• Uncategorized
  • 0

সের্গেই কিরভ, রাজনৈতিক খুন, আর খুনের রাজনীতি।

লিখেছেন – মৃদুল শ্রীমানী

খুন কথাটা বললেই আমার মনে শীত শীত করে। বুক চেপে হে রাম বলতে বলতে মাটিতে পড়ে যান অসমসাহসী এক মানুষ। দিনটা ছিল ত্রিশ জানুয়ারি। দেশ তখন সদ‍্য স্বাধীন হয়েছে। যিনি দেশভাগ চাননি, দেশে হিন্দু মুসলিমের মধ‍্যে দাঙ্গা বাধলে যিনি অকুতোভয় ছুটে যেতে পারতেন, সেই গান্ধিজিকে গুলি করে হত‍্যা করে এক হিন্দু মৌলবাদী সন্ত্রাসী।
মনে পড়ে গুণী মানুষ ট্রটস্কির কথা। সাত নভেম্বরে গাঢ় শীতের সময় দুনিয়া কাঁপানো শুরু করে রাশিয়ার বিপ্লব। সালটা ১৯১৭। আর ১৮৭৯ এর ওই সাত নভেম্বরে জন্মদিন আরেক বিপ্লবী সংগঠকের। লিও ট্রটস্কি।
ট্রটস্কি ছিলেন বিশিষ্ট তাত্ত্বিক ও গুণী সংগঠক। তিনি “রেড আর্মি” প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি স্তালিনের আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে কথা বলায় স্তালিনের কোপে পড়েন, ও পার্টির পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বহিস্কৃত হন। নির্বাসিত হয়েও ট্রটস্কি স্তালিনের অমানবিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কথা বলতেন।
পরে লোক নিয়োগ করে স্তালিন এই বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী ব‍্যক্তিত্বকে খুন করান। ১৯৪০ সালের ২০ আগস্ট ছিল তারিখটি। মেক্সিকোয় খুনির কুড়ি বছরের কারাদণ্ড হয়। স্তালিন ওই খুনি ব‍্যক্তিকে “অর্ডার অফ লেনিন” সম্মানে ভূষিত করেন।
শীত শীত করতে ক‍রতেই মনে পড়ে সের্গেই কিরভ কে। রাশিয়ার গ‍রিব মানুষের অভ‍্যুত্থানের আরেক সংগঠক ও পলিটব্যুরো সদস্য ছিলেন সের্গেই কিরভ। লেনিনগ্রাদের পার্টি অফিসে আজকের দিনে তাঁকে গুলি করে খুন করেন এক বিশিষ্ট কমিউনিস্ট পার্টি নেতা লিওনিদ নিকোলায়েভ। অবশ‍্য লিওনিদকে সের্গেই হত‍্যায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন সর্বোচ্চ সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিন নিজেই।
ওই সের্গেই হত‍্যার ছুতো ধরেই পরবর্তী চারটি বছর ধরে লক্ষ লক্ষ দেশবাসী ও রাজনৈতিক নেতা কর্মীকে পার্জ করার নামে খুন করালেন স্তালিন। অথবা নির্বাসনে। অথবা জেলে।
খোদ লেনিনের উপরেও গুলি চালানো হয়েছিল। লেনিনকে কাছ থেকে গুলি করার দায় গ্রহণ করেছিল একটি মেয়ে। লেনিনের প্রকৃত নাম ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ। জন্মেছিলেন বাইশে এপ্রিল, ১৮৭০ সালে। ত্রিশ আগস্ট, ১৯১৮ তারিখে দক্ষিণ মস্কোতে মাইকেলসন আর্মস ফ‍্যাকটরি নামে একটি অস্ত্র কারখানার কাছে শ্রমিকদের মধ্যে বক্তৃতা দিতে গেছেন লেনিন। কাপলান, ফ‍্যানি এফিমভনা কাপলান, বছর ঊনত্রিশ বয়স তার, লেনিনকে পিছন থেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনিই লেনিন? লেনিন বললেন হ‍্যাঁ। কেন?
