“হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে” গল্পে দীপা দাশগুপ্ত

” ইটস্ অল ওভার বিটুইন আস্”| রেগে গিয়ে মেঘমল্লার কাবেরীকে কথাগুলো বলল|
” তোমার আর আমার সম্পর্কটিকে আর জাস্ট নেওয়া যাচ্ছে না, হাসপাতাল থেকে এসে দেখব ফোনে খুট খুট করেই যাচ্ছ, আমি যে এতো ক্লান্ত সেদিকে কি তোমার একটুও খেয়াল আছে কাবেরী, তোমার তো ওই ফোন পেলেই হল, তাহলে থাকো তোমার ওই ফোন নিয়ে আমি চললুম”| কথাগুলো বলে মেঘমল্লার নিজের চেম্বারে চলে গেল, কাবেরী তখনও গল্প লিখেই যাচ্ছে|
মেঘমল্লার ও কাবেরীর প্রেমপূর্বক পরিণয় হয়েছিল| মেঘমল্লার তখন ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আর কাবেরী তখন সবে ফিলোসফি অনাস্ নিয়ে সিটি কলেজে ভর্তি হয়েছে| হঠাৎ একদিন বাসে করে যাওয়ার সময়ে মেঘমল্লারের মানি ব্যাগ চুরি হয়ে যায়, সে পরে মহাসঙ্কটে, এদিকে বাসের কন্ডাকটরও নাছোড়বান্দা কিছুতেই ছাড়বে না, অবশেষে কাবেরী সেদিন ওর বাস ভাড়া দিয়ে সেই যাত্রায় বাঁচিয়ে দিল, সেই থেকে বন্ধুত্ব, তারপর প্রেম, তারপর শুভ পরিণয়|
বিয়ের বছর তিন পরে কাবেরী যখন কনসিভ করল, তখন শুধু বাড়ি ভর্তি লোক, আনন্দ, হইচই কত কিছু| কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে সেই আনন্দ বেশি দিন টেকে নি| কনসিভ করবার সাত মাসের মাথায় একটা কার এক্সিডেন্ট কাবেরীর মিসক্যারেজ হয়ে যায়| ডাক্তার বলে কাবেরী আর কোনোদিনই সন্তানসম্ভবা হতে পারবে না| এই সময়ে কাবেরী যখন ভেঙে পরে তখন মেঘমল্লার তাকে গল্প লিখতে আবার বলে, মনের সমস্ত ভাব উজাড় করে গল্প লিখতে বলে, কাবেরী যেন লেখনীর মাধ্যমে তার প্রাণশক্তি ফিরে পেতে থাকে|
“না কাবেরীকে আজ অনেক খারাপ কথা বলে ফেলেছি, কি জানি কিছু খারাপ লেগেছে নাকি, যা অভিমানী, না বাড়ি যাই আজ”| ভেবে মেঘমল্লার সোজা বাড়ির দিকে গাড়ি ঘুরালো|
“হাই! কেমন আছেন স্যার, আমার লেখা নতুন গল্প গুলো পড়েছেন”| দিগন্তিকা মেসেজ করল আকাশ কে|
দিগন্তিকা ও আকাশ দুজনেই খুব ভালো লেখক, পাঠক এবং খুব ভালো বন্ধু দুজনে| একটা গল্প লেখার গ্রুপ থেকে তাদের আলাপ হয়| সেই থেকে দুজনের মধ্যে খুব ভালো সখ্যতা|
আকাশ অবশ্য ভৌতিক সাহিত্য লিখতে ভালোবাসতো আর দিগন্তিকা রহস্য কাহিনী, কিন্তু সাহিত্য বিষয়টা এক থাকায় দুজনের লেখার ফিল্ডটা অদল বদল করে নিয়েছে| আজকাল আকাশ রহস্য রোমাঞ্চ লিখছে আর দিগন্তিকা ভৌতিক|
” ইয়েস ম্যাম! আপনি তো দুর্দান্ত লিখেছেন, এখন তো মনে হচ্ছে আপনি আমার চাইতেও ভালো সাহিত্যিক, কিন্তু আমি মনে হয় রহস্য ঠিকঠাক লিখতে পারছি না”|
“আপনি যথেষ্ট ভালো লেখেন আকাশ!”
