শো হাউসে পঁচাত্তর পয়সা দামের টিকিট কেটে আমরা যখন সেইসময়কার এবং এইসময়কার হিসেবেও মাইলফলক সিনেমাগুলো দেখেছি, তখন হাফটাইমে একজন ট্রেতে করে ভেজিটেবেল চপ বিক্রি করতে আসত, তার গন্ধটা এখনো নাকে লেগে আছে। কিন্তু সতৃষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকলেও খুব কমই সেসব আমাদের কিনে দেওয়া হত। আমাদের মফস্বলে আলুর চপ, বেগুনি, ফুলুরি, বোম (এটা মেগা ফুলুরি)-র মধ্যে ভেজিটেবল চপ একেবারেই নবাগত এবং রোল সাম্রাজ্য শুরু হবার আগে পর্যন্ত ধারাবাহিক হিট দিয়ে এসেছে একাই।কিন্তু তাও বিশেষ কিনে দেওয়া হত না এইকারণেই , যে মুখ চালাতে চালাতে সিনেমা দেখার কালচার তখনো চালু হয়নি। বিশুদ্ধ সিনেমা দেখাটাই একটা পবিত্র এবং সর্বমনোযোগগ্রাসী বিনোদন ধরা হত, তার মধ্যে খাওয়াদাওয়াটা যেন ছিল বেশ নিম্নরুচির পরিচয়।যদিও গ্রামেগঞ্জে যাত্রা দেখতে গেলে সবাই চিঁড়েমুড়ি বেঁধে নিয়ে যেত। তার একটা কারণ বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে, হয়তো দুতিনটে গ্রাম পরে যাত্রা হচ্ছে আর দ্বিতীয়ত সেটা প্রায়ই হত সারারাতব্যাপী।
এরপর টেলিযুগ শুরু হল, তারপর সেই রামায়ণ, মহাভারতের সাঁই সাঁই যুদ্ধ আক্রমণ, আক্রমণ, রোববার সকালে আসমুদ্রহিমাচল রাস্তাঘাট শুনশান, তার আগে কোনরকমে একটা টিফিন রেডি করে সবাই মিলে টিভির সামনে বসে খেতে খেতে দেখা। আমার মনে হয় মল কালচারের একটা আটপৌরে সূচনা নিঃশব্দে হয়ে গেল তখন থেকেই। সেই আদি দর্শকই যখন আইনক্সে দেড়শ টাকার টিকিটে তিনশ টাকার পপকর্ন দেখে চমকে ওঠেন, তখন আমার মনে পড়ে পঁচাত্তর পয়সার সিনেমার টিকিট কেটে, হাফটাইমে হাবুর চপ খেতে হলে দেড়টাকাই দিতে হত কিন্তু।
শুধু সিনেমাহলে খাবার কেনা নয়, অনেক কিছু কেনাকেই মনে করা হত বাজে, ফালতু খরচ। যেমন বাহারি পোশাক, প্রসাধনী, বাড়ি সাজানোর উপকরণ।কিছু কেনার সময় দেখা হত জিনিসটা যেন আয় দ্যায়। কাজে লাগে। বিদ্যাসাগরকে যেমন একবার একজন জিগ্যেস করেছিল, কেন তিনি বেকার এত খরচ করে বই বাঁধিয়েছেন। জামাকাপড় কেনা হত সবসময় এক সাইজ বা দু সাইজ বড়, যাতে হেসেখেলে দুচার বছর চলে যায়। এমনকি জুতো পর্যন্ত! ভেতরে ন্যাকড়া বা তুলো গুঁজে এক সাইজ জুতো আহ্লাদ করে আমরা কত পরেছি। ইস্কুলের টিনের বাক্স থেকে বিয়ে পর্যন্ত আশা করা হত যে টেঁকসই হবে। এখন মানুষ জীবনের কোন কিছু থেকেই এমন বোকা বোকা প্রত্যাশা করে না। আরে মশাই হেসে নাও দুদিন বৈ তো নয়। কাল হো না হো।
বিশ্বায়ন-পূর্ব পৃথিবীটা আদৌ ছিল কিনা আজকাল মাঝে মাঝেই সন্দেহ হয়। সেই পৃথিবীর জীবন যাপনের নাম ছিল সিম্পল লিভিং হাই থিংকিং।(হাই থিংকিং ব্যাপারটা কিন্তু হাইলি সাসপিশাস!)