সাপ্তাহিক মুড়িমুড়কি -তে সুদীপ ভট্টাচার্য (পর্ব – ২৩)

বল্টুদার ট্রাভেল এজেন্সি – ২৩

একের পর এক ঘটনার ঘনঘটায় রহস্য ক্রমশ জটিল হচ্ছে। একটা ব্যপার পরিস্কার যে খুব সহজ নয় এই জুতো চুরির হিসেবটা। যাই হোক, রিয়া আর অনিন্দ জুতো কিনে হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রতটে পৌঁছে গেছে। এদিকে বল্টুদা, বৌদি, নদী, গুহ দা আরো দলের সবাই তখন সমুদ্রের পাড়ে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। সমুদ্রের পাড়ে বসে আড্ডা দেওয়ার জন্য ভাড়ায় চেয়ার পাওয়া যায়, সেগুলো কিছুক্ষনের জন্যে ভাড়া নিয়ে চলছে আড্ডা। ওদের পুরো বেড়ানোটাই কেমন অদ্ভুত একটা রোমাঞ্চে ভরা। কিন্তু তার মধ্যেও ভালো লাগছে সবার। নিজেদের মধ্যে কেমন একটা আত্মীয়তাও তৈরী হয়ে গেছে। সমুদ্রের পাশে আড্ডা দিতে দিতে গ্রুপ করে কেউ চা খাওয়াচ্ছেন, কেউ বা আবার ঝালমুড়ি। বল্টুদাকে কিছুতেই কেউ দাম দিতে দিচ্ছেন না। বল্টুদার ব্যবস্থাপনায় ওরা খুব খুশী। যেমন সুন্দর থাকবার জায়গা, তেমন খাবারের আয়োজন। আহা,,শুধু এমন সুস্বাদু খাবারের জন্য এমনি এমনি এতদূর চলে আসা যায়। আজ পুরীতে ওদের দ্বিতীয় সন্ধে। কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যে এত ঘটনা ঘটে গেছে, যে দিনরাতের হিসেবেও গন্ডোগোল করে ফেলছে ওরা। এমন সব ভাবতে ভাবতে গানের লড়াই শুরু হলো। সবাই কি সুন্দর গায়। বিয়ের পর থেকে বল্টুদা গলা ছেড়ে গান করেননি কখনো। পাছে পাড়ার লোক ভাবেন ঝগড়া লেগেছে বাড়িতে। কিন্তু আজ গাইলেন। গলা ছেড়ে।
আস্তে আস্তে অন্ধকার নামছে চারপাশে। আড্ডা তখনও চলছে। সমুদ্রের পাড়ে বসে আলোমাখা রাত খুব রোম্যান্টিক হয়। একের পর এক ঢেউ এসে আছড়ে পরছে সমুদ্র পাড়ে। সমুদ্রের দিকে একটানা তাকিয়ে থাকলে ঘুম আসে চোখে। হাওয়া দিচ্ছে খুব। দারুন একটা ভালোলাগা শরীর জুড়ে। ঘুম আসছেও। আর ততবারই ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে আড্ডার আওয়াজ। কেউ মজা করছে, কেউ গান। বাসের ড্রাইভার কানাই একপাশে চুপটি করে বসে ছিলো। কোনো দরকারী ফোন এসেছে বোধহয়। কথা বলতে একটু দূরে সরে গেলো। অনেকক্ষন কথা বলে যাচ্ছে ও। কোনো কিছুই কারো।চোখ এড়াচ্ছে না। সবাই সবাইকে পর্যবেক্ষনে রাখছেন। বৌদি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে যাচ্ছেন সব কিছু। একঝলক হোটেলের সেই ছেলেটিকে দেখলেন তিনি। ওদের আড্ডা থেকে কিছুটা দূরে এদিকে তাকিয়ে বসে আছে একমনে। বৌদি লক্ষ্য রাখতে রাখলেন ওকে।
সমুদ্রে আরতি দেওয়া হবে। আস্তে আস্তে সমুদ্রের কিছুটা জায়গা ঘিরে দেওয়া হলো। লোক জমে যাচ্ছে অনেক। বল্টুদারা সবাই মিলে যেখানে বসে আছেন তার ঠিক পাশেই। এখানথেকে বসেই ওরা আরতি দেখবেন। কি বিশাল বিশাল সব প্রদীপ। পুরোহিতেরা চলে এসেছেন। প্রদীপ জ্বলে উঠলো। আরম্ভ হলো মন্ত্রোচ্চারণ। নিমেষের মধ্যে পরিবেশটাই যেন পাল্টে গেলো। অনেকক্ষন ধরে আরতি চলে। হরিদ্বারের গঙ্গা আরতি দেখেছে বল্টুদা। গঙ্গার ছোটো ছোটো গলি পথ। এদিকে আরতি হচ্ছে, অন্য পাড়ে বসে দেখছে মানুষ। কেউ বা আবার একটু দূরে দুদিকের ওভার ব্রিজে বসে দেখছে। বিল হাতে লোকজন। গঙ্গা পরিস্কার আর সেবার নামে চাঁদা তোলা হচ্ছে। পরিবেশ সুন্দর কিন্তু কেন জানি ভক্তিভাব জাগে না। এই সমুদ্র পাড়ে বসে আরতি দেখতে দেখতে ভক্তিভাব জেগে উঠছে সবার।
