কবিতায় সুমন মল্লিক

অ্যাফ্রোদিতির স্বপ্নময় আলিঙ্গন

রাতের ঠিক এই সময়টায় ছুঁতে পারি অসম্ভবকে ৷ প্রিয় নিরালায়
পাতার পোশাক খুলে রেখে আমি স্বেচ্ছায় মেখে নিই
আঁধারের ছাইভস্ম ৷ চারদেয়ালে থেমে থাকা মুহূর্তেরা লিখছে
বৃষ্টির সৃষ্টিগাঁথা ৷ গ্লাসের প্রান্তে জমে ওঠা আদিম আগুনে
আমি ঠোঁট রাখছি না, আমার ঠোঁট আজ খুঁজে নিয়েছে অদম্য
আর্দ্রতার অন্তহীন মিরাকল ৷ বিছানায় মেঘের সাঁতার থেকে
উঠে এসেছে বিদ্যুৎমোড়া এক লাবণ্য ৷ আমি ঘুমের শরীরে
শরীর বন্ধক রেখে জাগিয়ে রেখেছি ইন্দ্রিয়ের ঝরনা – অর্থহীন
উড়ানের মাঝে অর্থপূর্ণ স্থবিরতার মিলনবোধন, যার গভীরে
নিভাঁজ নিসঙ্গতায় একটি স্বপ্নসারস গুছিয়ে রাখছে আচ্ছন্নতা ৷
রাতের ঠিক এই সময়টায় আমি পৃথিবীর সমস্ত কলুষিত দৃশ্য থেকে
সরিয়ে নিতে পারি চোখ ৷ কোনরকম বিষাদ-নিশাত একেবারেই
ভালো লাগে না, ভালো লাগে ঠোঁট থেকে কণ্ঠনালি হয়ে
নাভিমূলে জলজ হিল্লোল, ভালো লাগে নজরকে মুগ্ধ করতে
এক বেশুমার নজরপ্রপাতে ৷ পৃথিবীর সর্বশেষ রাস্তার
সর্বশেষ গন্তব্যে আমি ফিরে পাই সেই সুন্দরতম আকর্ষণ
যার স্পর্শে কিংবা স্পর্শহীনতায় ডানা মেলে বুকের কবুতর ৷
একটা প্রশ্রয়ভরা দর্শনে কোন গূঢ়ার্থ নিহিত থাকে না, অথচ
আমি কেশারণ্যে নিখোঁজ হই, দেখি নিঝুম এই রাতের মতো
একজোড়া চন্দ্রপদ্ম ৷
আমাকে আমার মতো থাকতে দিলো কই নিখুঁত অমানিশার
ঐ নরম নিঃশ্বাস – আমি বইয়ের পাতায় চোখ রাখতে
পারছি না, ডায়ারির ফাঁকা পৃষ্ঠা থেকে বেরিয়ে আসছে
না-বলা কথাদের মধুর মধুভ্রমি ৷ বুঝতে পারছি ডুবে যাচ্ছি ক্রমশ,
তবুও ভালো লাগছে ভীষণ এই নিঃসঙ্গতার সলিলসমাধি –
আমার শূন্যতাবোধের দখল নিয়েছে সৌম্য সহচারণের আমন্ত্রণলিপি ৷
রাতের ঠিক এই সময়টায় উলুধ্বনি বেজে ওঠে সারা শরীরে ৷ শরীর থেকে
বেরিয়ে আসে ধ্যানভ্রষ্ট এক যোগী, উন্মত্ত হয়ে উঠে, ওকে
শান্ত করে সেই তো একফোঁটা আদর-চুমু ৷
হোক না এমনি এমনি, তবুও তো আমার যাবতীয় পাথরসৃষ্টি
ধুয়েমুছে সাফ হয়ে ফুটে ওঠে পুরোনো প্রমোদী রাধাপদ্ম ৷
কেউ আমাকে বিরক্ত করে না এই সময়, চাঁদ বা কুয়াশাও না ;
আমার একাকীত্বে শিকারা চালায় স্খলিত মোহিণী –
সময়, তুমি স্থির থাকো এভাবেই ৷ যদি স্বপ্নও হয় এই ভালোলাগা,
ভেঙে যেন না যায় ৷ স্বপ্ন ভেঙে গেলে একা লাগে খুব ৷
আঙুল থেকে চুঁইয়ে নামছে আবর্তমানের আরোগ্য-তসলিম
আর নূপুরের শিঞ্জনে আমি জেগে আছি সম্মোহনের গর্ভে ৷
নীরবতার ভাষা আমাকে শিখিয়ে দিলো রাতের নিদ্রাহরিণী,
কথা হলো হৃদয়ে হৃদয়ে, পরাগে পরাগে লেখা হলো
দেহজোনাকির গীতবিতান ৷
আচমকা আমার দুর্বল বুকে বিদ্যুল্লতা খেলে যায় ৷ আমার
অনুভূতির শিকড়ে এসে বেঁধে নখের ভাস্কর্য, গোলাপি চুমুক ৷
আমার চারপাশের মশান বদলে হয়ে ওঠে রাতফড়িঙের
দিব্য মেহেফিল ৷ এই উপহার, এই বিপুল শূন্যতা দিয়ে মোড়া
শ্যামলিমা উপহার আমি দু’চোখে ঢেলে নিই ভরপুর, আর
প্রাণপণ প্রাণ ঢালি নীলিমাভিসারী হৃদখেয়ায় ৷
এ-ও এক বিস্ময়, প্রেমের চিতায় কীভাবে উঠে দাঁড়ায়
মৃত বিশ্বাস… নিজস্ব কিছু তৈরি হয় আবার, আবার
মৃদু শাসনে বাঁধা অপরিমেয় অনুরাগে ভিজে যায় কবির পোশাক ৷
রাতের ঠিক এই সময়টায় আমার কম্পমান আত্মায় এসে বসে
স্বপ্নপাখি, উড়িয়ে নিয়ে যায় অলৌকিক ইলিজিয়মে, ভেসে আসে
অ্যাফ্রোদিতির স্বপ্নময় আলিঙ্গন ৷
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।