সাপ্তাহিক শিল্পকলায় “ভারত ও পাকিস্থানের দুই পিকাশো – ৩”- লিখেছেন আলবার্ট অশোক (পর্ব – ১৮)

মকবুল ফিদা হোসেন, সৈয়দ সাদেকোয়ান আহমেদ নকভি – ৩

সৈয়দ সাদেকোয়ান আহমেদ নকভি।

আগের দুই পর্বে, সাদেকাইন ও মকবুলের সাধারণ জ্ঞাতব্য তথ্য, যা সাধারণ মানুষের কৌতূহল থাকে তা নিয়ে বলেছি। এই পর্বে, তাদের কিছু কাজ কর্ম যা তাদের মহান বানিয়েছে, সে নিয়ে উপস্থাপন করছি।
সৈয়দ সাদেকাইন আহমেদ নকভি-কে, তমঘা-ই-ইমতিয়াজ, প্রাইড অফ পারফরম্যান্স, সিতারা-ই-ইমতিয়াজ, সাদেকায়েন নককাশ (Tamgha-e-Imtiaz, Pride of Performance, Sitara-e-Imtiaz, also often referred to as Sadequain Naqqash) নামেও অভিহিত করা হত, তিনি বিশ্বখ্যাত পাকিস্তানী শিল্পী ছিলেন, তিনি দক্ষ একজন ক্যালিগ্রাফার (calligrapher) এবং একজন চিত্রশিল্পী হিসাবে  বিখ্যাত ছিলেন । তিনি পাকিস্তান তৈরি করেছেন এমন অন্যতম সেরা চিত্রশিল্পী এবং ক্যালিগ্রাফার হিসাবে বিবেচিত হন।
এই দুই শিল্পীর কাজের ধারা ও কাজের জমি ও সময় (স্থান, কাল ও পাত্র) পুরো আলাদা। ফলে আলাদা চরিত্র নিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন। যেহেতু ইসলামিক দেশে ফিগার আঁকা ধর্মীয় বারণ তাই সেখানে ক্যালিগ্রাফি বা লতাপাতার আকৃতিকে অবলম্বন করে শিল্প গড়ে উঠেছে। পাকিস্থানের জনগণের অভাব অনটন সাদেকাইনের ছবির মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে।
সাদেকাইন পাকিস্থানে চলেযান ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে। তার পরিবারে ক্যালিগ্রাফের চর্চা ছিল। তার একদম ছোটবেলার কথা বিশেষ পাওয়া যায়না।ছোটবেলাটা কেটেছে অবিভক্ত ভারতে। পাকিস্থানে তাঁকে মহান শিল্পী বা কলাকার বলে পথিকৃৎ পরিচিতি আছে।

সাদেকাইনের পূর্ব পুরুষেরাও এই লিখন পদ্ধতি বা ক্যালিগ্রাফি করতেন। ১৯৪০ এর দশকের শেষের দিকে তিনি প্রগতিশীল লেখক এবং শিল্পী আন্দোলনে (Progressive Writers and Artists Movement) যোগদান করেছিলেন। তাঁর আসল প্রতিভা আবিষ্কার করেছিলেন হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (Huseyn Shaheed Suhrawardy) যিনি সাদেকাইনকে আলোতে নিয়ে এসেছিলেন। সাদেকাইন তার দক্ষতা বাড়াতে প্যারিসেও কিছু সময় থেকেছিলেন। তিনি তাঁর ক্যালিগ্রাফিক স্টাইলের জন্য অনেক প্রশংসা পেয়েছিলেন, যা দক্ষিণ এশীয় শিল্পের অনেক সমালোচকদের কাছে আইকনিক হিসাবে বিবেচিত হন।

