• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রবন্ধে সম্বুদ্ধ সান্যাল (পর্ব – ৫)

সন্ত্রাস এবং সপ্তেন্দ্রিয়

ভ্যালেন্টাইন দিবোসোত্তর এক সুন্দর সকাল আজও। শীতমরশুমপ্রান্তে প্রেমপক্ষের ছোঁয়াচ তখনও বিলীন হয়নি কবিমনে। নন্দিতা বোধহয় গাত্রোত্থান করেছে কিছুক্ষণ আগে, সম্ভবত প্রাতঃকালীন চায়ের আয়োজন হেতু। জানলা দিয়ে সকালের নরম রোদ্দুর ভিজিয়ে দিচ্ছে ধবলশুভ্র বিছানা, অঙ্গস্পর্শও করছে খানিক। শীতের আমেজে সে ছোঁয়ায় কবিমনে যেন দোলা দিয়ে যাচ্ছে মৃদুমন্দ। সবেমাত্র ভাবছি এই প্রেমময় পরিবেশে নিশ্চয়ই আজ এমন কিছু পংক্তির উদয় হবে যা সমস্ত জীবনানন্দকে নস্যাৎ করে ফেলবে বাঙালিমনে, কিন্তু এখনও তারা আসতে শুরু করেনি, আসবে নিশ্চয়ই। কবিতাটি প্রকাশিত হলেই জনমনে কতটা আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে, সবেমাত্র তাই নিয়ে ভাআ শুরু করেছি কি পাশের জানলার কপাটে খানখান-চুরমারকারী একখানি আওয়াজ, ‘ঠকাস!!!’
চমকে উঠে বসলাম। যাবতীয় কবিসত্ত্বা উড়ে গিয়ে একখানি ত্রাস গ্রাস করে ফেললো সমস্ত মননকে। চিত্তোদ্বেলিত কণ্ঠ থেকে সশঙ্ক আওয়াজ কোনওমতে প্রসারিত হলো, “ন-ন্ধি-থা… কী সব হচ্ছে! ভূমিকম্প নাকি?”
তটস্থ নন্দিতাও ততক্ষণে রান্নাঘর থেকে বেডরুমের দরজায়, “এদিকেও মেরেছে? সামনের দিকে তো অনেকক্ষণ চলছে। বাইরে লোক জমেছে দেখোনি?”
“বাইরে লোক! কেন! কবে!”
“কবে আবার কি? এই তো… বেরিয়ে দেখো না। পাড়া-পড়শি থেকে শুরু করে গ্রামসভা-পঞ্চায়েত কেউ বাকি নেই। এতক্ষণ ধরে বেরোচ্ছ না দেখে বোধ হয় এই ঢিল মারা শুরু করলো।”
“ঢিল কেন? আবার কী বাধালে? চলো তো দেখি।”
“জানলা দিয়ে দেখো, বাইরে বেরিয়ো না। মারতেও পারে। ডেঞ্জারাস লোকজন সব।”
“মারবে কেন? …ও কি! কালো পতাকাও যে দেখাচ্ছে!”
“তুমি কবি না? তাই দেখাচ্ছে। কাগজে পড়ছো না কবি দেখলেই পাবলিকে মারছে?”
“আরে সে তো অজাত-কুজাতদের মারছে। আমি তো আমি তো নিরীহ প্রকৃতির। যাকে বলে একদম কবি।”
“তাতে কী? কবিতায় তো আগুন আছে। তেমনিই তো কালকে লিখলে দেখলাম।”
“কালকে? কোনটা?”
“ওই যে…
সন্ত্রাসী সন্ত্রাসী কোথা যাও নাচি নাচি
শুনে যাও কিছু মিঠে বুলি
কথা কম কাজ বেশি দাঁড়া আগে মেরে আসি
পেটো-বোমা-হাউই আর গুলি।
দিদিমণি দিদিমণি রাজ্যতে খুনোখুনি
বলো কিছু, মাইকটা ধরি
কথা আছে কাজ কম সংসদে হরদম
আগে সেথা বোমাবাজি করি
নমোভাই নমোভাই খুঁজি খুঁজি তুমি নাই
চলে গেলে কোথা বলো মোরে
কাজ নাই কথা নাই এইবেলা আমি তাই
কাশ্মীরে এসে গেছি ভোরে।
পাপুদাদা পাপুদাদা গামাপাধা গামাপাধা
দিনরাত এক সুর কেন?
