(আগে যা ঘটেছেঃ লকডাউনে পরিমলবাবু সপরিবারে গৃহবন্দী)
পরিমলঃ (টেলিফোনে) হ্যাঁ, সবাই ভালো আছি। না না একেবারেই বেরোচ্ছি না কোথাও! আচ্ছা, ঠিক আছে। নিশ্চয়ই। আচ্ছা তাহলে আজ রাখি?
পরমাঃ কী ব্যপার বলো তো? সকাল থেকে ফোনই করে যাচ্ছ?
পরিমলঃ আসলে এখন তো সবাই বাড়িতেই থাকছে, তাই খোঁজ খবর নিচ্ছি আর কি।
পরমাঃ তা বাড়িতে থাকলেই বা, সবাই কি তোমার মতো শুয়ে বসে দিন কাটাচ্ছে? অনলাইনে কতো কাজকম্ম চলছে।
পরিমলঃ হ্যাঁ হ্যাঁ, সে জানা আছে কতো কাজকম্ম! সেদিন দেখলাম প্রসূন ওপরে কোট আর টাই পরে ভিডিও কল করছে, এদিকে নীচে বার্মুডা প্যান্ট পরা!
প্রসূনঃ বাবা, ওটাই তো ভিডিও কল-এর সুবিধা! পুরোটা দেখা যায় না!
প্রিয়মঃ বাবা, আমিও একদিন তোমার মতো টাওয়েল পরে ক্লাস করব!
জুঁইঃ না বাবু, এই ব্যপারে তোমার বাবার মতো না হলেও চলবে।
প্রীতিঃ বৌদি, প্রিয়মেরও অনলাইন ক্লাস হচ্ছে না কি!
জুঁইঃ না এখনো শুরু হয়নি, তবে শুনছি সেটাই হবে।
পরিমলঃ সেদিনই বলছিলাম, এই যন্ত্রগুলো আমাদের কতো দূরে সরিয়ে দিয়েছে…
পরমাঃ কিন্তু ভাইরাসের ভয়ে সবাই আবার কাছাকাছি এসে গেছি! কত্তদিন পরে গোটা পরিবার একসঙ্গে আছি বলো তো?
প্রসূনঃ মা, কিন্তু দেশের অর্থনীতির খুবই বাজে অবস্থা। চাকরি বাকরি থাকলে হয় আমাদের!
পরমাঃ তুই থাম তো! অর্থনীতি শেখাচ্ছে। ঘরের খেয়ে অফিসের মোষ তাড়িয়ে বেড়ালি সারা জীবন…
পরিমলঃ আমার বাবা সবসময় একটা কথা বলতেন। আমাদের সকলেরই সবকিছু কাজের একটা কোটা থাকে। সবকিছু মেপে মেপে নির্দিষ্ট করা। সেটা শেষ হয়ে গেলে আর শত চেষ্টা করেও করা যায় না, বা প্রয়োজন হয় না। নিজের উদাহরণ দিয়ে বলতেন, জীবনে প্রচুর মিষ্টি খেয়েছি তাই মিষ্টি খাওয়ার কোটা শেষ, ডাক্তার বারণ করে দিল। বাবার কথা তখন বুঝতে পারিনি, আজ পারছি। এই যে প্রসূনের মতো কত্তজন শুধু ছুটেই যাচ্ছিল এতদিন, নিজের শখ, স্বাস্থ্য, পরিবার, কোনো কিছুরই খেয়াল না করে, হয়তো তাদেরও ছোটার কোটা শেষ! এবার বিশ্রামের সময় এসেছে, একটু থিতু হয়ে বসে ভাববার সময় এসেছে, যে এতদিন কিসের জন্য আমরা ছুটছিলাম!!
প্রীতি- বাবা, তোমার ফিলোসফিটা বড্ড ওল্ড স্কুল। তবে হ্যাঁ, লকডাউন চলাকালীন আমাদের পরিবেশের ডেফিনিটলি উন্নতি হবে, আর অলরেডি হচ্ছেও। রাস্তায় গাড়ি চলছেনা তাই পল্যুশন কমে গেছে অনেক।
জুঁই- আমাদের ছোট্ট বাগানটায় কী সুন্দর প্রজাপতি উড়ছিল কাল!
প্রিয়ম- কোথায় মা, প্রজাপতি?
জুঁই- আমি তো সঙ্গে নিয়ে ঘুরছি না, বাগানে গিয়ে দেখে এসো!
প্রীতি- কেন বৌদি ওকে ডিস্কারেজ করছ! আয় প্রিয়ম আমরা প্রজাপতি আর স্কুইরল দেখতে যাই।
প্রিয়ম- ইয়েয়েয়েয়েয়ে!! স্কুইরল দেখব!!
পরমা- আচ্ছা, সে দেখো, তবে সবাইকে বলে রাখি। দোকান বাজার হচ্ছে না নিয়মিত, তাই কিছুদিন এটা খাব ওটা খাব বলে কেউ বায়না করবে না! যা দেওয়া হবে, সকলে তাই খাবে, কেমন?