 তার কর্ম জীবন অনেক গৌরবের, এবং মনে হয় তিনি ভাগ্যবান। সবাই জীবনে কাজ করার সুযোগ পায়না। তিনি পেয়েছেন। অবশ্য তার ব্যক্তিগত জীবন, ব্যবহার ও কাজের দক্ষতা এগুলিও তাকে পূর্ণতা পেতে সাহায্য করেছে। শুধু ভাগ্য একা নয়।
১৯৫৪ সালে কোয়েটায়  সাদেকাইনের প্রথম একক প্রদর্শনী হয়। তখন তার বয়েস ২৪ বছর। তারপর ১৯৫৫ – জিন্নাহ হাসপাতালে মুরাল, ফ্রেয়ার হলে প্রদর্শনী এবং মিঃ সোহরাওয়ার্দীর বাসভবনে। ১৯৬০ সালে তমঘা-ই-ইমতিয়াজ ভূষিত এবং জাতীয় প্রদর্শনীতে প্রথম পুরষ্কার পান। ১৯৬১ সালে “Laureate de Paris”। ১৯৬২ সালে  স্টেট ব্যাঙ্ক অফ পাকিস্তানের মুরাল এবং ফ্রান্সে প্রদর্শনীর জন্য রাষ্ট্রপতির সম্মান পদক, পান।

.১৯৬৩তে – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ, বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী করেন। এরপর তার কাজ ও খ্যাতির গ্রাফ চড়তে থাকে উপরের দিকে। প্রচুর ম্যুরাল করেন,নানা সরকারি ও বেসরকারি বিল্ডিং, অফিস, বাঁধ (১৯৬৭ সালে Mangla Dam- এ , পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে,লাহোর মিউজিয়ামে, আবুধাবিতে — এমনকি যখন ভারতে ঘুরতে আসেন ১৯৮১ সালে আলিগড়,বানারস, হায়দরাবাদ, দিল্লিতে অনেক  মুরাল বানান। ) বহু বিখ্যাত লেখকের বইয়ের ভেতরে অলঙ্করণ করেন যেমন অ্যালবার্ট কামুর, গালিবের (Ghalib), ফয়েজ আহমদ ফয়েজ  ( Faiz Ahmad Faiz)।  তিনি নিজেও ছিলেন একজন কবি। ওমর খৈয়াম ও সরমাদ কাশানির ( Omar Khayyam and Sarmad Kashani.)স্টাইলে তিনি কয়েকশো রুবাইয়েত(rubāʿiyāt) লিখেছিলেন।

 ১৯৫০ এর দশকে উত্তর আফ্রিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন অংশে স্বাধীনভাবে একটা বিস্তৃত ইসলামিক শিল্প আন্দোলন গড়ে উঠেছিল,সেই আন্দোলনের নাম ছিল হুরুফিয়া (Hurufiyah) আন্দোলন, সাদেকাইন সেই আন্দোলনের অংশ ছিলেন। হুরুফিয়াহ শিল্পীরা  ঐতিহ্যবাহী শিল্প ফর্মগুলির সাথে ক্যালিগ্রাফি মিশিয়ে সমসাময়িক এক নতুন শিল্পের উপস্থাপনা এনেছিলেন।তারা পশ্চিমী শিল্প সৃষ্টির ধারণাকে বর্জন করতে চেয়েছিলেন। হুরুফিয়াহর মাধ্যমে পাকিস্থান স্বদেশী এক চিত্রকলার সন্ধান করেন। যেমনটি বাংলাতে বেংগল স্কুল আঁকা ঘরানা অবন ঠাকুর তৈরি করতে চেয়েছিলেন। সাদেকাইনের কাজের আগে মাত্র কয়েকজন চিত্রশিল্পী পাকিস্তানের মিডিয়াম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। সাদেকায়েইন এই  শৈলীর পথিকৃৎ, তিনি ক্যালিগ্রাফিকে মূলধারার শিল্প আকারে নিয়ে আসে এবং পাকিস্তানি শিল্পীদের পরবর্তী প্রজন্মকে প্রভাবিত করেন। তার এই কাজের জন্য Renaissance of Islamic calligraphy পাকিস্থানের ইতিহাসে চিহ্নিত হয়।

 Mural at Banaras INDIA

 

