সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রবন্ধে সম্বুদ্ধ সান্যাল (পর্ব – ১২)

ডার্ক ম্যাটার এবং সপ্তেন্দ্রিয়

২০৩৪ সাল। নরেন্দ্র মোদীর যুগ শেষ হয়েছে বছর তিনেক আগে। আবার চীনা সামগ্রীর আদানপ্রদান শুরু হয়েছে। চীন ইতিমধ্যে গ্যাজেট আবিষ্কারে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। মধ্যের কয়েক বছর দেশি পদ্ধতিতে তৈরি খেলনা সামগ্রী নিয়ে আমরা কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিলাম। বাংলায় তাও মাটির ঘোড়া, ঘূর্ণীর পুতুল প্রভৃতি ফিরে এসেছিল। কিন্তু দুনিয়া যে গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছে তার সঙ্গে আমাদের একটা গোটা জেনারেশন পরিচিত হতে পারেনি। যারা তবু নানা উপায়ে বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, তারা জেনে থাকবেন যে দুনিয়া এখন ফোর ডি জগতের সঙ্গে জড়িত। আগে ছোটবেলায় আমাদের দেখার জগৎ ছিল থ্রিডি। এখন তার সঙ্গে সময়ের তাল মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত জগৎ। আমরা যার স্বপ্ন আজও আমাদের পুরাতন ঋষিমুনিদের চোখ দিয়ে দেখে চলি। নাম দিয়েছে ফোরডি জগৎ। যাতে আমাদের দেখা ত্রিমাত্রিক জগতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সময়ের মাত্রা।
এই প্রসঙ্গে চীন প্রভূত উন্নতি করেছে। নানা চাইনীজ কোম্পানী বের করেছে টাইম মেশিন। অবাক হবেন না, আমি ২০৩৪ সালের কথা বলছি। ছোটবেলায় দেখা সেই ডিজিটাল রেভোলিউশনের পর বিশ্ব সাক্ষী হয়েছে টাইম ট্রাভেল করার জন্য। যদিও ভারতে এই ব্যবস্থা সদ্যই চালু হয়েছে। চীনের তৈরি দু একটি মেশিন দেখা যায় পাড়ার এদিকে ওদিকে। মনে পড়ে যায় সেই ডিজিটাল আমলের কথা, যখন পাড়ায় কেউ নতুন কম্পিউটার কিনলে তার বাড়ির সামনে দিনসাতেক লোকজন সমাগম থাকত। দুনিয়া বদলালেও বাঙালি বদলায়নি। পাড়ায় টাইম মেশিন ঢুকলেই সেই বাড়ির সামনে ছেলেছোকড়াদের ভীড় তো বটেই, রাস্তাঘাটে, পাড়ার কলে, চায়ের দোকানে আড্ডার চর্চা এখনও কমেনি। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব গর্বিত লাগে এতটুকু জীবনে এত ঘটনার সাক্ষী হয়ে।
অবশ্য এই রেভোলিউশনের প্রভাব আমার সংসারে এসে পড়তে সময় নেয়নি নেয়নি মোটেও। নন্দিতা আজকাল প্রায়ই দাবি জানায় অন্যদের মতো একটা টাইম মেশিন কিনে ফেলার জন্য। বলে একবার বড় ইনভেস্ট করে ফেললেই তা সংসার খরচ অনেক কমিয়ে আনবে। আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম কীভাবে। তাতে সে আমাকে প্রাথমিক যেটুকু জ্ঞান দিল তা হল, ধরা যাক এই ২০৩৪ সালে ইলিশ মাছের কিলো হয়েছে আঠাশ কে। আজকাল আর টাকা দিয়ে হিসেব হয় না ভারতে। অনেক জটিল ব্যাপার। তাই নতুন অঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে কে, অর্থাৎ হাজার, মানে থাউজেন্ড। তাতে হিসেব করায় অনেক সুবিধে হয়েছে। যদিও শতকে হিসেব উঠে যায়নি, সেখানে টাকার চল আজও রয়েছে। কিন্তু তাই দিয়ে এক কেজি ইলিশ মাছ কেনা মানে অনেক হিসেবের ব্যাপার। বরং টাইম মেশিনে চড়ে যদি আমরা কম খরচায় সামনে থেকে ২০১৮ সালে ফিরে যেতে পারি তবে সেখানে এখনও ইলিশ এক কে’তে পেলেও পেতে পারি। এতে সংসারে পয়সা বাঁচে। উদাহরণ হিসেবে পাশের বাড়ির ঘোষবাবুর নমুনা পেলাম।
