সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রবন্ধে সম্বুদ্ধ সান্যাল (পর্ব – ১৪)

অবতার এবং সপ্তেন্দ্রিয়

বাজার থেকে ফিরে কোনওমতে ব্যাগটা রান্নাঘরে নামিয়ে নন্দিতাকে বললাম, “জানো তো, বাজারে আজ কী কেলেঙ্কারি কাণ্ড!”
নন্দিতা বিরস মুখে বলল, “তা বাজারে কেলেঙ্কারি হবে না তো কোথায় হবে, মন্দিরে? বাঙালি পুরুষ বাজার করতে গিয়ে দু-চারটে ওরম ছোটখাটো কেলেঙ্কারি না করে ফিরলে চলে না।”
থতমত খেয়ে বললাম, “আরে, আমি কেলেঙ্কারি করব কেন? যাও, গিয়ে দেখে এসো, সেখানে সাক্ষাৎ কল্কি অবতার এসেছে। তাই নিয়ে লোকজনের কী হৈচৈ!”
“ধুসস… যত সব ভণ্ড। কল্কি অন্য জায়গার থেকে আসবে কী করে আমাদের ভোম্বল থাকতে। কাবেরীপিসি তো এক প্রকার নিশ্চিত সেই সাক্ষাৎ কল্কি অবতার। এই বয়েসেই কী তেজ!”
“কাবেরীপিসি মানে তোমাদের সেই আগের পাড়াতুতো পিসি? ভোম্বল কি তার ছেলে নাকি? তার আবার কী ঘটনা?”
“ছেলে নয়, নাতি। ওদের আবার ঘটনা ঘটে নাকি, সব লীলা। ওরম বোলো না। জানি নাস্তিক ব্যাপারটা তোমাদের ফ্যাশন, তবু সবসময় কবিত্ব না ফলালেই কি নয়? ভোম্বল এই বয়েসেই এক সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার যা শুনেছি। বয়েস মাত্র সাত, এদিকে তার রোয়াবে নাকি ও পাড়া তটস্থ। কদিন আগেই তার স্কুলের হেড মাস্টারের পেছনে ষাঁড় লেলিয়ে দিয়েছে, তার চেয়ে বড় কোন ছেলের উপর রাগ করে ঢিল ছুঁড়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে— এমনি কত কত কাণ্ড। নিজের বাবাটাকেই তো তিনবার হাসপাতালে পাঠিয়েছে তাকে শাসন করার জন্য। এই শেষবার পাঠানোর পর কাবেরীপিসি একদম শিওর হয়ে তার একখানা বিগ্রহ বসিয়েছে ঠাকুরঘরে যে এ ছেলে সাক্ষাৎ কল্কি অবতার না হয়েই যায় না।”
“আরে অমন নয়। বাজারের লোকটার সাক্ষাৎ অবতার। গায়ে লাল বসন, লম্বা লম্বা দাড়ি, কোমরে তরোয়াল, আবার একটা ঘোড়াও নিয়ে এসেছে। প্রথমে তো কী দাপট, তুমি তো দেখোনি। ভোম্বল তো বাচ্চা ছেলে, অবতাররা ওরম বাচ্চা হয় না।”
“সেকি, মজার ঘটনা তো! তারপর, তারপর?”
“তারপর আর কী? এই তেজ নিয়ে ঘোড়ার থেকে নেমে আমার পাশ দিয়ে গট গট করে মুরগির দোকানে গিয়ে বলল মাংস দিতে। তা এরম অচেনা লোক দেখে একটু অবাক হয়ে লাল্টু মাংস দিয়েছে কী সাধু পয়সা না দিয়ে বেরিয়ে আসছে। লাল্টু তো রেগে খাপ্পা। অমনি চেপে ধরে বলে পয়সা দিয়ে। তখন সাধুর মেজাজ দেখে কে? তুমি তো দেখোনি, আমি দেখেছি, উরিব্বাবা কী তেজ!”
“তারপর, তারপর?”
