সূর্যগ্রহণ ও একটি প্রতিশোধের গল্পে সৌভিক দত্ত

পেশায় গৃহশিক্ষক ও অনুবাদক। নেশা ইতিহাস চর্চা।
মহাভারতের গাদাগুচ্ছ রাজাগজাদের ঝাঁকের মধ্যে জয়দ্রথ হলো অন্যতম পরিচিত নাম। একে তো নিজে ছিলো মস্তবড় যোদ্ধা‚ কৌরবদের সাথে পারিবারিক সম্পর্কও আছে তার‚ নিতান্তই মার্সেনারি সেনা নয় সে‚ সে ছিলো কৌরবদের বোন দুঃশলার হাজব্যান্ড‚ তারউপর পান্ডবদের সাথেও তার ছিলো পার্সোনাল খারাখারি। একবার দ্রৌপদীর রুপ দেখে ক্ষেপে উঠে তাকে কিডন্যাপ করতে যায়‚ ফলে বেধড়ক ধোলাই খায় পান্ডবদের হাতে। সেই থেকে তক্কে তক্কে থাকে পান্ডব পিটানোর সুযোগ পাওয়ার জন্য। আর কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ তাকে এই সুযোগ এনে দিয়েছিলো। স্বাভাবিকভাবেই‚ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে জয়দ্রথ হয়ে উঠেছিলো দুর্যোধনের অন্যতম ভরসার জায়গা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরবদের হয়ে যে কটি সেনাবাহিনী লড়াই করেছিলো‚ তাদের একটা হলো জয়দ্রথের সিন্ধু বাহিনী! বাকিরা ছিলো ভগদত্তের কিরাত সেনা‚ কৃষ্ণের থেকে চেয়েচিন্তে আনা মার্সেনারি নারায়ণী সেনা‚ নীলের মাহিষ্মতি সেনা ইত্যাদি ইত্যাদি…………
যুদ্ধের তেরো নাম্বার দিন ছিলো পান্ডবদের জন্যে অন্যতম ভয়ঙ্কর দিন। এইদিন দ্রোন যুদ্ধে নেমেইছিলো যুধিষ্ঠিরকে বন্দী বানানোর জন্য। সেই উদ্দেশ্যে একদিকে অর্জুনকে ব্যস্ত রাখা হয় সংশপ্তকদের সাথে যুদ্ধে‚ অপরদিকে তৈরী হয় চক্রব্যুহ। সেই ব্যুহে ঢুকে বেঘোরে প্রাণ হারালো অর্জুনের সতের বছরের বাচ্চা ছেলে অভিমুন্য। জয়দ্রথ ছিলো সেইদিন সেই ব্যুহের গেটম্যান। অভিমুন্যকে ঢুকিয়ে দিয়ে বাকি পান্ডবদের সেই দরজাতেই আটকে দিলো সে। রীতিমতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিলো সেদিন জয়দ্রথ। মাছির মতো মরতে লাগলো পান্ডব সৈন্য। সাত্যকি‚ ধৃষ্টদ্যুম্নর মতো বড়বড় যোদ্ধাদের একাই ঘায়েল করে ব্যুহের দরজা থেকে ভাগিয়ে দেয় সে। খোদ ভীম পর্যন্ত সেদিন তার হাতে ঠ্যাঙ্গানি খেয়ে লম্বা দিতে বাধ্য হয়। আর ভেতরে বড় বড় যোদ্ধাদের হাতে বড় করুন ভাবে মারা পড়ে অভাগা অভিমুন্য।
সন্ধ্যায় শিবিরে ফিরে সব শুনে ক্ষোভে দুঃখে একরকম ক্ষেপে ওঠে অর্জুন। যুদ্ধে এটা তার দ্বিতীয় সন্তানের হত্যা। এর আগে গেছে ইরাবান। এবার গেলো অভিমুন্য। চক্রব্যূহের কথা সবকিছুই শোনে সে‚ শোনে সেদিন জয়দ্রথের ভয়ংকর বীরত্বের কথা‚ যে বীরত্বের সামনে ভীমের পর্যন্ত সিপিএম হাল হয়ে গেছে। ফলে অর্জুনের সব রাগ গিয়ে পড়ে জয়দ্রথের উপর‚ যে ওর জন্যই আমার ছেলেটা এমন অকালে বেঘোরে মারা পড়লো! ও যদি দরজায় না থাকতো তবে হয়তো ছেলেটা আমার বেঁচে গেলেও যেতে পারতো। কাল যদি সূর্যাস্তের আগে জয়দ্রথকে না মারতে পারি তবে আমিই আগুনে সুইসাইড করবো। আর দরকার নেই আমার এমন কলঙ্কিত জীবন রাখার।