গিন্নির কথা সবসময় ফেলে দেওয়া যায় না। আমি কবি মানুষ আজও, গিন্নি যা হুকুম করেন, মুখ বুজে তামিল করি। যদিও এখন শূন্য দশকের কবি শুধু নামেই রয়ে গিয়েছি ইতিহাস হিসেবে, কবিতা আর আসে না। কবিতার চিন্তা করলে কেবল ইয়া-হিয়া, হুক্কা-হুয়া, আইও রামা রামা— এই ধরণের শব্দেরা এসে ভীড় করে। এখন মার্কেটে এই ট্রেন্ড চলছে অবশ্য, আমরা পুরোনো ভাববাদী কবিরা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উঠতে না পেরে ঝিমোতে ঝিমোতে ইতিহাস হওয়ার দিকে এগোচ্ছি। কিন্তু শূন্য দশকের কবিসত্বা ফেলে আসি কোথায়, তাই এখনও আরও অনেকের মতো পত্নীপন্থী হয়েই রয়ে গিয়েছি। সুতরাং আমি তার কথায় যন্ত্রটা সম্পর্কে একটু খোঁজ নিতে এলাকা পরিভ্রমণে বেরোলাম।
কার্তিকদার চায়ের দোকানে অনেকদিন যাওয়া হয় না, এক সময় ওখানেই আমাদের যত খবর জমা হত ভেবে আজও পুরোনোর খোঁজে কার্তিকদার দোকানে চললাম। এখনও কার্তিকদাই দোকান চালায়, একইভাবে সেখানে বিভূতিদাকে বসে থাকতে দেখলাম। বিভূতিদা অনেক খোঁজখবর রাখে জানতাম, তাই দুটো চায়ের অর্ডার দিয়ে তাকেই জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা বিভূতিদা, এই যে আজকাল টাইম মেশিন না কী এসেছে, সে সম্পর্কে তুমি কিছু জানো?”
“কেন? সেকি! তুমি এখনও কিছু জানো না টাইম মেশিন নিয়ে? যাঃ বাবা, শোনোনি কিছু? কিন্তু সে তো বিশাল দাম, বহু লাখ কে। আমি অত হিসেবও রাখতে পারি না। তা তোমাদের পাড়ায় তো অনেকে চাইনীজ প্রোডাক্ট কিনেছে শুনলাম, কম পয়সায় পাওয়া যায় ওগুলো। দুনিয়া কোথায় এগিয়ে গেছে দেখেছ? ভালো কোম্পানীর নিতে গেলে অনেক দাম। অবশ্য ফাইনান্সেও পাওয়া যায়, তবে আমাদের মতো গরীব মানুষের অত দরকার নেই। তার উপর বুঝিও কম।”
“তা যেটুকু বোঝো, সেটুকুই বোঝাও। আমি তো তাও বুঝি না।”
“বোঝাবো আবার কী? ওই সেই আমাদের আমলের মোবাইলের কথা মনে পড়ে, তেমনি জিনিস। এত্ত বড় একটা ফ্রীজের মতো বাক্স। তাতে রিচার্জ করিয়ে ঢুকে পড়লেই হল। যেমন খুশি সময়ে ঘুরে আবার সন্ধ্যের সময় ফিরে চলে এসো। রাত পেরোলেই কিন্তু আবার রিচার্জ করতে হবে। তুমি যদি বারোটার মধ্যে না ফেরো তবে ওখানেই আটকে রইলে যতক্ষণ না তোমার বৌ ফের রিচার্জ করাচ্ছে। রিচার্জেও কিন্তু অনেক খরচা। লাখ লাখ কে। অত টাকা আছে তো?”
আমি বললাম, “খেয়েছে, তাহলে কেউ যদি ওখানে গিয়ে আটকে পড়ে আর তার যদি সেকেন্ড রিচার্জ করানোর টাকা না থাকে?”