পরিমল- বেশ, কিন্তু কথাগুলো আমার দিকে তাকিয়ে বলছ কেন?
পরমা- কারণ তুমিই সবথেকে বেশী ঝামেলা কর।
পরিমল- বোঝো!
প্রীতি- মুস্কিলটা হলো, এখন স্যুইগি জোম্যাটো অর্দার দেওয়াও ঠিক হবে না।
প্রসূন- সমস্যা এতাই। নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে আমরা অনেক সার্ভিস বন্ধ করে দিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু তারা কী করে সংসার চালাবে বল তো! বাজারে গেলাম না, চুল কাটালাম না, অটো চড়লাম না, সব ঠিক আছে, কিন্তু ঐ সব্জীওয়ালা, নাপিত, অটোচালক, ওদের চলবে কী করে!
প্রীতি- দাদা, আমার মনে হয়, আমাদের উচিৎ নিজেরা যতোতা পারি ওদের হেল্প করা। হয় টাকা দিয়ে নয়তো কিছু চাল ডাল দিয়ে।
প্রসূন- হ্যাঁ, আমি আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের বাকিদের সঙ্গে কথা বলেছি। একটা ফাণ্ড বানাচ্ছি আমরা। কিছু মানুষকে প্রতিদিনের খাওয়ার জন্য সাহায্য করা হবে।
পরিমল- খুব ভালো করেছিস রে! আমিও কিছু দেব ফাণ্ডে।
পরমা- আমিও দেব।
পরিমল- বাঃ, আমার পকেট মেরে মেরে তুমি তাহলে ভালোই জমিয়েছ!
পরমা- বাজে কথা বোলোনা তো! ঐ তো পকেটের ছিরি, ফুটো পয়সা আছে কি না কে জানে… আমার বয়েই গেছে তোমার পকেট মারতে। এটা আমার নিজের টাকা।
প্রীতি- আচ্ছা শান্তি শান্তি!
প্রসূন- এটাও কিন্তু লকডাউন এফেক্ট। মানুষ তাড়াতাড়ি বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। জুঁই খুব রেগে যাচ্ছে, মা-ও। আসলে চাপা টেনশন থেকেই…
পরিমল- আনন্দম! আনন্দম! আমরা বরং আমাদের সুবিধাগুলো দেখি। সকলে সুস্থ আছি, একসঙ্গে আছি।
প্রসুন- ভাবছি সেই ছোটবেলার মতো কিছু গান বাজনার অনুষ্ঠান করব সবাই মিলে। ভিডিও করা হবে।
প্রীতি- ফ্যান্টাস্টিক আইডিয়া! হ্যাঁ, আমার বন্ধুরাও করছে এ রকম।
জুঁই- আমি গান করব।
প্রসুন- সেকি! তুমি গান গাও নাকি!!
প্রীতি- দেখেছ! বৌদি গান গায় সেটা দাদাও জানতো না!
জুঁই- কী করে জানবে! আমার সঙ্গে কথা বলবার সময় পেত কখন!
পরিমল- তাহলে দেখো আরও একটা সুবিধা পাওয়া গেল লকডাউনের!
প্রীতি- আমিও গান গাইব। বাবা, মা, তোমরা বরং একটা শ্রুতিনাটক কোরো। দাদা মাউথ অরগান বাজাবি তো?
প্রসূন- অনেকদিন বাজাইনা, দেখি ভুলে গেছি কি না!
জুঁই- তুমি আবার মাউথ অর্গান বাজাতে নাকি!
প্রসুন- হ্যাঁ গো, কিন্তু কী আর করা! কথা বলবারই সময় পেতাম না তোমার সঙ্গে, তো মাউথ অর্গান আর শোনাতাম কী করে!
পরমা- আর আমাদের প্রিয়ম সোনা কিছু করবে না?
পরিমল- নিশ্চয়ই করবে! বলোতো দাদু, তুমি কী করতে চাও?
প্রিয়ম- আমি স্কুইরল নিয়ে ওই কবিতাটা রিসাইট করব।
প্রসূন- স্কুইরল নিয়ে আবার কোন কবিতা!
প্রিয়ম- বাবা তুমি ভুলে গেলে? আমি যে স্কুলে রিসাইট করলাম লাস্ট ইয়ার!
জুঁই- আরে, ওই কাজী নজরুল ইসলামের কাঠবিড়ালি কবিতাটার কথা বলছে।
পরিমল- ওহো!! হাঃ হাঃ হাঃ, তা বেশ, খুব ভালো।
প্রীতি- তাহলে বৌদি, আমরা রিহার্সাল শুরু করি? বাবা-মা, তোমরাও শুরু করে দাও। একটা গ্র্যাণ্ড প্রোগ্রাম করতে হবে কিন্তু! ইউটিউবে দেব!
পরমা- সর্বনাশ, আবার ওই টিউব-ফিউব কেন!
প্রসূন- না, প্রীতি ঠিকই বলেছে। চল আমরা এই লকডাউনে নিজেদের একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলি। নাম দিই “পরিমলবাবুর পরিবারকথা!”
সকলে- হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক!!! (সমাপ্ত)