কথা চাই কাজ চাই, নইলে যে সুখ নাই
কুঁড়েমীও বেড়ে চলে যেন।
– ওইটা। কাল লিখলে না? কি অসাধারণ কবিতা। কবি যেন সন্ত্রাসবাদীকে কবিতার মাধ্যমে থামাতে চাইছে। কিন্তু সন্ত্রাসী ছোঁড়া না শোনে ধর্মের কাহিনি।”
“সে কি? ওটার কথা ওরা জানলো কীভাবে? আমি তো এমনি এমনি ডায়রিতেই লিখেছিলাম।”
“আমি না থাকলে তো কবিতাগুলো ওই ডায়রীর পাতাতেই থাকতো আর হাওয়া দিলে ফরফর করে উড়তো। আমিই কাল শোওয়ার আগে ফেসবুকে দিয়েছিলাম।”
“কেলেঙ্কারি করেছে। এই সময়ে কেউ এসব পোস্টায় নাকি? দেখছো না কী অবস্থা চলছে চারিদিকে?”
“এটাই তো সময় তোমার কবিসত্ত্বা প্রকাশের। এই সময়ে দেশের জন্য জাগবে না তো আর কবে জাগবে? এই সময়ে জনমনে কিছু একটা লাগলেই তুক… তুমি বীর সাভারকর।”
“আর না লাগলে যে ঢিল তাক করা জনগণকে সাফার করতে হয়, তার নমুনা তো দেখতেই পাচ্ছি চতুর্দিকে।”
“তা আমি কী করে জানবো যে তোমার এই আগুনে কবিতা জনগণে অন্যরকম ভাববে?”
তা আমি এইসব কাণ্ডের বিলকুল সমর্থক নই। কবিতা লিখে ডায়রী চাপা দিয়ে রাখাই বেশি পছন্দের। কে বলতে পারে, এইসব কবিতাই একদিন আলোড়ন সৃষ্টি করবে না? মরার আগে না হয় জীবনান্দের মতো ওগুলো ট্রাঙ্কচাপা রেখে যাবো। উনি ফল পেয়েছেন, আর আমি পাবো না? এমনিতেই সন্ত্রাস শব্দটা শুনলে দেহের আগাপাশতলা কাঁপে, তার সঙ্গে ‘বাদী’ যোগ হলে তো মুচ্ছো যাই গড়পরতা সাধারণ এক বাঙালি নাগরিকের মতো।
অবশ্য সন্ত্রাসবাদীরাও ব্যতীক্রম নয় এই বিষয়ে। আমাদের সঙ্গে ওদের পার্থক্য শুধু ওই নলধারী যন্ত্রটার, ওদের আছে, আমাদের নাই। যেমন সাপ মানুষকে ভয় পায়, মানুষও সাপকে। কিন্তু সাপের বিষ আছে, তাই ছোবলায়। মানুষের নাই, তাই হসপিটাল যায়। তবে ওরাও যে ভয় পায় তা শুনেছিলাম এক রাঁধুনির কাছ থেকে, যে কিনা কার্গিল যুদ্ধের সময় টাইগার হিল পাহাড়ে জঙ্গীদের দ্বারা বাবুর্চি হিসেবে নিযুক্ত ছিল, কিন্তু আদতে বাঙালি। সেই সময়ে সেখানকার জঙ্গীদের প্রধান খলবলী দার আলা পাহাড় দখল করার আগে এক দীর্ঘ ভাষণের মাধ্যমে জঙ্গিদের উৎসাহিত করে একখানি লাল জ্যাকেট চাপিয়ে চললো সবার আগে। ভারতীয় সেনাদের সাথে ধুন্ধুমার যুদ্ধ করে দখল করলো টাইগার হিল। যুদ্ধ জয়ের পর সবাই তাকে জিজ্ঞেস করলো, “আমরা জিতে গেছি শোভানআল্লাহ। কিন্তু হুজুর-এ-জন্নত আপনি লাল জ্যাকেট পড়ে কেন এগিয়ে গেলেন তা জানতে আমরা ভীষণ আগ্রহী।”
দার আলা উত্তর দিলেন, “ফেরেস্তা-এ-জাহান সঙ্গীরা, আমি চেয়েছিলাম ভারতীয় সেনার গুলি আমায় কুরবান করলেও যেন সেই খুন-এ-সিন্ধের রং তোমাদের চলার পথে যেন বাধার সৃষ্টি না করে। আমরা এই কয়েকজনেই আজ হিন্দুস্থানের মাথায় আঘাত করেছি, কাল দিল্লি লুঠবো ইনশাআল্লা।”
