয় নিয়ে নবাব বাহিনীর সাথে যুদ্ধে যোগ দেয়, ফলে চার্চ টি নবাবের সৈন্যদের আক্রমণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এভাবে প্রাক পলাশী যুগের কলকাতার একমাত্র Anglican চার্চটির অস্তিত্ব সমাপ্ত হয়।
St. Anne চার্চের ধ্বংসের পর বেশ কিছুকাল কলকাতায় চার্চ অব ইংলণ্ডের অধীনে কোনো চার্চ ছিল না। নবাবের হাত থেকে কলকাতা পুনরুদ্ধারের পর ক্লাইভের নেতৃত্বে কলকাতার প্রথম রোমান ক্যাথলিক চার্চটিকে পর্তুগিজদের হাত থেকে ধর্মীয় উদ্দেশ্যে অধিকার করা হয়। তিন বছর পরে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ২৪ সে মার্চ চার্চটি পুনরায় পর্তুগিজ কর্তৃপক্ষ কে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পুরাতন ফোর্ট উইলিয়াম যা সিরাজের আক্রমণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল, তার মধ্যে থেকে একটি Warehouse কে প্রার্থনাকক্ষে পরিণত করা হয় কোম্পানীর কর্মচারীদের জন্য। ২৫০০ টাকা ব্যয় করে old fort এর পূর্বদিকের প্রবেশপথ ও তার সংলগ্ন বিল্ডিং টিকে চ্যাপেলে পরিণত করা হয়েছিল যার নাম হয় St. John’s Chapel। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কলকাতায় কোন anglican চার্চের অস্তিত্বের কথা আর জানা যায় না।

চলবে…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।