এর একটা ব্যাখ্যা নিজের মতো করে সবাই করেছিল। সেটা হচ্ছে মিতব্যয়িতা। যার প্রকাশটা মাঝে মাঝেই উৎকটরকম হত। আমার মার ছিল বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো। এদিকে অতিথি অভ্যগতের বিরাম নেই, চা জলখাবারেই কোম্পানি ফেল মেরে যেতে পারে, কিন্তু সেই তিনিই ছানার ডালনাতে ছানা কাটা জল দিচ্ছেন কারণ সেই ‘কাজে লাগানো’, রিসাইক্লিং। যার ফলে ছানার ডালনাটি এত টক যে খাওয়াই গেল না। বাঙ্গালদের সম্পর্কে একটা মিথ প্রচলিত ছিল যে তারা কিচ্ছু ফেলে না, পচা মাছ, আলুর খোসা দিয়ে যা রাঁধে তাতে এক থালা ভাত সাবাড় করে ফেলা যায়। এতটা না হলেও জিনিস নষ্ট করাকে ঘটি পরিবারেও মোটেও সুনজরে দেখা হত না। আমি দেখেছি আমার এক মামা পৈতে হয়ে গেলে যে চারপাঁচ দানা ভাত গণ্ডূষ করে থালার বাইরে একটু জল দিয়ে ফেলে দিতে হয়, দিদা আড়াল হলে সেই চারপাঁচ দানা ভাতও তুলে খেয়ে নিত। পাতে ধান পড়লে ধানের খোসা ফেলে ভেতরের ভাতের শাঁসটুকুও নষ্ট করত না। সেসময় গ্লোবাল ওয়ার্মিং, রিসাইক্লিং এসব নিয়ে এত হইচই হয়নি, কিছু না জেনেই সারা পৃথিবীর ভালোর জন্যে অনেক সুঅভ্যাস মেনে চলতেন আমাদের পূর্বপুরুষ, বিশেষ করে পূর্বনারীরা। যা কিনা ইকোফেমিনিজমের সহজ পাঠ। আলুর খোসা না হলেও লাউয়ের খোসা ভাজা মাঝেমাঝেই খেতে হত।কেউ তরকারির খোসা মোটা করে কাটলে মা রেগে যেত। একটা কথাই তো আছে- তুমি কেমন বড়মানুষের ঝি/ কাঁচকলাটা কুটতে দেখে খোসায় বুঝেছি। তবে জিনিস কাজে লাগানো, ফেলে না দেওয়া ইত্যাদি আমার মায়ের ক্ষেত্রে প্রায়ই কমিক হয়ে যেত। এমনিতে সেসময় প্রায় সব ঘরেই বাড়ির মহিলারা রাতের বাসি রুটি ডালডায় ভেজে টিফিন খেতেন। সেটা কতটা সকালের রুটি করার পরিশ্রম বাঁচানো, কতটা কোন কিছু না ফেলা, কতটা অতি উপাদেয় রুটিভাজা খাবার লোভে কে বলবে।কোন জিনিস নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না- এই ব্যাপারটা ফ্রিজ আসার পর একেবারেই আমাদের হাতের বাইরে চলে গেল। বেঁচে যাওয়া খাবার, কেতাবি ভাষায় যাকে বলে লেফট ওভার, তা ফ্রিজে জমা হতে থাকে। একদিন, দুদিন নয় দিনসাতেকের বাসি খাবার মা দিব্যি খাচ্ছে, খেয়ে হজম করছে। আমরা সেইসব খাবারকে তখন বছরওয়ারি নামে ডাকতে শুরু করি। কোনটার নাম ১৯৪২, কোনটা ১৯৭০, কোনটা ১৯৮৫। তাতেও মা এতটুকু দমেনি। তার ‘খাবার একটুও নষ্ট করা যাবে না’- মিশন চালিয়ে গেছে।
মিতব্যয় আর কৃপণতার মধ্যে প্রায়ই এক সুতোর ব্যবধান থাকে। এমন কত গল্প আমাদের পারিবারিক ইতিহাসে ঘোরাফেরা করত। একবার বাবার সঙ্গে আমরা ওড়িশা ভ্রমণে গেছি। লম্বা সেই ভ্রমণ বাঙ্গালির গড়পড়তা সফরের থেকে একেবারেই আলাদা। কটক, পাহাড়া, ভুবনেশ্বর, সবজায়গাতেই অফিসের চমৎকার গেস্টহাউসে থাকার ব্যবস্থা। সম্ভবত ভুবনেশ্বরে পৌঁছে একটি অতি সম্পন্ন বাড়িতে আমাদের এক দুপুরে নিমন্ত্রণ।আমার তখন বয়স বছর চার, দাদার বারো। শৈশবে তিনপো মোষের দুধ ফি রোজ খাওয়া সেই বালকের তখন রাক্ষুসে খিদে।শুধু সে কেন, বাকিদের অবস্থাও খারাপ। খাবার টেবিলে সবাই অধীর অপেক্ষা করছে কখন ভাত আসবে। এল ভাত, ধূমায়িত, জুঁইফুলের মতো সাদা ঝরঝরে ভাত, তাতে বেশ দরাজ হাতে ঢালা ঘি, সেই বালক তো ঘি দিয়েই এক থালা ভাত খেয়ে ফেলল। তারপর এল চমৎকার পাঁপড় ভাজা। বালক আনন্দে আরও ভাত নিল। তারপর? তারপর হায়, আর কিছুই এল না! পরদায় ফুটে উঠল – সমাপ্ত!