“তাহলে থাকল ওখানে পড়ে। যতদিন না আবার রিচার্জ করিয়ে ফেরৎ আনছে ততদিন সেই যুগে ঘুরে বেড়াবে। তবে গেলে কাছাকাছিই ঘুরে আসা ভালো, দূরে গেলে কিন্তু বেশি খরচা। সুতরাং ফেরার খরচাও বেশি। গিয়ে দেখে আসতে পারো একবার, অনেকেই তো রিচার্জ করে এর ওর মেশিনে চড়ে যাচ্ছে। আমিও ভাবছি মরার আগে একবার দেখেই আসব। কতকিছুই তো দেখলাম জীবনে।”
“আচ্ছা, তাহলে বেচছে কারা? মানে বাজারে পাওয়া যাবে?”
“বাজারে আজকাল কয়েকটা দোকানে চাইনীজ মাল রাখছে বটে। তবে টিঁকবে কদিন তার ভরসা কম। বড় কোম্পানী তো সব কলকাতায়। তুমি অর্ডার দিলে এখানে ডেলিভারি বসিয়ে যাবে। তা নেবে নেবে ভাবছ নাকি?”
“না, ওই আর কী। নতুন জিনিস, তাই বেশি খোঁজ। সেই নতুন মোবাইল নিলে আলোচনা করতাম মনে পড়ে?”
“পড়বে না আবার? বুঝলে ভাই, কম্পিউটার হোক বা টাইম মেশিন, কিন্তু খোঁজ নেওয়ার স্বভাব কিন্তু বাঙালির রক্তে।”
আমি বললাম, “তা বটে।”
সেদিনকার মতো বাড়িতে ফিরে এসে মোবাইলে ইন্টারনেট খুলে বসলাম। এখন অবশ্য ইন্টারনেট মোবাইলে চলে না, কীসব আরও যন্ত্র বেরিয়েছে, কথা বললেই কাজ হয়ে যায়। তবে আমার একটা পুরোনো ২০২০ মেড স্মার্টফোন আস্ত আছে। সামান্য কাজ, তাতেই চলে যায়। তাই খুলে দুপুরে বসে যন্ত্র সম্পর্কে অনেক জ্ঞান লাভ করলাম।
সেখানে বলা আছে এই রেভোলিউশন শুরু হয়েছিল সেই ২০১৭ সাল থেকে। যখন নেটফ্লিক্স নামের এক ওয়েব চ্যানেলে ডার্ক নামের একটি জার্মান ওয়েব সিরিজ মুক্তি পায়। সিরিজটি এতই জনপ্রিয়তা পায় ২০২০-র লক ডাউন বাজারে যে সেটি তখনকার যুগের নব্যপ্রজন্মের মধ্যে একটা চেতনার জোয়ার আনে। সেই সুবাদেই ২০৩০ সাল নাগাদ জন্ম নেয় আধুনিক টাইম মেশিন। সৌজন্যে সেই অ্যাপল কোম্পানিই আজও। কিন্তু চিরাচরিতভাবে তাদের তৈরি জিনিসের দাম সর্বাপেক্ষা বেশি। তবে যা তথ্য পেলাম তাদের মেশিনে চেপে পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেও ঘুরে আসা যায় যদি পকেটে রেস্ত থাকে। তাদের সঙ্গে নাসা হাত মিলিয়ে আজকাল নিজস্ব মহাকাশযানে বিগ ব্যাং দেখিয়ে আনার সুবিধাও এনেছে। এরপর আস্তে আস্তে পৃথিবীর জন্ম হয়ে জল, অ্যামিবা, ব্যাঙাচি, ডাইনোসর হয়ে একেবারে আজকের মানুষ অবধি দেখিয়ে আনার টাইম ট্রাভেল প্যাকেজও আছে। তবে সে সব কয়েক লক্ষ কোটি কে’র ব্যাপার। আমাদের উপায় আপাতত চাইনীজ টাইম মেশিন অবধি সীমিত।
সন্ধ্যের চায়ের সময় নন্দিতার সঙ্গে বসা গেল টাইম মেশিন নিয়ে। সকাল থেকে অনেক চর্চা করেছি, তার শখ মেটানোর উপায়ের কোনও রকম আয়োজন করা যায় যাতে তাই খানিক কথাবার্তা। আমিই শুরু করলাম বিজ্ঞের মতো মুখ করে, “বুঝলে তো, তোমার ওই টাইম মেশিনের জন্ম কিন্তু সেই মনে আছে ২০২০ সালের ডার্ক থার্ড সিজন থেকেই, ইন্টারনেটে যা বলছে। আমার কিন্তু এখনও মনে আছে সেই ফেসবুকে খুব মাতামাতি করেছিল সবাই।”
“হুঃ, তুমি মনে হচ্ছে দেখোনি? আমার বেশ মনে আছে তুমিও শেষমেশ দেখেছিলে। হুজুগে তুমিও মেতেছিলে স্বীকার কর না কেন?” নন্দিতা উত্তর দিল।
“সে যাক গে, অত মনে থাকে না। কিন্তু যা দেখলাম সেই আমল থেকেই অনেকে রিসার্চ করেছে, যার ফল আজকের এই টাইম মেশিন।”
“ধুর, ওসব তো সবই জানি আমি। তা তোমার এত জানার শখ কেন বলতে পারো? অনেকদিন বাদে কবিতার বইয়ের অর্ডার এসেছে নাকি? অ্যাডভান্স দিয়ে কিনবে ভাবছ? ও আশায় জল দাও, অনেক দাম।”
“না, মানে শুনলাম কম পয়সাতেও পাওয়া যায়। তাই দেখছিলাম আর কী!”