প্রশ্নের উত্তরে লেনিনকে গুলি করে কাপলান। ব্রাউনিং পিস্তল থেকে ক্লোজ রেঞ্জের তিন তিনটি গুলি।
লেনিন কিন্তু আহত হবার সাথে সাথেই মারা যান নি। কিন্তু গুরুতর জখম হয়ে প্রায় অকর্মণ্য হয়ে পড়লেন। লেনিনের অসুস্থতা আর কোনো ক্রমেই সারল না। ১৯২৪ এর শীতে জানুয়ারির একুশে লেনিন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। লেনিনের আততায়ী কাপলান কিন্তু যে সে মেয়ে ছিল না। সে ছিল সোশিয়ালিস্ত রেভলিউশনারি দলের একনিষ্ঠ কর্মী। কিছুতেই দলের আর কারো নাম না বলায় সোভিয়েত পুলিশ “চেকা” ওই মেয়েকে গুলি করে মারে। তারিখটি তেসরা সেপ্টেম্বর, ১৯১৮।
শীতের দিনে, নভেম্বরে, আততায়ীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হন কেনেডি। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পঁয়ত্রিশতম রাষ্ট্রপ্রধান, মহামহিম প্রেসিডেন্ট জন ফিটজেরাল্ড কেনেডি। তারিখটি হল বাইশে নভেম্বর, ১৯৬৩। প্রেসিডেন্ট পদে কেনেডি ক্ষমতাসীন হন ১৯৬১ সালের শীতে, জানুয়ারির কুড়ি তারিখে। জন্মেছিলেন ১৯১৭ সালে, ঊনত্রিশ মে। ছেচল্লিশ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট কেনেডির জীবনে ইতি টেনে দিল আততায়ীর গুলি। মার্কসিস্ট সন্ত্রাসবাদী লী হার্ভে অস‌ওয়াল্ড গুলি ছুঁড়ে হত্যা করে কেনেডিকে। ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় জ‍্যাক রুবি নামে পুলিশ অফিসার গুলি চালিয়ে খুন করে। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট তদন্ত কমিশন বসান। এফবিআই আর ওয়ারেন কমিশন একযোগে বলেন, লী হারভে একাই বুদ্ধি খাটিয়ে কেনেডিকে খুন করেছে। কিন্তু দেশের লোকের সন্দেহ যায় নি। কেনেডির মৃত্যু রহস্যে ঢাকা রয়ে গিয়েছে।
কেনেডির মতোই আরেক আমেরিকান রাষ্ট্রপতি খুন হয়েছিলেন আততায়ীর হাতে। তিনি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ষোড়শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন। ১৮৬১ সালের মার্চে লিঙ্কন ক্ষমতাসীন হন। আর ১৮৬৫ সালের গুড ফ্রাইডে, ১৪ এপ্রিল তারিখে তাঁর মাথায় গুলি করে জন উইলকিস বুথ নামে এক শিক্ষিত পরিশীলিত আততায়ী। নয় ঘণ্টা কোমায় থেকে পরদিন ১৫ এপ্রিল জীবনদীপ নির্বাপিত হয়ে যায় আব্রাহাম লিঙ্কনের।
বুথকেও গুলি করে মেরে ফেলা হয় ওই এপ্রিল মাসের ছাব্বিশ তারিখে।
তীব্র শীতের দিনে ডিসেম্বরের সাতাশ তারিখে খুন হয়েছিলেন বেনজির ভুট্টো। সালটা ২০০৭। পাকিস্তানের দুইবারের প্রধানমন্ত্রী তিনি। প্রথম দফায় ১৯৮৮ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত, আর পরে ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ অবধি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তান শাসন করেছেন বেনজির ভুট্টো। জন্মেছিলেন করাচীতে, ১৯৫৩ সালে। একুশে জুন ছিল তারিখটি। মারা গেলেন রাওয়ালপিণ্ডিতে।