মোটামুটি এইসব শুনতে শুনতে আমাদের একটা পরিষ্কার ধারনা হয়ে গেছিল, কোন আত্মীয়-বন্ধুর বাড়ি গেলে চায়ের সঙ্গে নেতানো থিন অ্যারারুট বিস্কুট আসবে, কারা সাইকেল নিয়ে সিঙ্গাড়া আনতে ছুটবে, কারা আবার লুচি না খাইয়ে ছাড়বে না। এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়াকে নিয়ে কিংবদন্তী চালু ছিল, তিনি নাকি সুতো দিয়ে ডিম ভাগ করে অতিথি সেবা করেন। ভুলেও তাঁদের বাড়ি পা মাড়াই নি। তবে আধখানা ডিমের জাদু বাস্তবতা আমি অন্যত্র দেখেছি।
একটি বাড়িতে আমাদের যাতায়াত ছিল, এতটাই নৈকট্য যে মা ক্লাস ফাইভের অ্যানুয়াল পরীক্ষার সময় আমাকে সেই বাড়ির মাসীমার কাছে রেখে দিদির শ্রাদ্ধে যায়।প্রায় দিন পনেরো তো বটেই। দিদি মানে মার সেই ঠাকুমা, যিনি বয়সে তাঁর সৎ ছেলে, আমার দাদুর চেয়ে ছোট। তিনি এই পরিবারটির ইতিহাস রচনা করেছিলেন, সুতরাং তাঁর মৃত্যু নিশ্চয় মেয়ের অ্যানুয়াল পরীক্ষার চেয়ে অনেক বড় ঘটনা। এটা ঠিক, তখন রাস্তাঘাটে এত মার্ক্সবাদী মায়ের দেখা মিলত না আর আমার মাও সতীশের মা নয়। তবু প্রায় সবাই মার এই আচরণে রীতিমতো আঁতকে উঠেছিল এবং মা যদি কোন ফরাসি চিত্রপরিচালকের সঙ্গে পালাত, তাহলেও বোধহয় লোকে এত স্তম্ভিত হত না।
আমি কিন্তু ওই কটা দিন মাসীমা আর পাঁচ দিদির আদরে মহানন্দে কাটিয়েছিলাম। মেসোমশাই জিপিও-তে খুব সামান্য মাইনের চাকরি করতেন। সংসারে অভাব প্রচুর ছিল, কিন্তু আনন্দ তার থেকে অনেক বেশি। দিদিরা মেঝেতে ঢালা বিছানায় শুত, আমাকে নিয়ে মাসীমা তক্তপোশে, খাওয়ার সময়ও আমি দেখতাম, আমার পাতে আস্ত ডিম আর দিদিরা পেত আধখানা করে ডিম। প্রত্যেকেই সেই আধখানা ডিম সযত্নে রেখে দিত একদম শেষে খাবে বলে। ঘুটিয়ারিশরিফে ওদের দেশের বাড়ি ছিল। সেখান থেকে লাল লাল মোটা মোটা ঢেঁকিছাটা চাল আসত। কী মিস্টি তার স্বাদ।তার সঙ্গে মাসীমার হাতের পেঁয়াজ রসুন শুখনো লংকাবাটার লাল রঙের ডিমের ডালনা কিংবা কচুর মুখীর দম, আমাদের বাড়ির রান্নার থেকে একেবারে ভিন্ন সে স্বাদ এখনো জিভে লেগে আছে।রান্নাঘরে পিঁড়ে পেতে বসে সবাই মিলে মিটমিটে আলোর তলায় খাওয়া, গল্প করতে করতে হাত শুকিয়ে চড়চড়ে হয়ে যেত। উঠোনে বাথরুম, আমি গেলে কেউ না কেউ দাঁড়াত। দুপুরে অনেক সময় মাসীমা প্রথম পাতে নিমপাতা গুঁড়ো দিয়ে মাখা আলুভাতে দিত, কখনো উঠোনের শিউলিগাছের পাতা কুচিয়ে চালের গুঁড়ো দিয়ে করা শিউলিপাতার বড়া। আমি ভীষণ রকম তেতো ভক্ত, নিম-বেগুন, উচ্ছের ঝাল, শুক্তো বা যুক্তিফুল চচ্চড়ি। কিন্তু মাসীমার তেতোর গুরুত্ব অন্যরকম।উঠোনের নিম বা শিউলি গাছ থেকে সারাবছরের তেতোর যোগান আসত। নিমপাতা শুখনো খোলায় গুঁড়ো করে হরলিক্সের বোতলে রাখা থাকত। খাওয়ার অরুচিতে এগুলো ছিল অব্যর্থ দাওয়াই।
যাদের অনেকেই আজ চল্লিশ পেরিয়ে চালশে আক্রান্ত, হাতে টাকা থাকলেও আস্ত বা আধখানা ডিমের কোন কুসুমই তাদের জোটে না, বোকা বোকা মুখে ডিমের সাদা খেতে হয়। অনেক খাবার আছে, কিন্তু গল্পের চোটে এঁটো হাত শুকিয়ে চড়চড় করবে এমন কোন খাবার সঙ্গী নেই আর। অরুচির মুখে মাসীমার নিমপাতা গুঁড়ো ভরতি হরলিক্সের বোতলটার কথা মনে পড়ে খুব।