“ওসব তো নতুন আমদানী চাইনীজ। নিলে কোম্পানির জিনিসই নেওয়া ভালো। তা চাইনীজও নিচ্ছে অনেকে। দেখ, যা ভালো বোঝো।”
বুঝলাম চাইনীজ হলেও একখানা নেওয়ার ইচ্ছে তার ষোলআনা। আরেকটু বাজাতে বললাম, “তা নিলে কী কী সুবিধা আছে ভেবে দেখ। শেষে এত ইনভেস্ট করে ঘর সাজানোর জিনিস নিতে চাই না।”
“প্রচুর সুবিধা। আগেই তো বললাম যে সংসার খরচা কমে যায়। মাসে একবার রিচার্জ করিয়ে মাসকাবারি বাজারটা করে আনলেই যথেষ্ট।”
“ওটুকু শুনে লাভ আছে। কেমন দেখতে তাই জানি না। ছবি দেখেছি মাত্র। তুমি দেখেছ?”
“দেখিনি মানে? ওই যে সেদিন দিব্যাদিদের বাড়িতে গেলাম, ওরাই তো কিনেছে। এলজি কোম্পানির। আমাকে তো বলল ওরা নাকি গেলবার পুজোয় ইটালিতে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি মোনালিসা আঁকছে তাই দেখতে গিয়েছিল। তবে খাবারদাবারের খুব দাম। বাড়ির থেকে খাবার বানিয়ে নিয়ে যাওয়া ভালো। নইলে অনেক সময় পুরোনো পয়সা ছাড়া আমাদের পয়সা নিতেও চায় না শুনেছি। অবশ্য এখন জাদুঘরগুলোতে পুরো পয়সার স্টোর খুলেছে শুনেছি। কিন্তু অনেক টাকা নেয়।”
“তুমি দেখেছ ওরা ঘুরতে গেল আবার ফিরেও এল? কেমন জিনিস ওটা বলো তো একটু?” আমি কৌতূহলী প্রশ্ন করলাম।
“কেমন আবার। একখানা মস্ত বড় ফ্রিজের মতো বাক্স, উপরে আবার ডিজাইন করা। আমি অবশ্য ওদের ঘুরতে যেতে দেখিনি, তবে আমাকে বলেছে কীভাবে যায়। একটা কার্ড আছে, দোকান থেকে রিচার্জ করিয়ে আনতে হয়। তারপর যন্ত্রটায় ঢুকে দরজা আটকে ভিতরে একটা কার্ড পাঞ্চ করার জায়গা আছে, সেখানে কার্ডটা ঢুকিয়ে সাল তারিখ দিয়ে দিলেই যন্ত্রটা তোমাকে সেই সময়ে নিয়ে যাবে। সকাল বারোটা থেকে রাত বারোটা অবধি তুমি যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতে পারো। যত পয়সা ভরবে, তত পাস্টে তুমি যেতে পারো। তা আমি বলি কী, চলো না একদিন আমাদের নামে একটা কার্ড নিয়ে আমাদের নব্বুই দশকে গিয়ে দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে দেখে আসি দুজনে মিলে। আমার কতদিনের শখ জানো ওই সিনেমাটা দেখতে দেখতে হলে প্রেম করার। তখন ছোট ছিলাম বলে পারিনি। মেট্রোয় দেখে ময়দানে বাদাম খেয়ে ফিরে আসব দুজনে।”
“হ্যাঁ, বেশ ভালো পরিকল্পনা কিন্তু। সেসব প্রেমের কথা আজ কেবল বইয়েই পড়া যায়। তা কেমন খরচা হবে গো?”