“তা মেজাজ দেখালেই হবে? লাল্টুরাও বাজারে চল্লিশ বছর ধরে মুরগী কাটে। বলে ওসব অবতার-টবতারের গল্প শুনব না। ব্যাটা ধান্দাবাজ ভণ্ড সাধু। পয়সা না দিয়ে কেটে পড়ার তাল? থাকিস কোথায়? সাধু বলে নাকি সে এই ঘটকবাঁধের আদ্যা আশ্রমে নতুন এসেছে। আপাতত নাকি ভারত ভ্রমণ করে অবস্থা দেখে নিচ্ছে। তারপরে সব কচুকাটা করবে। বোঝো!”
“তা পাবলিকে মারেনি ওকে? যতসব ভণ্ড। আমি তোমাকে বলছি না, ওই ভোম্বলই দেখো কল্কি অবতার বেরোবে শেষ পর্যন্ত। পাড়ার লোকে তো এখনই ফল-নৈবেদ্য পৌঁছে দিয়ে আসছে বাড়িতে। এরা ছুটকোছাটকা।”
“কখনই না। তুমি দেখে এসো গিয়ে তেজ কাকে বলে। চোখই বলে দিচ্ছে সাক্ষাৎ অবতার না হয়ে যায় না। তা পাবলিকে মানবে কেন? যেই না সাধু বলে ওসব টাকা-পয়সা কী সে জানে না, ব্যাস লাল্টু অমনি বঁটি নিয়ে তার গলায় চেপে ধরেছে।”
“সেকি! তুমি যে বললে তার কোমরে নাই তরোয়াল আছে। ভয় পেলো না?” নন্দিতা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
আমি বললাম, “লাল্টুর বাবা কে ছিল জানো? হুঁ হুঁ বাওয়া, নকশাল পিরিয়ডে গিরিধারীর নাম শোনোনি তো। এক সময় পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে কত আমলা পিটিয়েছে। শেষে সিপিয়েম সরকার এলে জেল থেকে বেরিয়ে মুরগির ব্যবসা ধরেছিল। রক্ত বলে একটা ব্যাপার আছে তো। সাধু সময়ই পায়নি তরোয়াল বের করার, অমনি গলায় বঁটি, সাধু আর যায় কোথায়?”
“সেকি, তা সে তো তোমার কথায় অবতার বলে কথা। কোনও ভেল্কিটেল্কি দেখালো না?”
“তা আর দেখায়নি? কিন্তু জাতটাও তো দেখতে হবে, বাঙালি বলে কথা। যেই না লাল্টু গলায় বঁটি ধরেছে, অমনি সাধু ঝোলার থেকে কীসব বের করে ফুঁ দিতেই চারিদিক অন্ধকার। ভাগ্যিস এ বেলা সেখানে সাহাদা ছিল। এককালে সাহাদারই কত নাম ছিল ম্যাজিক দেখানোয়, এই ভেল্কি তো তার মুখস্থ। ধোঁয়া ভরতেই চেঁচিয়ে উঠেছা যে লাল্টু, এইবেলা কিন্তু তোর দুই পায়ের নিচ দিয়ে সাধু পালাবে, ওয়াচ। ব্যাস, লাল্টু অমনি আবার ধরেছে সাধুকে। গুটি গুটি সরে পড়ার তালেই ছিল, যাবে কোথায়, একেই বলে বাঙালি বুদ্ধি।”
“তা তুমি কী করছিলে? বাড়ি বসে তো কলম দুলিয়ে বড় বড় লেকচার ঝাড়ো। কিছু একটা করতে পারলে না?”