আরতি চলতে চলতে অনেকেই এগিয়ে যাচ্ছেন সেদিকে প্রদীপের আগুনের তাপ নেবেন বলে। সবাই বসে আছে। একপাশে জুতগুলো খুলে রেখে অনেকেই এগিয়ে যাচ্ছেন। কি সুন্দর লাগছে চারপাশ। বল্টুদাদের আড্ডা চলছেই, কয়েকজন মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে প্রদীপের উষ্ণতা মাথায় মেখে আসছেন। চারিপাশে প্রচুর ভীড়। বল্টুদারা চেয়ার নিয়ে যেখানে বসে আছেন, তার চারপাশেও অনেকে জড়ো হয়েছে। ভীড়ের জন্য চারপাশটা ভালো করে দেখাই যাচ্ছে না। বল্টুদারা ওসব দিকে আর নজর না দিয়ে নিজেদের আড্ডা চালিয়ে যেতে থাকলেন। বেশ কিছুক্ষন পর আরতি বন্ধ হলো। আস্তে আস্তে একেবারে ফাঁকা হয়ে গেলো জায়গাটা। সবাই যে যার মত এসে নিজেদের জায়গায় বসলেন। হঠাৎ বারাসাতের বকুল বাবু চেঁচিয়ে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে সোদপুরের পারমিতা দেবী আর তার বর। নৈহাটির চক্রবর্তী কাকু আর কাকীমা। জুতো নেই। প্রায় দশ জনের জুতো নেই। চুরি হয়েছে এটা ভাবতে মুহূর্তও লাগলো না। কারন দুদিন ধরে ঘটনা গুলো যা হচ্ছে তাতে এ ছাড়া যে অন্য কিছু নয় সেটা সহজেই বোঝা যায়।
বল্টুদা কেমন আড়ষ্ট হলেন। কিন্তু সবাই এটা বুঝতে পেরেছেন যে বল্টুদার এক্ষেত্রে কিছু করার নেই। আর আশ্চর্য লাগছে এটা ভেবেই যে সবার নজরে থাকা জুতো গুলো কি করে চুরি হয়ে গেলো। এক নিদারুন ঘটনার সাক্ষী থাকতে হচ্ছে বল্টুদা এবং তার এই টিম কে। কে যে কাকে সান্তনা দেবেন জানেন না। অনেকের কাছে বিষয়টা সহজও হয়ে গেছে। যাদের গেছে, মানে জুতো চুরি হয়েছে তারাও যতটা দুঃখ পাওয়ার কথা ছিলো ততটা পাচ্ছেন না। মাঝখান থেকে কে যেন একজন বলে উঠলো, এই গণ জুতো চুরির আনন্দে আজ রাতে দারুণ একটা ভোজ হয়ে যাক। সবাই বেশ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে দেখলেন নৈহাটির চক্রবর্তী কাকু বললেন এটা। মজার মানুষ। প্রথম দিন থেকে সবাইকে বেশ মাতিয়ে রাখছেন তিনি।
এমন সময় বৌদি হঠাৎ কি মনে হওয়াতে পিছন ফিরে দেখলেন সেই হোটেলের রহস্যময় ছেলেটি নেই সেখানে। বৌদি চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে চারিদিকে অনেকবার খুঁজে দেখলেন, না নেই কোথাও।
কি আর করা। অগত্যা সেই জুতোর দোকান। কিন্তু এবারেও সেই পুরোনো জুতোর খোঁজ পাওয়া গেলো না। যে যার মত জুতো কিনে গেস্ট হাউজে ফিরলেন। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর জমিয়ে আড্ডা বসবে গেস্ট হাউজের সেই ছোট্ট মাঠটিতে।

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।