শীতের দিনে জন্মেছিলেন ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধি। ১৯১৭ সাল। নভেম্বরের ঊনিশে। এমন রূঢ়, নিষ্ঠুর, ক্ষমতাবিলাসী প্রধানমন্ত্রী ভারতের ইতিহাসে আর আসেননি। ভারতের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী তিনি। জরুরি অবস্থা জারি করে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করার জন‍্য কুখ্যাত ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী। শীতের দিনে ১৯৬৬র জানুয়ারিতে প্রথম বারের জন্য ক্ষমতাসীন হন তিনি। একটানা শাসন ক‍রেছেন ১৯৭৭ এর মার্চ অবধি। নির্বাচনকে কুক্ষিগত ক‍রতে চেয়েছিলেন। আদালতে পরাজিত হন এই একনায়িকা। আবার ১৯৮০র শীতের দিনে জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসেন তিনি। ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে নিজের সরকারি আবাসের ঘেরাটোপে নিজের দেহরক্ষী দলের গুলিতে প্রাণ হারান ইন্দিরা।
এক শীতের দিনে ক্ষমতার গদি থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন রাজীব গান্ধি, ভারতের ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী। সেটা ১৯৮৯ এর দোসরা ডিসেম্বর। ইন্দিরা গান্ধির করাল মৃত্যুর সাথে সাথেই রাজীব ক্ষমতায় আসেন। তারপর কংগ্রেসের তাবড় নেতাদের পরিচালনায় ভয়াবহ শিখনিধন যজ্ঞ। নির্বিচারে শত শত নিরপরাধ শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষের রক্তপাতে কলঙ্কিত এই তরুণ প্রধানমন্ত্রীর শাসনকাল। বম্বে প্রদেশে ১৯৪৪ সালের বিশে আগস্ট রাজীব গান্ধি জন্মেছিলেন। তাঁর শাসন কালে দুর্বিষহ পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন ভারতের সাধারণ মানুষ। “ভূপাল গ‍্যাসকাণ্ড” তার একটি কলঙ্কিত ঘটনা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কলঙ্ক হল “শাহ বানো” বিষয়ে সরকারের ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যাওয়া। তামিল সেন্টিমেন্টকেও মারাত্মক আহত করে রাজীবের ব‍্যবহার।
ইন্দিরা হত‍্যার আবহে ১৯৮৪তে প্রধানমন্ত্রী হবার সময় ৫৪২টি আসনের সংসদে ৪১১ আসনের ব্রুট মেজরিটি নিয়ে ক্ষমতায় এলেও বোফর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে সম্মান হারিয়ে ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে ক্ষমতাচ‍্যুত হন রাজীব। তারপর এল সেই দিন। শ্রীপেরুমবুদুর এ থেনমোজি রাজারত্নম নামে এক আত্মঘাতী তামিল মহিলা আততায়ী নিজের গায়ে সাতশো গ্রাম আরডিএক্স বিস্ফোরক বেঁধে রাজীবকে হত‍্যা করে। তারিখটি ছিল একুশে মে, ১৯৯১। ওই দিনটি ভারতে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী দিবস হিসেবে পালিত হয়।
অনন্য সাধারণ জননেতা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের মুক্তিযুদ্ধ গড়ে তুলতে নেতৃত্বদানের যোগ্যতায়, স্বদেশপ্রেমের গুণে বঙ্গবন্ধু হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। এই আওয়ামী লীগ নেতা ১৯২০ সালের সতেরো মার্চ টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। দলের মধ্যে ছোট একটি গোষ্ঠীর নেতা খোন্দকার মোস্তাক আহমেদের ষড়যন্ত্রে জুনিয়র আর্মি অফিসারদের একটি দল এই নেতার বাসায় আক্রমণ করে পরিবারের সদস্যদের প্রত‍্যেককে খুন করে। মুজিব খুনের ঘটনার পিছনে সিআইএর হাত ছিল বলে সন্দেহ আছে অনেকের। যাই হোক জিয়াউর রহমানের হাতে গিয়ে পড়ে স্বাধীন বাংলাদেশ। এই জিয়াউর রহমান মুজিবের আততায়ীদের বিচারের হাত থেকে অব‍্যহতি দিয়ে মাথায় কলঙ্কের বোঝা তুলে নেন।
মুজিব আজও বা‌ংলাদেশের নয়নমণি। খুন করে এই জননেতা কে মুছে দেওয়া যায় নি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।