“তা করিনি আবার? জানোই তো কলম আমার পকেটে থাকে সবসময়। ওই দেখেই তোমার বাজারের ফর্দের পেছনে দুই লাইন লিখে ফেলতে গিয়ে ভাবলাম এত তাড়াতাড়ি ঠিক বিদ্রোহ ফিলিংটা তেমন আসছে না। তাই তাড়াতাড়ি তোমায় বাজার নামিয়ে দিয়ে আবার যাব। এতক্ষণে নিশ্চয়ই খেল অনেক জমে উঠেছে। সাধুর যা তেজ দেখলাম এত তাড়াতাড়ি হাল ছাড়বে না। অবতার না হয়েই যায় না আমি বলছি। এতক্ষণে নিশ্চয়ই তার বিদ্রোহী ফিলিংটা চলে এসেছে। লড়াই জমল বলে, চললাম আমি।”
বাজারে গিয়ে দেখি তথাকথিত কল্কী অবতারের হাত-পা ততক্ষণে এলাকার লোকেরা ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে বেঁধে ফেলেছে, এমনকি তার লম্বা লম্বা দাড়িগাছাকেও। বোঝাই যাচ্ছে কথা বলতে গেলে তার দাড়িতে এর জন্য টান পড়ছে, ফলত সে দুই হাত-পা দিয়ে ল্যাম্পপোস্টটাকে কোনওমতে জড়িয়ে ধরে কথাবার্তা চালাচ্ছে। ওই অবস্থাতেও তার কথাবার্তায় তেজের একটুও ঘাটতি পড়েনি দেখে আমি আরও বেশ নিশ্চিত হলাম এই সাধু কোনও অবতার না হয়েই যায় না। ততক্ষণে অবশ্য থানা থেকে পুলিশও এসে পড়েছে। তারাই বেশিরভাগ জিজ্ঞাসাবাদ করছে ও এলাকাবাসীরা সহযোগীতা। কবি হিসেবে আমাকে অবশ্য এলাকার লোকেরা খানিক মান্যিগন্যি করে, তাই সবাইকে ঠেলেঠুলে এগিয়ে গিয়ে সাধুর কথাবার্তা শোনা গেল। সে তখনও কোনওমতে বলে চলেছে, “আরে মূর্খ লোকেরা, শাস্ত্রের বাণী তোমরা অগ্রাহ্য করে চলেছ। এর ফল ভুগবেই ভুগবে।”
অমনি পাশের থেকে এক পুলিশ এসে তার রুলটা দিয়ে পায়ের দিকে মারার ভঙ্গী করে বলে উঠল, “চুপ শালা মুরগী চোরের অবতার। আবার শাস্ত্র দেখাচ্ছে। ভূতের মুখে রামনাম। ফের একটা কথা বলবি তো ঠেঙিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেব।”
সাধু আবার বলে উঠল, “কি বিপদ, আরে কীভাবে বোঝাব আপনাদের যে আমিই সেই কল্কী, যার কথা আপনাদের পুরাণে লেখা আছে। আমার মাধ্যমে কোথায় আপনারা জেগে উঠবেন, তা নয়, উলটে আমাকে এখানে বেঁধে রাখার কোনও মানে আছে? আমাকে খুলে দিয়ে আশ্রমে নিয়ে চলুন, আমি দলিল দস্তাবেজ দেখাচ্ছি।”
“আচ্ছা, বুঝলাম। তা এবার বল তোর আসল নাম কী?”
“আসল নাম আবার কী? ওই তো বললাম, কল্কী। আর পদবী অবতার।”
“রেশন কার্ড আছে কাছে? বা আধার, ভোটার কোনও কার্ড?”
“ওসব কী জিনিস? আমি অবতার, ওসবের কোনও দরকার পড়ে না কবের থেকে বলছি। নয় নয়টি বার এই পৃথিবীতে এসেছি, কেউ দেখতে চাইল না এতদিন, আর কলিযুগে এসব কী শুরু করেছেন বলুন দেখি? এর জন্যেই তো আমি এসেছি যে এসব দূরাচার বন্ধ হোক এবার। আর কয়েকটা দিন পরেই আমার দুনিয়া উলটে পালটে দেওয়ার কথা। তা কোথায় সহযোগীতা করবেন, তা নয়, আমাকেই বেঁধে রেখেছেন। এসব কী ধর্মে সইবে?”
পাশের থেকে হরিপদ জ্যেঠু অনেকক্ষণ ধরে গজ গজ করছিল। এবার আর থাকতে পারল না। বলে উঠল, “দেখ বেয়াদপ। ওসব শাস্ত্রটাস্ত্র আমাকে শেখাতে আসিস না। বলি তুই যে তখন থেকে বলছিস তুই কল্কী অবতার, তা কাগজপত্র না থাক, কোনও লক্ষণটক্ষণ আছে। কোনও জড়ুল, বা উল্কী? নইলে আমরা কীভাবে বুঝব তুই চোর না অবতার?”