 Mural at Aligarh INDIA
সাদেকাইনের করা ম্যূরালগুলি বেশ বড় বড় সাইজের। যেমনঃ The State Bank of Pakistan (100 x 12 ft), এই ম্যূরাল টার নাম “Treasures of Time”। এতে তিনি সক্রেটিসের সময় থেকে ইকবাল এবং আইনস্টাইনের (Socrates to that of lqbal and Einstein.)সময়ে মানুষের বৌদ্ধিক অগ্রগতি দেখিয়েছিলেন। এটি একটি রেখার বাঁধনে সৃষ্টি যা গ্রীক যুগের বুদ্ধিজীবী এবং চিন্তাবিদদের, মধ্য প্রাচ্যের গণিতবিদ এবং রসায়নবিদদের, ইউরোপীয় নবজাগরণের বিদ্বানদের এবং বিশ শতকের বিখ্যাত মানুষদের দেখায়। The Power House at the Mangla Dam (200 x 30 ft), Lahore Museum, Lahore, Aligarh Muslim University (70 x 12 ft), Banaras Hindu University (70 x 12 ft), and Geological Institute of India (70 x 25 ft) । প্রতিটা ম্যূরালের পিছনে তার অনেক ভাবনা ছিল, মূলত মানুষের কৃষ্টি জড়িয়ে।
Mural at the Hindu University, Varanasi, India
“Saga of Labor” Portion of the Mural at Mangla Dam – Largest mural in Pakistan
তার কাজের স্টাইল দেখলে মনে হয়না তিনি আর্ট নিয়ে পড়াশুনা করেছিলেন। অথচ তিনি শিল্পের ইতিহাস নিয়ে স্নাতক হন(1948, Graduated from Agra University in Art History)
১৯৫৪-৬০  কোয়েটা , Quetta, রেসিডেন্সি এবং করাচিতে প্রধানমন্ত্রী এইচ এস সোহরাওয়ার্দীর ( Prime Minister H. S. Suhrawardy’s residence)বাসভবন প্রদর্শনি হয়। ফ্রেই হল-এ জিন্নাহ সেন্ট্রাল হাসপাতাল, করাচি বিমানবন্দর, সার্ভিস ক্লাব এবং মঙ্গলা বাঁধ কমিটির কক্ষে মুরাল নির্মাণ হয়েছিল।
  • ১৯৬০, “তমঘা-ই-ইমতিয়াজ” (“Tamgha-e-Imtiaz”) পুরষ্কার এবং সমস্ত চিত্র পাকিস্তানের জাতীয় প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ প্লাস্টিক আর্টস এর ফ্রেঞ্চ কমিটির আমন্ত্রণে ফ্রান্স পরিদর্শন করেছেন এবং আন্তর্জাতিক সমালোচকদের জুরি কর্তৃক Laureate Biennale de Paris সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।
সাদেকাইন শিক্ষিত ও পরিশিলীত শিল্পী।  চমক দেওয়া তার পছন্দ নয়। তাই তিনি নিজের অধিক ছবিতে সই করতেননা। বা কেউ চাইলে তার ছবি বিনা পারিশ্রমিকে দিয়ে দিতেন। এই নয় যে তিনি খুব স্বচ্ছল ও তার টাকার দরকার নেই। তিনি গরীব ও নিম্নবিত্তের পরিবার থেকেই উঠে ন। জীবনে প্রচুর টাকা তার কাজের জন্য লোকে ও সরকার দিয়েছে কিন্তু মৃত্যুর সময় তিনি কপর্দকহীন। ভিখারী প্রায়। নির্ঝঞ্জাট মানুষ, বিয়ে থা করেননি, বা মহিলার সম্পর্শে দেখা যায়নি।
উল্টো দিকে মকবুল হোসেন। জেজে আর্ট স্কুলের শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারেননি, আর্থিক সমস্যায় রোজগারের পথে যান। এবং তরুন বয়েস থেকেই বেশ্যা সংগ শুরু করেন ছবি আঁকার জন্য মডেল হিসেবে এনে। অনেক প্রেমে পড়েন। তার প্রেমের ও যৌনতার অনেক গল্প আছে। তিনি যখন মারা যান তখন প্রায় দশ কোটি ডলার সঞ্চয় ছিল। আর পয়সার জন্য তার খুব চাহিদা না থাকলেও বিনা পয়সায় বিলাননি ছবি। হোটেলে , রেস্তোরাঁইয় থেকেছেন খেয়েছেন সেখানে খাওয়া থাকার বিনিময়ে ছবি একঁকে দিয়েছেন। লোকে তাতে অধিক খুশি কারণ তিনি বিখ্যাত শিল্পী আর তার ছবির মূল্য লাখ লাখ টাকা।

চলবে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।