“কত আর হবে। তুমি আমি দুজনের হাজারখানেক কে পার হেড।”
“তাহলে আমাদের একটা ফিক্সড ডিপোজিট ম্যাচিওর করলে সামনের বার পুজোয় একদিন যাব দুজনে। কেনাকাটা করেই ফিরব, সস্তায় হবে।”
“ওসব ভুলে যাও। কেনাকাটা হবে না। মনে নেই ২০১৬ সালের পর নোটবন্দির পর পুরোনো নোট অচল হয়ে গিয়েছে। কেনাকাটা করতে গেলে ২০১৭ সাল নাগাদ যেতে হবে। তাও সস্তা ছিল।” নন্দিতা মুখটা গম্ভীর করে বলল।
আমি বললাম, শুনেছি অনেক বিপদ আপদও আছে। এই তো বটতলায় শুনলাম নাকি অপূর্ববাবু আজকাল হামাগুড়ি দিয়ে বেরোচ্ছেন। নিজের ছোটবেলায় যেতে চেয়েছিলেন, যন্ত্রের কী গোলযোগে ফেরৎ এসেছেন শিশু হয়ে। মানে শরীর, আয়তন, হাত, পা সব একই আছে, কিন্তু বুদ্ধিটা পাকেনি। মাঝে মাঝেই বৌয়ের হাত ছাড়িয়ে অতবড় মানুষটা হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে চলে আসেন। কী বিপর্যয়!”
“ধুর, ওরা ব্যবহার করতেই জানে না। তা ওনার স্ত্রী তো কার্ড রিচার্জ করিয়ে ফিরিয়ে আনতে পারেন। পয়সার তো অভাব নেই? এমন বাইরে কেও ছেড়ে দেয়। হামাগুড়ি দিয়ে যদি বাইরে রাস্তায় চলে আসে তবে কেউ তো অতবড় চেহারাটায় ধাক্কা খেয়ে হাত-পা ভাঙবে।”
“আর ফেরৎ আনবে কী? বললাম না যে বুদ্ধিটাই শিশুদের মতো হয়ে গেছে। ওই বাক্সে তো একা ঢুকতে হয়, অন্য কেউ থাকতে পারে না। অপূর্ববাবু এখনও অ আ ক খ-ই শেখেননি তো নম্বর আর সাল। এখন আগে স্বরবর্ণ, ব্যাঞ্জনবর্ণ, অঙ্ক, যোগ, বিয়োগ, ঘড়ি, সাল, মাস সব শিখুক, তারপর তো যন্ত্রে ঢুকে নম্বর চাপবে। তা বৌদি বলছিল নাকি সামনের বছরেই কিডজিতে ভর্তি করে দেবে। ওখানে বাচ্চাদের বুদ্ধির বিকাশ খুব তাড়াতাড়ি হয়।”
“অত চিন্তা কোরো না তো। ওরম টুকটাক সমস্যা সবকিছুতেই হয়। দেখ তো ঝন্টুবাবুকে। কী সুন্দর বুদ্ধি করে পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে নিয়েছে।”
“ওরেবাবা, সে তো এমনিতেই মহা কিপটে। নিজের বাড়ির হাওয়াটুকু পর্যন্ত বাড়ির বাইরে যেতে দেয় না। খরচার ভয়ে বিয়ে করেনি কিপটে, সে আবার টাইম মেশিন কিনেছে নাকি? তা কী করে তাই নিয়ে? ঘর সাজাতে কিনেছে নিশ্চয়ই, চড়েনি।” বেশ অবাক হলাম।
