গল্পকথায় শর্মিষ্ঠা দত্ত

নষ্ট দাম্পত্য

“পল পল দিল কে পাস, তুম রহতে হো…” রিংটোন বেজে উঠতেই হাতের কাঁচিটা রেখে কাউন্টারের ওপর থেকে ফোনটা তুলে নিল শ্বেতা l এই রিংটোনটা অতনু স্পেশাল l বাজলেই যেন অতনুকে ছুঁতে পারে ও l কিন্তু এসময় অতনু ! ঘড়ি দেখল শ্বেতা l মাত্র সাড়ে এগারোটা l  আজকাল এমন যখন তখন কল করে না তো ! বিয়ের পরপর করত l নানা ছুতোয় দিনে অন্তত পঁচিশবার ফোন করে ওর গলা শুনত l
একটা হেয়ার কাটিং করছিল শ্বেতা l আয়নায় ক্লায়েন্টের বিরক্তিভরা মুখ দেখা যাচ্ছে l দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওখান থেকে চোখ সরিয়ে ফোনে মনোনিবেশ করল শ্বেতা l
“শ্বেতা সরি l আজও একটা অডিটের কাজে ঝাড়গ্রাম যেতে হচ্ছে l রাত্রে বাড়ি ফিরতে পারব না l তুমি সাবধানে থেকো l গাড়িটা কি করি বলতো ?”
উফফ আজও ! বেচারা অতনু ! প্রাইভেট কোম্পানি, প্রমোশনের নামগন্ধ নেই ! কিন্তু গাধার মত খাটায় l আজ ঝাড়গ্রাম, কাল শিলিগুড়ি, পরশু ব্যারাকপুর ! আজকাল প্রতি সপ্তাহেই ট্যুর থাকে অতনুর l ভাগ্যিস শ্বেতার গাড়িটা নিয়ে গেছে ! নইলে আবার ট্রেনে যেতে কত কষ্ট হত বেচারার l মনটা আর্দ্র হয়ে উঠল শ্বেতার l
“তুমি বরং গাড়িটা নিয়েই চলে যাও, সুবিধে হবে… আর সাবধানে থেকো l পৌঁছে ফোন কোরো l”
ফোনটা রেখে ক্লায়েন্টকে সরি বলে চটপট হাত চালালো শ্বেতা l সামনের আয়নায় ফুটে উঠেছে নিখুঁত স্টেপকাটের নীচে ক্লায়েন্টের স্যাটিসফাইড মুখের প্রতিবিম্ব l শ্বেতা এখন এই শহরের ব্যস্ততম বিউটিশিয়ান l মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই ওর পার্লার আর তার সঙ্গে একাডেমির নাম শহরে বেশ পপুলার l
দুটো বেডে ফেসিয়াল চলছে, ব্যস্ত পার্লার l পরপর থ্রেডিং আর একটা পেডিকিউর l অন্যরুমে বডি স্পা l ওটা শ্বেতা কোনো স্টাফের হাতে ছাড়ে না, নিজেই করে l দুপুরে ভীড়টা একটু কমই থাকে অবশ্য l নিজের কাজ শেষ করে, স্টাফরা ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা সেটা দেখে, প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে বেরোলো শ্বেতা l প্রায় তিনটে বাজে l আজ গাড়ি নেই, ক্যাব নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে l এখন ঘন্টাখানেক ছুটি l লাঞ্চ করে, একটু রেস্ট করে আবার ছুটবে পার্লারে l ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে দশটা l আগে অতনু অফিস থেকে ফিরে বসে থাকত, ফিরলে ডিনার করত একসঙ্গে l আজকাল অবশ্য অতনুরও ফিরতে বেশ রাত হয়,  শ্বেতা ফেরার পরেই ফেরে l আর সপ্তাহে একদিনের ট্যুর তো আছেই l মাত্র দুবছর বিয়ে হয়েছে, এর মধ্যেই ওদের সম্পর্কটা কেমন যেন