সবাই সমস্বরে জয়ধ্বনি দিয়েছিলো ঠিকই সেই আবেগে, কিন্তু বাধ সাধলো কিছুদিন পর যখন জঙ্গী তরফের এক নজরদার হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দিলো, “অ্যায় মালিক-এ-কাশ্মীর, ভারতীয় সেনার বিমানবাহিনী আমাদের দিকে আক্রমণ করতে আসছে এবার।”
দার আলা সঙ্গে সঙ্গে নিজের পেছনে হাত বাগিয়ে তলব করলেন, “তবে শীগ্‌গির আমার হলুদ পায়জামাটা নিয়ে এসো।”
গল্পটি আমায় যে বন্ধুটি শুনিয়েছিলো, সে একসময় বাংলা থেকে আফগানিস্তানে গিয়েছিলো আমেরিকান সৈন্যদের বাবুর্চি হিসেবে যোগ দিতে। এক সময় তালিবানেরা তাদের ঘাঁটি আক্রমণ করলে সম্পূর্ণ বাহিনী কোতল হলেও প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলো সে। ধরা পড়লে কয়েকদিনের মধ্যে সে হয়ে বসে তালিবানদের প্রধান বাবুর্চি। এরপর পদোন্নতির মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ হয় আই.এস.আইয়ের সঙ্গে। সেই মাধ্যমেই সে ফিরে আসে নিজের দেশ ভারতে। এর মধ্যেই তার মতো আরও কিছু বাঙালি যারা সেই সময় কার্যসূত্রে আফগানিস্তানে গিয়ে আটকা পড়েছিলো তালিবান আর আমেরিকানদের মাঝে, তাদের নিয়ে তৈরি করেন নিজস্ব রান্নার দল। সেই সময়ে পাকিস্তানে থাকার দরুণ তাদের খরিদ্দারের সিংহভাগই ছিলো জঙ্গীসম্প্রদায়ভুক্ত। তাদের অভুক্ত না রাখার বাসনাতেই আমার বন্ধুটির মাথায় খেলে যায় দেশীয় ভাইদের আবার স্বদেশে ফিরিয়ে আনার এক দুর্ধর্ষ পরিকল্পনা। এই ভাবেই তারা এসে উপস্থিত হয় ভারতীয় মূল ভূ-খণ্ডে। এরপর সেনা অভিযানে কার্গিল পুনর্দখল হলে সেখান থেকে উদ্ধার হয় তার মতো জনাবিশেক বাবুর্চি। এরপর তাদের স্বগৃহে সসম্মানে পৌঁছে দেওয়া হয়। তার এই কার্যক্রমের মহান আখ্যান ঢাকা পড়ে গিয়েছে অক্ষয় কুমারের এয়ারলিফ্‌ট সিনেমার ছায়ায়। এই সাফল্যের কারণ জিজ্ঞেস করায় একদিন জানিয়েছিল সে খাঁটি সরষের তেল বাদে অন্য কিছু ব্যবহার করে না কখনই। তার ইতিবৃত্তান্ত শোনা ইস্তক আমারও মনে ধারণা জন্মেছে নেহাৎ সরষের তেল ছিলো, তাই জাতটা প্রাণে বেঁচে গেলো।
নিন্দা আমাদের গণতন্ত্রের ভিত্তি তা যুগে যুগে বার বার সংসদীয়ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। সে সাতানব্বুইয়ের কার্গিল হোক বা সতেরোর উরি। যতবারই সন্ত্রাস দেশের কোনও কোনায় হানা দেয় তখনই দেশের সাধারণ মাথাগুলি একত্রিত হয়ে চুলচেরা হিসেবে বসে ইজরায়েল যেমন প্যালেস্তাইনের হামলা প্রতিরোধ করে একটা গণতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্বেও, আমরা কেন পারি না তার বিশ্লেষণ করতে। এই রকম চুলচেরা হিসেব করে সেদিন কানাইয়ের চায়ের দোকানে গিয়ে বসতে পাড়ার অসীমকাকু নানারকম আলোচনার মধ্যে তুলে ধরলেন গাফিলতিটি। নিন্দা-সমালোচনা নাকি ইজরায়েলেও হয়। একবার প্যালেস্তাইনের উপর এক হামলার পর বিরোধীদের প্রশ্নবাণ সামলাচ্ছিলেন এক রাজনীতিক। তাদের নেসেট-এর স্পীকারের সামনে যখন হামলার পরিসংখ্যান দিচ্ছিলেন তখন জানালেন যে তাদের হামলায় সতেরোজন প্যালেস্তাইনী জঙ্গি ও একটি গাধা মারা গেছে। বিরোধীরা সমস্বরে প্রতিবাদ জানালো এই ভাবে একটি নিরীহ গাধাকে মারা হলো কেন? মন্ত্রীমশাই তখনই লাফিয়ে উঠে চেপে ধরলো বিরোধীদের, “দেখেছেন স্পীকারমশাই, আমরা আগেও বলেছিলাম এরা নিজেরটুকু বাদে আর কিছুই ভাবে না। একটা গাধাই ওদের কাছে বড় হলো।”
আমাদের দেশে এমন পোড় খাওয়া গণতন্ত্র আসতে এখনও কুড়ি বছর দেরী আছে, তবে দেশ অগ্রসর হচ্ছে প্রবল বেগে।
রাজনীতিতে আমার মন নেই বলে নন্দিতার অভিযোগ অনেক। তার মনে এখনও ধারণা আছে দেশের জন্য কিছু ভাবতে গেলে একজন মানুষের অবশ্যই রাজনীতি করা উচিত। সন্ধ্যেবেলার মাথা খাওয়া বাংলা সিরিয়ালগুলোই এমন ধারণা পোষণ করার জন্য মূলত দায়ী। তার মত সিরিয়ালে দেখানো পারিবারিক রাজনীতিগুলোই একটা সংসারকে ঠিকঠাক দাঁড় করিয়ে রাখে। যেমন জনপ্রিয় অভাগীর চাঁদ সিরিয়ালে বাড়ির ছোট বৌ ভাবছে বড় ভাইয়ের পরিবার যেন নির্বংশই থাকে যাতে তার আদরের দুখু একসময় বাড়ির ভার হাতে নিয়ে সংসারকে সমৃদ্ধ করবে। অপরদিকে বড় দম্পতি প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বংশধর আনার যাতে সংসারের গুরুদায়িত্ব যেন রসাতলে না যায়। এই নিয়ে যতরকম কেচ্ছা কেলেঙ্কারী চললেও উভয়পক্ষই ভাবছে সংসারের ভালোর জন্যই। এই সিরিয়ালেই এক পর্বে দেখলাম ছোটবউয়ের এক মাসতুতো বোনের ফোন গভীর রাতে। প্রসঙ্গক্রমে মাসতুতো বোনটির সঙ্গে তার স্বামীর একেবারেই বনিবনা হয় না ও তিনি বড়ই ভালোমানুষ গোছের যিনি কিনা ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান করেন। রাত্রের সেই ফোনের এপাড়ে প্রবল ঘুমের থেকে উঠলো ছোটবৌ, “হ্যালো।”
“দিদি, আর বলিস না, আজও ওর সাথে ঝগড়া করে ফেলেছি।” ওপাড় থেকে কণ্ঠ এলো।
“ঠিক আছে বোন, এই ব্যাপারে আমরা কাল সকালে কথা বলি।”
“না দিদি, আজ একটু বেশি ঝগড়া করে ফেলেছি।”
“ঠিক আছে, আজ অন্য ঘরে গিয়ে শো। কাল সকালেই আমি দেখছি।”
“দিদি, প্রতিদিনের ঝগড়া আর ভালো লাগে না। বড় চিন্তায় আছি।”
“চিন্তা করিস না বোন। কাল সকালেই সব ঠিক হয়ে যাবে আবার।”
“কাল নয়, আজই সব ঠিক করতে হবে। শুধু এটুকু বলে দে লাশটাকে কীভাবে ঠিকানা লাগাই?”