তাতে নন্দিতা যা উত্তর দিল, “তুমি এও জানো না? হেব্বি বুদ্ধি করেছে। টাইম মেশিন কিনে একবার রিচার্জ করিয়ে সেই ১৯৮০ সালের যৌবনে ফিরে গিয়ে সেখানে নিজেই নিজেকে দত্তক নিয়েছে। এখন যেই ২০৩৪ সাল আসে, অমনি উনি রিচার্জ করিয়ে ’৮০তে গিয়ে আবার গিয়ে দত্তক নিয়ে আসে। আর ফেরৎ আসে না। তারপর আবার নিজেই নিজের ছেলে হয়ে সব সম্পত্তি আগলে রাখে। পঞ্চাশ বছরে একবার রিচার্জ, আর তাতে সম্পত্তিসমেত অমরত্ব লাভ করেছেন। তবে ২০৩৪ সালের পর আর তিনি যেতে পারেন না। তাতে কী আছে? অতবড় সম্পত্তিটা তো দেখেশুনে রাখতে পারেন।”
“ওরেবাবা, এ তো সেই ডার্কের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সেই লুপ-টুপ নিয়ে কীসব দেখিয়েছিল মনে পড়ে? তেমনি কাণ্ড চোখের সামনে দেখছি তো। তবে ওনার না হয় পরিবার পরিজন নেই, কিন্তু ফ্যামিলি থাকলে অনেক বিপদ আছে।” আমি সংশয় প্রকাশ করলাম।
“কেন, ভয়ের কী আছে? একটু হিসেব করে চলতে হয় এই যা। সে তো কম্পিউটার যখন এল, তখনও মানুষ খুব রয়েসয়ে ব্যবহার করত মনে পড়ে? তারপর তো জলভাত হয়ে গেল। তুমি কেবল বেশি চিন্তা করো।”
“চিন্তা করব না আবার? ওপাড়ার বোসবাড়ির ঘটনা তো জানো না। জয়েন্ট ফ্যামিলি, বনেদী বংশ, পয়সাও প্রচুর। তা পরিবারের শখ হয়েছিল বাড়ির ছোট চার ছেলেকে কয়েকদিনের জন্য স্বাধীনতা সংগ্রাম কাকে বলে দেখতে পাঠাবে যাতে ভিতরে জাতীয়তাবোধ তৈরি হয়। মাসখানেক ছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়। তখন কোন মতিভ্রমে বিদেশি সঙ্গদোষে কী ফস্টিনষ্টি করেছে কে জানে, এখন ফিরে এসে দেখে কারোর মা তার কাকা হয়ে গেছে, কারোর বাবা তার দূর সম্পর্কের দিদিমা। কদিন আগে যে জামাইবাবু ছিল, আজ সে নাকি তার দাদু। সুতরাং অতীত নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া না করাই ভালো বলে আমার মত।”
“ওরম বেলেল্লাপনা করলে অমন হবেই। আমিও খানিক শুনেছি তারা নাকি ওই সময় নিজের বাড়িরই কোন পূর্বপুরুষের পাল্লায় পড়ে বখে গিয়ে কার কার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিল কদিন, ফিরে কেউ কারোকে চিনতে পারছে না। সব উল্টোপাল্টা হয়ে গিয়েছে। তবে কিন্তু তবে কিন্তু রামদা’র ছেলের এডুকেশন খুব ভালো হচ্ছে। বিশ্বভারতীতে চান্স তো পেয়েইছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে নাকি ডাইরেক্ট পড়াশোনা শেখে। তবেই বোঝো। আমাদেরও তো এবার ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে নাকি?”