“না, নেই। তবে চারদিন ধ্যান করতে দিলে আমার মাথার পেছনে জ্যোতি দেখিয়ে দিতে পারি। আশ্রমে গিয়ে দেখে আসবেন।” সাধু বলল।
অমনি ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি ফটকে দারোগার কাছে গিয়ে ফিস ফিস করে কানে কানে বলল, “কিচ্ছু বিশ্বাস করবেন না স্যার, অমনধারা এলইডি লাইট বেরিয়েছে আজকাল। চুলের নিচে সেট করে দিলেই আপনারও মাথার পেছনে জ্যোতি বেরোবে।”
ফটকের কথা শুনে দারোগাবাবু হন হন করে সাধুর সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল, “চালাকি করার আর জায়গা পাও না। আমরা এখনও গাছের ছাল পরে ঘুরে বেড়াই ভেবেছিস? রাখ তোর ওই ম্যাজিক। বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাচ্ছিস?”
সাধু খানিক হতোদ্যম হয়ে আবার বলল, “আচ্ছা, তবে ওই কথাই রইল। তোমাদের বিশ্বাস করানোর জন্য তবে আমাকে বিশ্বরূপটাই দেখাতে হবে। সেই কৃষ্ণ অবতারের পর দুনিয়া বোধহয় এত রসাতলে যায়নি। দু’দিন, দু’দিন সময় দে আমাকে, বড় করে সবাইকে বিশ্বরূপ দেখিয়ে দেব। তখন বুঝবি।”
“আরিব্বাস। সবাই দেখতে পাবে একসাথে? পারবেন আপনি?” সাগরকাকা এবার বলে উঠল।
“কেন পারব না? তবে তার আগে আমাকে মনোঃসংযোগ করতে হবে। খুব বড় ব্যাপার কিনা। একেবারে শেষ মুহূর্ত ছাড়া আমি এসব দেখাই না।”
“তাহলে বাবাজি, দয়া করে করুণা সংঘের মাঠেই তাহলে দেখিয়ে দিন না। কতদিন নাটক, যাত্রা এসব দেখি না। এখন তো ওসব উঠেই গেছে। তা যদি বাবা দয়া করে আমার জন্যও একটা কিছুর পাঠ রাখেন তো বড় খুশি হই। এককালে যাত্রাটাত্রা করতাম, একটুও চিন্তা করবেন না। এখনও কেমন বলতে পারি দেখুন, রে পামর, রে দূরাচার, তোমারে করিব আমি এখনই সংহার… হি হা হা হা…” সাগরকাকা এবার আসল কথাটা পাড়ল।
সেদিকে কর্ণপাত না করে দারোগাবাবু আবার সাধুকে বলল, “রাখ তোর ফালতু কথা। আমরাও ওরম সিনেমা অনেক দেখেছি। তুই যদি সত্যিকারের কল্কী হোস, তবে তেমন কিছু প্রমাণ দে মিলিয়ে দেখি। তা হরিবাবু, আপনার পুরাণ কী বলছে? কল্কী দেখতে কেমন?”
হরিপদ জ্যেঠু সামনে খানিক এগিয়ে এসে বলল, “আমি তো চোখে দেখিনি কখনও, ছবিই দেখেছি। তাতে তো এর সঙ্গে কোনও মিল নেই। একে তো পাক্কা চোরের মতো দেখতে লাগছে। কল্কী আসবে লাল বসন পরে, কালো ঘোড়ায় চরে। এর ঘোড়াটা তো ধুঁকছে, কতদিন খেতে পায় না কে জানে!”
কথাগুলো শুনে সাধু বলে উঠল, “সে তো আমার বসনও রক্তাভ, দেখছেন না নাকি?”