অর্জুনের প্রতিজ্ঞা শুনে ঘাবড়িয়ে যায় পান্ডবপক্ষ। চোখে অন্ধকার দেখে তারা। ভীমকে বাদ দিলে পান্ডব শিবিরে এই একমাত্র সবেধন নীলমনি যোদ্ধা হলো অর্জুন। যদি কাল সে সূর্যাস্তের আগে জয়দ্রথকে মারতে না পারে? তবে? আর বেশীদূর ভাবতে পারে না পান্ডবরা‚ ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে তাদের।
আতঙ্কিত হয়ে পড়ে জয়দ্রথও। অর্জুন যে কি জিনিস তা সে হাড়ে হাড়ে জানে। এর আগেও কয়েকবার ধোলাই খেয়েছে সে অর্জুনের হাতে। অর্জুনের প্রতিজ্ঞা শুনে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে সে‚দাঁতে দাঁত লেগে যায়‚ বুঝতেও পারে নাসে যেখানে বসে আছে‚ সেই গদি নিজের অজান্তেই ভিজে চপচপে হয়ে গেছে কখন।
কিন্তু এদের মধ্যে কেউই বুঝতে পারে না‚ অর্জুনের এই প্রতিজ্ঞার পেছনে অর্জুন নেই। আছে ভারতকুল ধুরন্ধর খোদ কৃষ্ণ বাসুদেব যাদব। তৎকালীন ভারতের শ্রেষ্ঠ পুরুষ তিনি‚ যেমন রাজনীতি‚ তেমনই যুদ্ধবিদ্যা‚তেমনই আবার মনস্তত্ত্ব‚ চিকিৎসা বিদ্যা‚ জোতির্বিদ্যা – সব কিছুতেই অগাধ জ্ঞান তার। জোতির্বিদ্যায় সুপণ্ডিত হওয়ার জন্যই সে জানে‚ কাল আছে সূর্যগ্রহন। কৌরব শিবিরের পণ্ডিত মানুষ ভীষ্ম এখন শরশয্যায়। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহুত দূরে। বাকি মাথামোটা যোদ্ধাদের মধ্যে কেউই নিশ্চয়ই আর এখন কুরুক্ষেত্রের মাটি ছেড়ে সূদূর আকাশের ঘটনার দিকে নজর রাখার বিলাসিতা দেখাবে না! আর এই সুযোগকে যদি ……….
চৌদ্দ নম্বর দিনের কৌরবদের যুদ্ধনীতি তৈরীই হয় জয়দ্রথকে বাঁচানোর জন্য। জয়দ্রথকে দ্রোণ রাখে সকলের পিছনে। আর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় অন্যান্য বাঘা বাঘা যোদ্ধারা। হাতি বাহিনী নিয়ে সবার আগে অর্জুনের মুখোমুখি হয় দুর্যোধনের ভাই দুর্মর্ষণ। সেটাকে মেরে অর্জুন মোকাবিলা করে দুঃশাসনের। দুঃশাসনের অবস্থা টাইট হয়ে যায় প্রতিশোধস্পৃহ অর্জুনের সামনে পড়ে। সে হতভাগা দৌড়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে দ্রোনের পেছনে। অর্জুনকে ঠেকাতে এগিয়ে আসে খোদ দ্রোন। যুদ্ধ শুরু হয় দ্রোন আর অর্জুনে।
মিশনে যাওয়ার পথে খামোখা এমন উৎপাতে মহা বিরক্ত হয় কৃষ্ণ। অর্জুনকে ধমকায় সে‚’ দ্রোনের সাথে তিরধনুক খেলার অনেক সময় পাওয়া যাবে‚ এখন আপাতত জয়দ্রথের দিকে নজর দাও। অবিশ্বাস্য কৌশলে দ্রোনকে পাশ কাটিয়ে ব্যুহের ভেতরে জয়দ্রথের উদ্দেশ্যে রথ ছুটিয়ে দেয় কৃষ্ণ! প্রিয় শিষ্য অর্জুনযে এইভাবে কোনোদিন পালিয়ে যাওয়ার মতো অক্ষত্রিয়োচিত আচরণ করতে পারে‚ তা ধারণাতেই ছিলোনা দ্রোনের। ক্যাবলার মতো দাড়িয়ে দাড়িয়ে আচমকা ধাক্কা সামলানোর চেষ্টা করে সে।
