সুস্মিতা অধিকারীর প্রবন্ধ

বাংলায় এম.এ। নেশা লেখালেখি।বাড়ি বাঁকুড়া জেলার মেজিয়া। বর্তমানে M.ed এর ছাত্রী। অজানার প্রতি ভীষণ কৌতুহল।

বাংলায় জীবিত কমলা ভট্টাচার্য

  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “মহুয়া” কাব্যের ‘সবলা’ কবিতায় উচ্চারণ করেছেন—-
‘ আমি নারী, আমি মহীয়সী
আমার সুরে সুর বেঁধেছে জোৎস্না বীনায় নিদ্রাবিহীন শশী।’
এখানে আছে নারী জাগরণের কথা, আত্মত্যাগের কথা যদিও তার বহু আগেই ভারতবর্ষের মাটিতে অনেক বিরাঙ্গনার কথা জ্ঞাত বা অজ্ঞাত হয়েছে। বিরাঙ্গনা নারীদের নামের তালিকা ধরলে যে নামটি আমার সর্বপ্রথম মনে আসে তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন আসামের শিলচরের প্রথম নারূ ভাষা শহীদ কুমারী কমলা ভট্টাচার্য।  এই বিরাঙ্গনা কখনও সাজাত্ম্যবোধে, কখনও নারী জাগরণে, কখনও আবার বতুন মন্ত্রে এগিয়ে এসেছেন।  ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে থাকা নয় প্রতিবাদে মুখর হওয়াটা তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য।
জলরাশি আকাশে উঠলে যেমন বৃষ্টি হয় ঠিক তেমনই ভাষা যখন মাতৃভাষারর রূপ নেয় এক- একটি অঞ্চলে- দেশে- রাজ্যে তখনই তা সার্থক হয়ে ওঠে এবং তা মানবমুখী হয়। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য হাজার বছরের বা তারও বেশি। অখন্ড ভারতবর্ষের বাংলা দেশে বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ। বাংলা ভাষা ও বর্ণমালাকে অন্য হরফে পরিবর্তন করতে না দেওয়ার জন্য এবং বাংলা ভাষাকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার জন্য বারবার সংগ্রাম করে বহু বাঙালী  মন – প্রাণ নিবেদিত করেছেন। সেরকম ভাবেই প্রাণ দিয়েছেন কমলা দেবী। তাঁর জন্ম-১৯৪৫, সিলেট ( শ্রীহট্ট), অসম, ব্রিটিশ ভারত।
মৃত্যু- ১৯মে, ১৯৬১,শিলচর,অসম,ভারত।
মিতা দাস পুরকায়স্থ তাঁর ‘উনিশের মে’ কবিতায় কমল ভট্টচার্যকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন–
‘ধন্য কমলা, ধন্যা শহিদ বিরাঙ্গনা
বরাকের মাটি ধন্য, ১৯৪৫ সালে তোমার জন্মে
নারীর উত্তরণের দিশারী তুমি অনন্যা
উনিশের কৃষ্ণচুড়া লাল তোমার রক্তে।’
১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে শিলচরের কাছাড়ে গঠিত হয় ‘ কাছাড় জেলা গসংগ্রাম পরিষদ’। সেখানে অনুষ্ঠিত ভাষার দায়িত্ব ও মর্যাদা কতখানি বিষয়ক বক্তৃতা শুনেই ভাষা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল।  ১৯৬০ সালে ১০ অক্টোবর কংগ্রেসের বিমলা প্রসাদ কালিহা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন আসাম বিধান সভায় নতুন আইন ‘রাজ্য ভাষা বিল’ চালু করেন। ২৪ অক্টোবর উপেক্ষিত হয় রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলা।
এরকম অবস্থার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা যখন একেবারে শেষের মুখে তখন ক্ষোভে রূপ নেয় আন্দোলনে। ১৯৬১ সালে ১৪ এপ্রিল শিলচরের কাছাড় জেলা গনসংগ্রাম পরিষদের উদ্দ্যোগে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংকল্প নেয় আর তাই সেদিনটি ‘সংকল্প দিবস’ বলে উদযাপিত হয়। ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু হয় পদযাত্রা,  ২ মে করিমগঞ্জ পৌঁছায় আন্দোলনকারীরা। এরপর ১৯ মে বরাক উপত্যকায় হরতাল আহ্বান করা হয়। শিলচরের রেলস্টেশনে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে এবং হাজার হাজার মানুষ প্রতিবাদে সামিল হয়। যে ভাষা নিজের ভাষা স আর থাকবে না এই আক্ষেপ গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল কমলা ভট্টাচার্যকে।
আর তাই মাত্র ১৬ বছর বয়সে নিজের জীবন বিপন্ন করে এগিয়ে যায় ‘ বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ’, মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’ এই স্লোগানে নিয়োজিত হতে। ঠিক এসময় শুরু হয় আন্দোলনকারীদের উপর সরকারি বাহিনীর লাঠিচার্জ এবং ছাত্র জনতাকে উদ্দেশ্য করে বিনা প্ররোচনায় ১৭ রাউন্ড গুলি করে পুলিশ।  আর সেই গুলিতেই মৃত্যু হোল কুমারী কমলা ভট্টাচার্যের।
স্বাধীন দেশে এই আন্দোললন এক রক্তাক্ত ইতিহাস। বাংলাকে আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় সরকার। আমার মনে হয় বর্তমানে প্রত্যেকটি মানুষের নিজস্ব ভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদা দেওয়া উচিৎ, শহিদের রক্তের বিনিময়ে তা নয় নিজের দায়িত্বের মধ্য দিয়ে। শিলচর স্টেশন ভাষা শহীদ ষ্টেশন নামকরণ করা হয়েছে। বাংলা ভাষা দীর্ঘজীবি হোক। প্রতিটি বাঙালী যেন তাঁর বাংলা ভাষাকে  কোনওদিন পিছপা হতে না দেয় আর তাতেই হবে বাংলা ভাষার জয়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।