“তাহলে একবার ভবিষ্যত থেকেই তো ঘুরে আসা যায়। কত আধুনিক হয়ে গিয়েছি আমরা তা দেখাই যাবে।” আমি বললাম।
“আমার কী আর সেই কপাল আছে? দিব্যাদিরা সামনেই ফ্লাইং কার কিনছে দেখে এসেছিল টেস্টিংয়ের দিন। আর আমি গিয়ে তোমার তো সেই একই হাল দেখব, কবিতার পাতা, বেসিনে দাড়ি, ঘরের কোনায় ঝুল, আর ইংরেজ আমলের জিন্সের প্যান্ট। গিয়ে কী লাভ? বরং যদি পাস্টে গিয়ে বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু উন্নতি করতে পারো। একটা পামটপ পর্যন্ত কিনলে না। এখনকার ছেলেমেয়েরা চশমা পরে পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়। আর তুমি সেই ফোর জি জিওতে পড়ে আছো।”
“কিন্তু আমি তো এই ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানি না। কোন কোম্পানি ভালো কী মন্দ। শুনেছি অনেক দুর্ঘটনাও ঘটে। অপূর্ববাবুর কথাই ভাবো।”
“ওরা তো ওয়্যারেন্টি ছাড়া কী সস্তা চাইনিজ মাল কিনেছিল বলে ভুগছে। চাইনিজ মানেই কী খারাপ? এই তো ভিভো, অপো, জিওনি, ওয়ান প্লাসরাও মার্কেটে এসেছে। যেমনি ফিচার তেমনি সার্ভিস। সবসময় বড় কোম্পানির জিনিস কিনতে হবে তার কী মানে আছে? আসল কথা হল সার্ভিস।”
“কিন্তু সেখানেও তো অসুবিধা। এখন তো কলকাতা ছাড়া সার্ভিস পাওয়া যায় না। সরকারদাই তো কোন ভালো কোম্পানির জিনিস কিনেও জ্যান্ত গিয়ে কেঁচো হয়ে ফেরৎ এসেছে। বৌদি কাঁদতে কাঁদতে বলছিল মেশিনের গণ্ডগোলে সাল মিস করে কততম পূর্বজন্মে চলে গিয়েছে। শেষে সার্ভিসের লোক মেসিন নিয়ে গিয়ে আবার ঠিকঠাক ফেরৎ দিয়ে গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু মাসখানেক কেঁচো হয়ে ঘুরে বেড়ানো কী ভালো কথা?”
“ওটুকু সবকিছুতেই হয়ে থাকে। অ্যাপল কোম্পানির কী কিছু হয় না? নইলে সার্ভিস সেন্টার খুলে রাখে কেন? এটুকু রিস্ক সবেতেই আছে। এখন আসল কথা বলো তো কবে কিনছ? সামনেই পুজো আসছে।”
“তা তোমার আমার মিলে যা আছে তাতে কিন্তু কম পড়বে। দু-একবার এদিক ওদিক ঘুরতেও তো যেতে হবে। ধরো একবার যদি সত্তর দশকটায় ঘুরে আসতে পারতাম কলকাতার অলিগলি বেয়ে।”
“ছাড় তো তোমার প্রাচীন যুগের কবিতা। একটু আধুনিক হও এবার। মেসিনটা কিনেই ফেল অত না ভেবে। তারপর কেমন আধুনিক কবিতা বেরোবে মিলিয়ে নিও। আর বাকি পয়সার কথা চিন্তা করতে হবে না, বাজাজ ফাইন্যান্স আছে।”
অনেক আলোচনার পর এক শুভদিন দেখে বাজাজ ফাইনান্স মারফৎ ভিভো কোম্পানির একটা মেশিন কিনেই ফেললাম, যদিও খরচটা সবমিলিয়ে একটু বেশিই পড়ল। দুজনের জন্য দুখানি রিচার্জ কিনে পকেটও ফাঁকা। বাড়িতে নিয়ে এসে প্যাকিং খুলতেই দেখলাম আমাদের জন্মের আগের পুরোনো আমলের লোহার একখানি রেফ্রিজারেটরের মতো বাক্স। কোম্পানীর লোক ডেমোও দিয়ে দিল যাবতীয়। নন্দিতা ২০১৯ সালে তার বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেরিয়ে সিনেমা দেখে কেনাকাটা করে ফিরল খানিকক্ষণ আগে। বড় খুশি। এইবার আমার যাত্রাপর্ব। ভাবছি ছেলেবেলায় মায়ের আদর খেয়ে আসি। বড় মূল্যবান সেই জিনিস।