“ধুর, তোর লাল আর ওদের লাল-এ তফাৎ আছে। যে না চোর, আবার আমাদের রঙ শেখাচ্ছে। লাল রঙ কোনটা আমরা জানি না নাকি?” পাশ থেকে আরেক পুলিশ বলে উঠল।
“তা বলি আমি কী আমার মাংসের দামটা পাব, নাকি সারাদিন দোকান বন্ধ করে তোমার ঢপবাজি শুনব বলো তো চাঁদু?” এতক্ষণে লাল্টু বলে উঠল।
“দাম! সে আবার কী? আমরা তো এসব কিছু শুনিনি কখনও। তা যদি মাংসের বিনিময়ে কিছু চাও তবে আশ্রমে চলো, কয়েকটা বেগুন তুলে দিচ্ছি মাঠ থেকে। ওই রাখো।” সাধু বলল।
“আরে কী বিপদ, এমন ছ্যাঁচড়া চোর তো দেখিনি! দাম বোঝেন না? মূল্য, টাকা— কিছুই বোঝেন না নাকি?” দারোগাবাবু বলে উঠল।
“কী করে বুঝব? এসব কী আর আমার বিষয়? আগেকার দিনে মানুষ কত ধার্মিক ছিল। আমার সব কাহিনি শুনে কী সুন্দর ভক্তি করত। এবার বুঝেছি কেন আমার আসা জরুরী ছিল এই যুগে। চারিদিন অনাসৃষ্টিতে ভরে গেছে। একবার ছাড়া পাই, তারপর এমন তপস্যা করব যে সব ছাড়খার হয়ে যাবে দেখিস।”
সাধুকে বেঁধে রাখার প্রতি সবচেয়ে বেশি উৎসাহ ছিল পাড়ার ক্লাবের জগাদার। সে এবার চেঁচিয়ে উঠল, “খবরদার ছাড়বেন না স্যার একে। ভাগ্যিস বেঁধে ফেলেছিলাম আমি। তখনই বুঝেছি মাথার ঠিক নেই। ছেড়ে দিলে যদি খ্যাপা ষাঁড়ের মতো বাজার লণ্ডভণ্ড করে তো আরেক কেলেঙ্কারি।”
এই শুনে সবাই বলে উঠল, “না না, কোনওমতেই ছাড়া যাবে না একে। আপনারাই একে নিয়ে গিয়ে গারদে ঢুকিয়ে দিন এইবেলা।”
দারোগাবাবু সবার কথা শুনে একটু ভেবেচিন্তে বলল, “ঠিক আছে, সবার যখন একই মত, তবে আমি একে আপাতত হাজতে নিয়ে যাচ্ছি। কাল সকালেই রাঁচি চালান করে দেব।”
এই বলে ল্যাম্পপোস্ট থেকে সেই স্বঘোষিত কল্কীদেবকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেল। সাধুজিও মাথা নাড়তে নাড়তে “ঘোর পাপ, ঘোর কলি…” বলতে বলতে তাদের সঙ্গে চলে গেল।
ভীড় একটু হালকা হতেই রঘুদাদু বলে উঠলেন, “কী আস্পদ্দা দেখেছ সতু? নিজেকে বলে কিনা কল্কীদেব। তিনি আসলে কী টের পাব না আমরা?”
তার কথা শুনে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “তা দাদু, আপনি তো পুরাণের গল্পটল্প অনেক জানেন টানেন। তা অবতারেরা কীভাবে আবির্ভূত হন?”
“কেন, বইয়ে পড়োনি? অবতাররেরা আসার আগে একটা ধুন্ধুমার সৃষ্টি হয়। এরম ভিখিরির মতো কোনও অবতার আসে নাকি? কল্কীদেব আসবেন কালো ঘোড়ায় চড়ে। তা নয়, নিয়ে এসেছে একটা খচ্চর। তাও যদি কিছু শোরগোল ফেলত। ভারী একখানা মুরগি চুরি করেছে নাকি কল্কীদেব! হুঃ, যত্তসব!”
“তা অবতারেদের জন্মের সময় থেকে কপালে লেখা থাকে নাকি সে অবতার? আস্তে আস্তে প্রমাণ হয়। কে বলতে পারে ইনিই ভবিষ্যতের অবতার নন? কীসব বিশ্বরূপ-টুপ দেখাতে পারে বলছিল তো।”
“ওই দেখো। অত পরে এসে তুমি সব জেনে গিয়েছ দেখছি। ওসবের আগে কী কী ঢপ দিয়েছে জানো? বলে কিনা সাতচল্লিশ বছর আগে নাকি তিনি একদিন অনন্তশয্যার থেকে উঠে ভাবলেন যে পৃথিবীতে অনেক অনাচার হচ্ছে। তাই লক্ষ্মীমাতার থেকে বিদায় নিয়ে পরের বছর এই ধরণীতে এসেছেন। ওই দিনই নাকি এনার জন্ম হয়েছে। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপরের সব ঘটনা নাকি আজও মুখস্থ। তা দু-একটা যে মিলিয়ে দিচ্ছিল না, তা নয়। আমার মনে হয় বিএ পাস। কোনও চাকরি টাকরি না পেয়ে চোর হয়েছে। জ্ঞানগম্যিও আছে দেখছি!”