হয়ে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে l নিতান্ত কেজো কথা ছাড়া আর কোনো কথাও হয় না l শারীরিক সম্পর্কও কালে ভদ্রে l সারাদিন কাজের পরে দুজনেই হা -ক্লান্ত ! সোমাবৌদি বলছিল বাচ্চা হল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বন্ধন l নাহ ! ব্যস্ততার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এবার একটা ইস্যুর চেষ্টা করতেই হবে l বয়েসও তো থেমে নেই ! তেত্রিশ হতে চলল l এবার ফ্যামিলি নিয়ে ভাবতে হবে l কালই কথা বলবে অতনুর সাথে l
বছর আড়াই আগে সোশ্যাল সাইটে  অতনুর সঙ্গে পরিচয় শ্বেতার l ওর পোস্টগুলো খুব ভালো লাগতো l যদিও সময় কম, কিন্তু অতনুর পোস্ট শ্বেতা রেগুলার দেখত, লাইক করত l একই শহরে, পাশাপাশি পাড়ায়  বসবাস, কিছু কমন বন্ধুও আছে l তাই আলাপ জমে উঠতে সময় লাগেনি l অতনু একটা প্রাইভেট ফার্মে সেলসে জব করে l শ্বেতার ব্যস্ততা ও রোজগার দুটোই ওর থেকে অনেক বেশি l অতনুর তখন একটা রিলেশনশিপ সদ্য ভেঙে গেছে, প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাওয়াতে ও খুব ভেঙে পড়েছিল l আঁকড়ে ধরেছিল শ্বেতাকে l কিছুটা সিম্প্যাথেটিক হয়েই ওকে একসেপ্ট করে শ্বেতা l অনেকেরই পছন্দ হয়নি এই রিলেশনশিপটা l মাস ছয়েকের মধ্যেই বিয়ে l আত্মীয়স্বজন , বাবা-মা, এমন কি বন্ধুরাও এত তাড়াহুড়ো করতে বারণ করেছিল ওকে l কিন্তু অতনু শ্বেতার প্রতি এত কেয়ারিং দেখে শ্বেতার বাবা-মা এখন বেশ নিশ্চিন্ত l শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে বেশ ভালোই আছে ওরা l শ্বেতার কাজের ব্যস্ততা বেড়েছে, অতনুরও l তাই একসঙ্গে দুজনের খুব বেশি সময় কাটানো হয় না l যেহেতু রোজগার বেশী তাই সংসারের আর্থিক দায়িত্ব নিলেও অন্য সবদিক থেকে শ্বেতা এখন পুরোপুরি অতনুর ওপর নির্ভরশীল l বাড়ির ঝুটঝামেলা তো বটেই, ওর ব্যাঙ্ক একাউন্ট থেকে শুরু করে ইনভেস্টমেন্ট… ফিনান্সিয়াল ব্যাপার পুরোটাই  অতনুই সামলায় l শ্বেতা খোঁজখবরও রাখে না l ওর যাকিছু, সবই তো অতনুর !
খেয়ে উঠে একটু গড়িয়ে নিচ্ছিল শ্বেতা l সারাদিনে এইটুকু সময় যা একটু রেস্ট হয় ওর l আধঘন্টা বাদেই আবার ছুটতে হবে পার্লারে l চোখটা একটু লেগে এসেছে, হঠাৎই ফোন বেজে উঠল l অচেনা নাম্বার l নিশ্চয়ই নতুন কোনো ক্লায়েন্ট l উফফ ! একটুও কি নিজস্ব সময় নেই ওর !
” নিউটাউন পুলিশ স্টেশনের সেকেন্ড অফিসার বলছি l অতনু ঘোষ আপনার কে হয় ?” শিরদাঁড়ার ভিতর দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল শ্বেতার l অতনু ঠিক আছে তো !
” ক-কি হয়েছে ? আমার হাজব্যান্ড কোথায় ?
“অতনু ঘোষ আপনার হাজব্যান্ড নাকি?”