নন্দিতার এই ভাবজগতের সঙ্গে আমার মতান্তর থাকলেও আমি কখনই প্রতিবাদ করি না। কারণ ফ্রয়েডের মতে প্রত্যেক নারীমনের অবচেতনে একজন জঙ্গী বাস করে। কে বলতে পারে সামান্য স্ফূলিঙ্গে তার বিস্ফোরণ ঘটবে না?
আফগানিস্তানে থাকা আমার সেই বন্ধু যখন নিজের গ্রামে ফেরৎ আসে, তখন গণতান্ত্রিকভাবে সেখানকার চায়ের দোকানেও কিছু নিন্দা-সমালোচনা হয়েছিলো বটে। বিশেষত উঠতি বয়েসী লাল্টু ছিলো এমন নিরীহভাবে ফিরে আসার প্রবল বিরোধী। তার দাবী ছিলো অন্তত দুই-তিনটে জঙ্গী খতম করে বন্ধুটি ফিরতে পারতো, তাতে গ্রামের মান-মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকতো। একদিন রাতে সেখানে বিস্তর তর্কের পর আগামীদিন সকাল থেকে লাল্টুর আর খোঁজ পাওয়া গেলো না। ফিরলো সে বছর তিনেক বাদে। নানা প্রশ্নের পর জানা গেলো সেও নাকি গিয়েছিলো আফগানিস্তানে। সে নিরুদ্দেশ হওয়ার আগের সন্ধ্যার বিতর্কটি তখনও মনে ছিলো গ্রামবাসীদের, সবাই মিলে লাল্টুকে জিজ্ঞেস করলো, “তা লেকচার মেরে যে আফগানিস্তান গেলি, জঙ্গি মারলি কয়খানা?”
“মেরেছি তাও উনিশ-কুড়িখান।” লাল্টু উত্তর দিলো।
সবাই অবাক। অমন হাড়কপাটি বের হওয়া লাল্টু নাকি বিশখানা জঙ্গি মেরেছে। কিছু বকাটে মানুষ জিজ্ঞেস করলেন, “তা মারলি কি দিয়ে, গুলতি?”
“না, মুরগি দিয়ে।” লাল্টুর সংক্ষিপ্ত উত্তর।
সবাই যারপনাই অবাক আবার। বকাটে লোকেরা আবার বললো, “তা ওখানকার মুরগীদের মুখ থেকেও কি একে ফট্টিসেভেনের মতো গুলি বেরোয় নাকি? কী সাঙ্ঘাতিক জঙ্গি মুরগী! আমাদের সেনা দপ্তরে তো এইরকম মুরগীর বরাত দিতে পারে। একেবারে রাজস্থান থেকে ছাড়বে আর পাকিস্তান খালাস।”
“দুত্তোরী, মুরগীতে গুলি ছুঁড়তে যাবে কেন?”
“তুই-ই তো বললি মুরগী দিয়ে জঙ্গি মেরেছিস!”