“তা এমন মানুষকে আপনারা হাতের সামনে পেয়ে ছেড়ে দিলেন? অন্তত কিছু তত্ত্বকথাও তো শোনা যেত। নেতামন্ত্রীদের ভাষণ শুনে তো কানে পোকা পড়ে গেল। একটু নতুন আইটেম পেতাম আমরা।”
“দেখ সতু, অল্প বয়েসে বেশি বুঝো না। কোন সময় এরাই দেখবে পাকিস্তানের চর টর না বেরিয়ে পড়ে। তখন রিস্ক কে নেবে? বোম্বেতে কী হয়েছিল দেখোনি? পুলিশ নিয়ে গেছে, ঠিক করেছে। আমার মনে হয় ও পাগলই।”
এমন সময় লাল্টু দৌড়তে দৌড়তে এসে খবর দিল, “সতুদা, সতুদা। ওদিকে মারাত্মক ঘটনা। যে পুলিশগাড়ি করে ওই চোরটাকে নিয়ে যাচ্ছিল, কোত্থেকে ফাঁকা আকাশে নাকি তার উপর বাজ পড়েছে। কেউ মরেটরে যায়নি অবশ্য, তবে লোকটা হাওয়া। এখন তো আমারও কেমন কেমন লাগছে। এই শুকনো আবহাওয়ায় বাজ আসবে কোত্থেকে?”
“থাম তো লাল্টু, তোরা না ইয়ং ছেলে। আসুক দেখি এখানে। ডাকাতটাকে আমি একাই আটকাবো। ওরে, কে কোথায় আছিস, সব আয় দেখি। বুড়ো হয়েছি, তবে মরে গেছি নাকি? আসুক সে। বাইরের ডাকাত এলাকায় মোটে বরদাস্ত করব না। আয় সবাই…”
এই বলতে বলতে রঘুদাদু তার লাঠিতে ভর দিয়ে বাজারশুদ্ধ সবাইকে একত্রিত করতে লাগল। খানিকক্ষণের মধ্যেই দেখি দূর থেকে সেই সাধু হাতে লাঠির মতো কী একটা ঘোরাতে ঘোরাতে তার খচ্চরটার উপর চেপে আসছে। এদিকে দাদু তাকে দেখতে পেয়ে পেছনের সবাইকে তৈরি থাকতে বলে নিজের লাঠিটা উঁচিয়ে বলে চলেছে, “লাঠিখেলা দেখাচ্ছিস? আয় তবে। দেখি কার কত জোর। সবাই সাবধান, ও সামনে আসলেই আমি যেই এক, দুই, তিন বলব, অমনি ওকে ঘিরে ধরতে হবে। সবাই তৈরি তো?”
অমনি পেছন থেকে সবাই একযোগে বলে উঠল, “তৈরি।”
আমি আর কথা না বাড়িয়ে সেই দেখে গা বাঁচিয়ে বাড়িতে চলে এসেছি। আপাতত নন্দিতা আর আমি একটা কম্বলমুড়ি দিয়ে ঘরের ছিটকিনি আটকে বসে আছি। আগেই বলেছিলাম লোকটা কল্কীদেব না হয়েই যায় না। এখন দেখার যে বাঙালিরা কীভাবে তাকে প্রতিহত করে। স্বয়ং বিষ্ণুদেবকেও তার লীলা দেখাতে হলে বাঙালির সামনা করতে হবে সবার আগে।
অবশ্য এই যুদ্ধ সামনের থেকে দেখছি না বলে হতাশ নই। একটু আগেই ফেসবুক খুলে দেখলাম তাতে কে যেন লাইভও করছে এই লড়াই। ওই তো রঘুদাদু প্রবল বিক্রমে তার লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে বলছে, “আমায় লাঠিখেলা দেখাচ্ছিস? আয়, আয় তোর মুণ্ডুটা ভাঙি। সবাই অ্যাটাক।”
অমনি সেই মহাপ্রলয়ঙ্কর যুদ্ধের শুরু হল আজ।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।