“হ্যাঁ, ও কোথায়? ও ভালো আছে তো?” উদ্বিগ্ন স্বরে বলল শ্বেতা l
“আপনি এক্ষুণি থানায় চলে আসুন l এলেই দেখতে পাবেন l”
ফোনটা কেটে দিলেন অফিসার l মাথা কাজ করছিল না শ্বেতার l ভাইকে ফোন করবে ! নাহ, ও এখনও অনেক ছোট l ওকে থানাপুলিশে জড়িয়ে লাভ নেই l নন্দিনীকে বলা যাক বরং l নন্দিনী ওর ছোটবেলার বান্ধবী l সল্টলেকে থাকে l ওর হাজব্যান্ড সূর্যদা ল-ইয়ার l
ঘন্টাখানেক বাদে একটা ক্যাব নিয়ে নিউটাউন থানায় পৌঁছে শ্বেতা দেখল নন্দিনী পৌঁছে গেছে l অফিসারের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে অতনু l পাশে নীল কুর্তি পরা একটা মেয়ে l খুব চেনা চেনা l কোথায় যেন দেখেছে একে ! অতনুর ফোনের গ্যালারিতে ! সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল শ্বেতার l
মধুচক্র চলছে এমন অভিযোগে নিউটাউনের একটা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে  রেড করেছিল পুলিশ l সেখান থেকে মদ্যপ এবং আপত্তিজনক অবস্থায় অতনু আর ওই মেয়েটিকে পাওয়া যায় l পার্কিং লট থেকে শ্বেতার গাড়িটাও আটক করে পুলিশ l প্রায় মাসছয়েক আগে থেকেই এই ফ্ল্যাটে যাতায়াত করে অতনু, একথা স্বীকারও করেছে l এবং ওর এই অঢেল ফুর্তির টাকা আসে শ্বেতার একাউন্ট থেকে l মেয়েটা আর কেউ নয়, ওর প্রাক্তন প্রেমিকা নেহা l বর নাইজিরিয়াতে চাকরি করে, বিয়ের ছমাস পর থেকেই ওরা সেপারেটেড l নেহা এখন  কলকাতার ফ্ল্যাটে এই  মধুচক্রের মক্ষীরানী l মাস ছয়েক আগে থেকে আবার অতনুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা l
সব ভুলে গেল অতনু ! সব প্রতারণা, অপমান ! টাকার জন্য অতনুকে নাকি ডিচ করেছিল ! নাকি পুরোটাই ওদের দুজনের প্ল্যান ! শ্বেতার ব্যাঙ্কব্যালেন্সটা দরকার ছিল তাই ওর সঙ্গে  শুধু এতদিন ভালবাসার অভিনয় করে গেছে অতনু ! সত্যিই নেহাকে ভালোবাসত ও  ! নাকি ওদের ভালোবাসা শুধু শরীরের ! তাই শরীরের টানেই ফিরে গেছে নেহার কাছে ! গা ঘিনঘিন করছিল শ্বেতার l এই মিথ্যের স্বর্গে বাস করছিল ও ! এতদিন একসঙ্গে থেকেও চিনতে পারেনি এই লোভী মানুষটাকে ! এভাবেও মানুষের বিশ্বাস ভেঙে ফেলা যায় !
থরথর করে কাঁপছিল শ্বেতা l নন্দিনী ওকে জড়িয়ে ধরে চেয়ারে বসাল l নন্দিনীর ঠোঁটে কি প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপ ! নাকি অকৃত্রিম বন্ধুত্বের আশ্বাস ! ওকে কি বিশ্বাস করা যায় ! বিশ্বাস শব্দটা এত ঠুনকো কেন !
সূর্যদা এসে দাঁড়িয়েছে সামনে l
“শ্বেতা, তোর সূর্যদা জিজ্ঞেস করছে অতনুর জামিন করাবি নাকি এডাল্টরী ফোর নাইন্টি সেভেনে কেস করবি ?”
মুখ তুলে তাকাল শ্বেতা l
“প্লিজ শ্বেতা ক্ষমা করে দাও l ভুল হয়ে গেছে l আর কোনোদিন এমন করব না l” অতনুর চোখে অনুতাপ নয়, শুধু ভয়, সব হারানোর ভয় l
তীব্র ঘৃণায় চোখ সরিয়ে নিল শ্বেতা l ভিক্ষে দেবে ! এতদিন তো ভিক্ষেই দিয়ে এসেছে অতনুকে l শুধু নিজেই বোঝেনি সেটা l দান গ্রহণ করার যোগ্যতাই নেই অতনুর l শ্বেতা উঠে দাঁড়াল l
“যা হয় হোক, ওর জন্য আর কিচ্ছু  আমি খরচ করব না সূর্যদা, একটি মুহূর্তও না l”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।