“উফফ, আগে ঘটনা শোন। ওখানে তখন খুব যুদ্ধ হচ্ছে। আমিও তখন অনেক পাঁয়তারা করে এক জঙ্গি দলে ঢুকলাম রাঁধুনির কাজে। সে সময়ে যুদ্ধের জন্য মুরগীর আকাল। তাও আমাদের ভাঁড়ারে ছিল অফুরন্ত যোগান। মাঝে মাঝে আমি মুরগি নিয়ে গিয়ে অন্য জঙ্গি ঘাঁটির সামনে ছেড়ে দিতাম। যেই কেউ ওটা দেখতে পেয়ে ধরতে আসলো, অমনি আমি সামনে গিয়ে বললাম, ওটা আমার মুরগী। সেও ছাড়বে না, আমিও না। তারপর দুজনকেই ধরে নিয়ে গেল বিচারের জন্য। ওদের তো আদালত নেই, তাই ময়দানেই নিজেদের মধ্যে ফয়সালা হয় তিন চড়ের মাধ্যমে। একে অপরকে তিনটে চড় মারার পরেও যার ব্যথা কম হবে, সেই মুরগি পাবে এমন নিদান দিলো সবাই। কে প্রথমে মারবে তার জন্য টস হতো। যেদিন টসে আমি জিততাম সেদিন দিতাম কষিয়ে দুই গালে তিনটে চড়।”
“তারপর? যখন তোকে মারতো? তোর এই দুবলা শরীর, আর ওদের তো পাঠানি বাঘের থাবা।”
“হুঃ! আমিও বাঙালির বাচ্চা। ও মারার আগেই বলে দিতাম আমি হেরে গেছি, মুরগি ওর। সেও মুরগি পেয়ে খুশি, আমিও জঙ্গি মেরে খুশি।”
“আর যেদিন টসে হারতি?”
“সেদিন তো প্রথমেই মুরগি দিয়ে দিতাম, অসুবিধা কী?”
লাল্টুর এই হ্যানো সাফল্যে বড়ই বিমর্ষ হয়ে পড়ে আমার বন্ধুটি। একদিন সেও সংসার-ধর্ম সমস্ত ত্যাগপূর্ব্বক একখানি চিঠি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হলো। আমরা ভাবলা সে বোধ হয় বিবাগী-সন্ন্যাসী হলো। এই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর একদিন অচেনা নবর থেকে ফোন এলো আমার কাছে। রিসিভ করতেই বন্ধুটির পরিচিত কণ্ঠস্বর। তাকে জিজ্ঞেস করলাম এখন কোথায়? কী করছে?
অপর প্রান্ত থেকে উত্তর দিলো, এখন সে এল.ও.সি-র পাশেই পাঞ্জাবী ও চাইনিজ ধাবা খুলেছে। রমরমিয়ে ব্যবসা। পিক ডেলিভারী, ট্রেঞ্চ ডেলিভারী, বর্ডার ডেলিভারী, হিডেন ডেলিভারী, সাডেন ডেলিভারী, গেরিলা ডেলিভারী—সমস্ত ব্যবস্থা আছে। নানা প্রদেশের জন্য নানারকম খাবারের একখানি ফুড-চার্টও আমাকে পাঠাবে বলেছে। তাতে নাকি চাইনীজ, আফগানী, মোগলাই, পাঞ্জাবী, কাশ্মিরী—এমনকি অর্ডার পেলে রাশিয়ান, ইংরেজ বা আমেরিকান মেনুও বাদ দেয় না। দিনে দিনে খুব নাম করেছে তার সংস্থা। প্রবল যুদ্ধে গোলাগুলির মধ্যে পাথরের আড়ালে কিম্বা দখল করে রাখা পাহাড়ের চূড়াতে খাবার পৌঁছে দিতেও তারা সক্ষম।
গোয়েন্দা রিপোর্টে কিছুদিন আগেই উঠে এসেছিলো পশ্চিমের হিজবুল বা পূর্বের জামাতের মধ্যে অস্ত্রসামগ্রীর তারতম্য তেমন নেই। উভয়েই সমপর্যায়ের অস্ত্র ব্যবহার করে। তা ছাড়াও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপেও দুই পক্ষই এই মুহূর্তে প্রায় সমানে সমানে। তবু সম্মানের দিক থেকে হিজবুলের তুলনায় জামাত এখনও বেশ খানিকটা পিছিয়ে আছে। যেমন দেশের পশ্চিম