” ইয়ে বলছিলাম, যদি কিছু না মনে করেন, একদিন কি এই লেখিকাকে সামনাসামনি দেখা যাবে, কতগুলো লেখার বিষয় নিয়েও কথা বলবো বলেই আরকি যদি কিছু না মনে করেন “|
” নিশ্চয়ই, আমারও অনেক কিছু জানার আছে ভৌতিক বিষয়ে, বলুন কবে আসছেন?”
” রবিবার, বিকেল ৫ টায়, কফি হাউসের সামনে দেখা হচ্ছে “|
“আচ্ছা!” দিগন্তিকা দেখলো আজ তো শুক্রবার দুদিন পর দেখা হচ্ছে, তার আগে যে বিষয় গুলো নিয়ে ওর জানার আছে সেগুলো সব শর্টলিস্টেড করে নিতে হবে|
আজ রবিবার, আকাশ সকাল থেকেই চিন্তিত, ” কি জানি মেয়েটা আমাকে নিয়ে না খিল্লি ওড়ায়, যা সব রহস্য গল্প লিখি!”
বিকল ৫ টা নাগাদ দিগন্তিকা এসে পৌছাল কফি হাউসের সামনে কিন্তু আকাশ এখনো আসে নি, “মেসেন্জারে আমরা সব ঠিক ঠাক করেছি বলে ফোন নাম্বারটা নেওয়া হয় নি, ইস! থাকলে এমন দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না| মেসেন্জারে রিপ্লাই দিচ্ছে না, তবে কি আকাশ আসবে না”| এমন সময়ে হঠাৎ একটা অতিপরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে এল, ” কাবেরী!” চমকে গিয়ে দিগন্তিকা পিছন ফিরে দেখে মেঘমল্লার| কাবেরী হতভম্ব হয়ে গেছে, মেঘমল্লার বলে এবার, “হাই! আমি আকাশ ওরফে মেঘমল্লার “, এবার কাবেরীর কাছে সব পরিষ্কার হল, কিন্তু মেঘমল্লার যে এতো ভাল লেখক সেটা তো কাবেরী দিগন্তিকা না হয়ে উঠলো কোনোদিনই জানতো না|
” আজ যখন তুমি এই শাড়ীটা পরে বেড়োলে তখনও আমি কিছুই বুঝি নি, তোমাকে কিভাবে চিনবো তার ডেসক্রিপশন যখন দিলে মেসেন্জারে তখন বুঝলাম দিগন্তিকা আসলে কে, তাই তোমাকে চমকে দেব বলে একটু দেরিতেই আসলাম, এবার বলো কি নামে ডাকবো, কাবেরী না দিগন্তিকা| কাবেরী আমাদের কলেজ জীবনের প্রেমটা ফিরিয়ে আনার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ তোমায় “|
কাবেরী যেন বাকরুদ্ধ হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে আছে তার অতিপরিচিত মেঘের দিকে, ” মানুষটা এতো ভাল, এতো গুণী অথচ তার কদর দেওয়ার কোনোদিন চেষ্টাও করি নি , এই শুখনো দাম্পত্যে নব প্রণয় সৃষ্টি হল এই সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে যেন “|
এমন সময়ে মেঘমল্লার কাবেরী কে বাস্তবে ফিরিয়ে এনে বলল, ” অনেকদিন তোমার গান শুনিনি, আজকে শোনাও, বড্ডো ইচ্ছে করছে যে”,
“জানি জানি তুমি এসেছো এ পথে মনের ভুলে,
তাই হোক তবে তাই হোক দ্বার দিলাম খুলে
জানি জানি তুমি এসেছো এপথে মনের ভুলে”|
পড়ন্ত বিকালের আলোয় কাবেরীর এই গান যেন প্রকৃতিকেও প্রেমিকা করে তুললো|
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।