এবার অর্জুনের সামনে এসে দাঁড়ায় খোদ দুর্যোধন। জয়দ্রথ সেদিন শুধু একজন ব্যক্তি না‚ সমস্ত কৌরব শিবিরের প্রেস্টিজের নাম সেদিন জয়দ্রথ। তাকে বাঁচাতে সেদিন স্বয়ং রাজপুত্র পর্যন্ত জান পণ করে দিচ্ছে। কিন্তু তাকেও বেশিক্ষণ ফাইট দিতে হয়না‚ অর্জুনের তীরের আঘাতে প্রেস্টিজ ট্রেস্টিজ ভুলে উল্টোদিকে ভাগলবা হয় সে।
দুর্যোধনের দুরবস্থা দেখে তাকে কভার দিতে এগিয়ে আসে কর্ণ‚ ভূরিশ্রবা‚ কৃপ আর শল্য। তাদের সাথে এবার লড়তে হয় অর্জুনকে। এদিক থেকে অর্জুনের সাপোর্টের এগিয়ে আসে ভীম আর সাত্যকি। ভীমকে আবার ভালোরকম টাইট দিয়ে দেয় কর্ণ।
সেদিন ভীমের হাতে মরে ধৃতরাষ্ট্রের আরো তিন ছেলে‚ বিন্দু অনুবিন্দু আর সুবর্মা! দ্রোণের হাতে মরে কেকয় রাজের ছেলে বৃহৎক্ষেত্র; শিশুপালের ছেলে ধৃষ্টকেতু আর ধৃষ্টদ্যুম্নের ছেলে ক্ষত্রধর্মা। আবার অলম্বুষকে মেরে ফেলে ভীমের পোলা ঘটোৎকচ। সাত্যকির হাতে মরে ভূরিশ্রবা। দলে দলে মরতে থাকে দুইপক্ষের সেনাসামন্ত। কৌরবদের ভীড় কাটিয়ে জয়দ্রথ পর্যন্ত কিছুতেই আর এগোতে পারে না অর্জুন। ওদিকে কিন্তু এগিয়ে আসছে সূর্যাস্তের মূহুর্ত। আশা নিরাশায় তখন ভয়ানক ভাবে দুলছে দুই পক্ষই।
এমন সময় ঘটে যায় অভাবনীয় এক ঘটনা। আচমকাই সূর্য লুকিয়ে পড়ে কোথায় যেন। চারিদিক ঘনঘোর অন্ধকার! সূর্যাস্ত‚ সূর্যাস্ত বলে রব ওঠে চারিদিকে! পান্ডবশিবিরে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। হায় হায় করে মাটি চাপড়ে কাঁদতে থাকে যুধিষ্ঠির‚ ভীম‚ সাত্যকি। আর এদিকে আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে কৌরব সেনা। দুর্যোধন‚ দুঃশাসন আনন্দে নাচতে শুরু করে দেয় মাঠের মধ্যেই‚ বয়স ভুলে নাচতে শুরু করে গুরু দ্রোনও। পুরো কুরুক্ষেত্র জুড়ে এই প্রথম কোনো মিশনে তিনি সফল হয়েছেন‚ সফল হয়েছেন অর্জুনকে ঠেকিয়ে দেওয়ার মিশনে। আনন্দে নাচতে নাচতে লুকানো জায়গা থেকে বেরিয়ে আসে জয়দ্রথও। আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কথায় পাকা অর্জুন আর তাকে মারবে না‚ এবার সে আত্মহত্যা করবে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে। এখন আর তাকে কোনো ভয় নেই। অর্জুনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাকে টিটকিরি দিতে শুরু করে জয়দ্রথ।
এমন সময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে আকাশে আবার ঝকমকিয়ে ওঠে সূর্য। চারিদিক ভরে ওঠে সূর্যের আলোয়। কি হচ্ছে‚ কেন হচ্ছে সেসব কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই কৃষ্ণ অর্ডার দেয় অর্জুনকে। মারো ওটাকে। শিগগিরই!
এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে মাথা কাজে আসেনা জয়দ্রথের। কাজে আসে না তার এতদিন ধরে শেখা এত যুদ্ধবিদ্যা। তবে বুদ্ধিমানের মতো মাঠঘাট ভেঙ্গে উল্টোদিকে দৌড় দিতে ভোলে না সে। য পলায়তি স জীবতি। ছোটো বেলায় বাবার কাছে শিখেছিলো। আপাতত তার লক্ষ্য কুরুক্ষেত্রের পাশে সেই ঋষি বাবা বৃদ্ধক্ষেত্রের আশ্রম। তৎকালীন প্রচলিত নিয়ম মেনে আশ্রমে কখনো রক্তপাত করা যায় না। ফলে একবার সেই আশ্রমে আশ্রয় নিতে পারলেই কেল্লাফতে। আজ সে বেঁচে গেলো! প্রাণপণে সেই আশ্রমের দিকে ছুট লাগায় মৃত্যুভীত জয়দ্রথ।
আর তাকে ধরার জন্য রথ নিয়ে ধাওয়া করে কৃষ্ণ। আর রথের উপর কি ঘটছে তা বুঝে উঠতে না পেরে তাব্দা মেরে তীর ধনুক হাতে বসে থাকে অর্জুন।
ছুটতে ছুটতে জয়দ্রথ এসে থামে বাবার আশ্রমে। ঢুকে পড়ে আশ্রমের সীমানার ভেতর। এবার সে একেবারে নিরাপদ। আশ্রমের সীমানার ভেতরে দাড়িয়ে নেচে নেচে মুখ ভ্যাংচায় সে রথে বসে থাকা কৃষ্মার্জুনকে।
কৃষ্ণ অর্ডার দেয় অর্জুনকে। তীর চালাও। অবাক হয়ে যায় অর্জুন। মিনমিন করে প্রতিবাদ করে সে।
– ব্রহ্মচারীর আশ্রম যে অহিংসার ক্ষেত্র‚ সেখানে রক্তপাত করাটা কি? ঠিক ইয়ে মানে নীতিবিরুদ্ধ
…………
ধুর্বাল। ধমকে ওঠে কৃষ্ণ। শাস্ত্রে বলেছে‚ শত্রুকে মারার থেকে বড় নীতি আর কিছু নেই! শত্রুকে সামনে পেয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়াই নীতিবিরুদ্ধ।
– কোন শাস্ত্র? কে লিখেছে ? বিষ্মিত হয়ে প্রশ্ন করে অর্জুন।
– আমার শাস্ত্র‚ এখনই লিখলাম। বলে কটমট করে অর্জুনের দিকে তাকায় কৃষ্ণ। ঘাবড়ে গিয়ে ধনুকের জ্যা ধরে থাকা আঙ্গুল আলগা হয়ে যায় অর্জুনের। ধনুকে তৈরী থাকা তীর ছিটকে বেরিয়ে ছুটে যায় জয়দ্রথের দিকে। জয়দ্রথ কিছু বুঝে ওঠার আগেই‚ ইক শব্দ করে মাটিতে পড়ে যায় তার বিশাল দেহ। আর চোখের সামনে পুত্রের এমন করুন মৃত্যু দেখে সেখানেই হার্টফেল করে মারা যায় জয়দ্রথের বাবা বৃদ্ধক্ষেত্র। পিতা-পুত্রের দুটো মৃতদেহ পড়ে থাকে পাশাপাশি!
ভারতের আকাশে সেদিনের রক্তস্নাত সূর্যের অস্ত যেতে তখনো কিছুক্ষণ বাকি ছিলো।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।