দিকে হিজবুলি বিস্ফোরণ ঘটলেই সারা দেশ জুড়ে আওয়াজ ওঠে ‘রাষ্ট্রিয় সন্ত্রাস’-এর নামে। কিন্তু পূর্ব্দিকে আমাদের সোনার বাংলায় যে কোনও জামাতি ঘটনায় তাকে বিশেষ আমল দেওয়া হয় না বলে মতানৈক্য আছে। যেমন কিছু সময় আগেই জেলার এক ঘটনায় জামাতি যোগ দেখেই তাকে বলে দেওয়া হয়েছিলো, ‘ও কিছু না, শব্দদূষণ। বুড়িমার নিষিদ্ধ চকলেট বোম ফেটেছে’। এই শুনে ভীষণ রেগে গিয়ে জামাত তরফে ‘বিষয় : আমরা খেলবো না’ শীর্ষক চিঠি পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে দেওয়া হলে তাতে বিশেষ আমল না পেয়ে তারা এখন কেন্দ্রিয় মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করছে কিন্তু এই ঘটনা রাজনৈতিক তরফে এখনও প্রকাশ্যে আসেনি।
বাড়িতে সকাল থেকেই নানা রকম হট্টগোলের পর দুপুর বেলায় ভীড় একটু থিতু হলে নন্দিতা একখানি ব্যাগ গুছিয়ে আমাকে বললো সে বাপের বাড়ি যাচ্ছে, মায়ের জন্য মন কেমন করছে। আমি যদিও তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম খানিক যে এমন সংবেদনশীল মুহূর্তে আমাকে ছেড়ে যাওয়াটা কী ঠিক হচ্ছে?
সে উত্তর দিলো, সমস্ত পুরুষের দায়িত্ব হলো নারীদের সুরক্ষা দেওয়া, এই নিয়ে আমিই বক্তব্য রেখেছিলাম কখনও। আসলে এই নারীসংবেদনশীল ব্যাপারটা বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে ভীষণরকম খাপ খায়। আরও নানা মুনির মতো আমিও সেই প্রসঙ্গেই বক্তব্য রেখেছিলাম কখনও। কিন্তু আজ সেই বক্তব্যই যেম আছড়ে পড়লো আমার উপর। যখন কিছু বাদানুবাদের পর নন্দিতার থেকে শুনতে পেলাম কবিতা লেখার ফলে এই সমস্যা সৃষ্টি হওয়া আমার দায়, এবং তা মেটাতে হবে আমাকেই। জনগণ যদি আরও কিছু করে বসে তাই সর্বাগ্রে তার সুরক্ষার জন্য আমার কর্তব্য বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া।
আমি বললাম, “তাহলে আমাকেও নিয়ে চলো। আমাকে ফেলে যাচ্ছ কেন?”
“সংসারের কর্তা হিসেবে বাড়ির প্রতি তোমার কোনও দায়িত্ব নেই? তুমি কি জানো যে যংসার হলো একটা ভাসমান জাহাজের মতো, আর কর্তা হলো তার ক্যাপ্টেন। আর নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব যাত্রীদের সম্পূর্ণ সুরক্ষার পরেও জাহাজের সঙ্গ না ছাড়া। জাহাজের জন্য প্রাণপাত করা ক্যাপ্টেনের সম্মান।”
“কিন্তু ওরা যে ধরতে পারলে খুব মারবে!”
“সেটা তোমার সমস্যা।”
ঠিক এই সময়ে আমি আমাদের দেশের কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের সমীকরণ সম্পূর্ণ বুঝতে পারছি, রাজনীতি বুঝতে পারছি, সমানাধিকার বুঝতে পারছি। এমন কাব্যিক গণতন্ত্র কি দুনিয়ার আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে?

ক্রমশ …

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।