কিন্তু যাত্রা থেকে ফেরৎ আসা অবধি সব ঠিক ছিল, তবু শেষ মুহূর্তে লোডশেডিং হওয়ার পড়লাম বিপর্যয়ে। অনেক পয়সা খরচ হয়ে যাওয়াতে পাওয়ার ব্যাকআপ রাখার পয়সা ছিল না আর। তাই ইউপিএস কেনা হয়নি। কারেন্ট আসতে মেসিন আপডেট আর রিসেট হয়ে আমি গিয়ে পড়লাম সেই ছোটোবেলায়, যাকে বলে দুগ্ধপোষ্য অবস্থায়।
নন্দিতা কাস্টমার কেয়ারে ফোন করায় তারা জানালো আরেকবার রিচার্জ করিয়ে আমাকে ছোটবেলায় পাঠিয়ে আবার সেখান থেকে ফেরত আনলে ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু রিচার্জ করানোর পয়সা জোগাড়েই তিন মাস সময় লাগবে। যেতে আমার কোনও অসুবিধা নেই, বুদ্ধিশুদ্ধি ঠিকই আছে, তবে হাতপাগুলো কেমন ছোট ছোট গোল গোল হয়ে গিয়েছে। পায়ে দাঁড়ানোর জোর নেই বলে খালি হামাগুড়ি দিতে হয়। চেষ্টা করলে অবশ্য ঘষটে ঘষটেও চলতে পারি, কিন্তু দাঁড়িয়ে হাঁটতে পারি না। তবু কাঁপা কাঁপা হাতে ওতে ঢুকে ছোটবেলায় চলে যাব ভরসা আছে যদি পয়সা জোগাড় হয় তবে।
তা ছাড়াও নন্দিতা ওয়্যারেন্টির অ্যাপ্লাই করেছে। তাও দেড় মাসের ধাক্কা। মেয়েটা বড় একা হয়ে গিয়েছে। অবশ্য কদিন আগেই একটা ইস্যুর কথা চলছিল, সে অভাব মিটেছে। আমি কেবল আমার হবু ছেলের মতো বিছানায় শুয়ে থাকি। নন্দিতার খাটনিও বেড়েছে। সকালে আমাকে হাগিস পরিয়ে রেখে বাজার করা। আমি অ্যা করে ফেললে পরিষ্কার, ঝিনুকে করে সেরেল্যাক খাওয়ানো সব একার হাতে সামলায়। আমি সব বুঝতে পারি, কিন্তু মাঝে মাঝে দু হাত পা তুলে ওয়্যাঁয়াঁ ওয়্যাঁয়্যাঁ করে আস্ফালন বাদে কিছুই করতে পারি না। প্রায় বছর পনেরো বাদে আবার সেই ডার্ক ওয়েব সিরিজের সম্পর্ককেন্দ্রিক তত্ত্বগুলোকে মিলিয়ে নিচ্ছি আপাতত অবসরে।
“কী ব্যাপার, এরকম ঘামছ কেন?” নন্দিতার ঝাঁঝাঁনিতে ধরাম করে লাফিয়ে উঠে বললাম, “কই, নাতো!”
“না মানে কী, দেখছি ঘামছ। শরীর খারাপ বাধালে নাকি? করোনা ধরল না তো। কতবার বলেছি ওরম ড্যাং ড্যাং করে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেরিও না, হল তো?”
গলায় হাত দিয়ে দেখলাম খুব ঘেমে গেছি বটে। এতক্ষণ কোথায় ছিলাম কিছুই পরিষ্কার হল না। সম্বিৎ ফেরাতে নন্দিনীকে জিজ্ঞেস করলাম, “হ্যাঁ গো, একটা প্রশ্ন করব? মুখঝামটা দেবে না তো?”
“কী বলো। সন্ধ্যেয় ফূর্তি করতে দিতে পারব না।”
“না না, ওসব না। বলছি যে এটা কোন সাল?”
নন্দিতা এই শুনে কেমনভাবে একটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “মাথাটা গেছে তোমার ওই ওয়েব সিরিজ দেখে। এতদিন জেগে জেগে দেখছ, এবার ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও শুরু হল। আমি শিওর করোনা ধরেছে তোমার। হে ভগবান, তোমার আমাকেই পাঠাতে হল এই লোকটার বৌ বানিয়ে?”
আমি একটু ভালোবেসে বললাম, “কী যে বল, তুমি কী আমার শুধু বৌ নাকি? আরও কত কী?”
তারপর থেকে ডার্ক দেখা আমার সেকেন্ড সিজনের সাত নম্বর এপিসোডে আটকে আছে। কারণ আমার শেষ কথাটাকে ডার্ক দেখার সাইড এফেক্ট ভেবে নন্দিতা তখনই মোবাইল কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে ও সেটি দেহরক্ষা করে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।