গদ্যের পোডিয়ামে অরিজিৎ বাগচী

রায়পুর রাজ বাড়ি

বোলপুরের শান্তিনিকেতন কে কেন্দ্র করে
সাহিত্য বিলাসি ও হুজুগে বাঙালিদের উদ্দীপনার কোনো শেষ নেইও ।
এখানকার লালমাটির মনোরম পরিবেশ কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্প । এবং দিন দিন বেড়েই চলেছে মানুষের সমাগমও ।
কিন্তু প্রচুর মানুষ জানে না এই স্থানের সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত রয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমে ইলামবাজার যেতে বীরভূম জেলার এক ঐতিহাসিক গ্রাম রাইপুর। এই গ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের নানা ঘটনাবলী। বলা যেতে পারে রাইপুরে কালে কালে সৃষ্টি হয়েছে নানা ইতিহাস যার দরুন রাইপুর সকলের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। রাইপুরের নাম কিভাবে এল তা নিয়ে দুটি মত শোনা যায়।
● প্রথমত : পূর্বে অজয় নদীর তীরে অবস্থান ছিল আদমপুর, তবে অজয় নদের বন্যার ফলে মানুষজন আদমপুর ছেড়ে আরো উত্তর দিকে উঠে এসে বসতি স্থাপন করতে লাগল ।তৎকালে রায়চৌধুরীরা জমিদার ছিল বলেই নতুন গ্রামটির নাম হয় রায়পুর।
● দ্বিতীয়ত : লালচাঁদের বংশে বিশ্বম্ভর সিংহ বর্ধমানের রাজার থেকে ‘রায়’ খেতাব পাওয়ায়, আদমপুর পরবর্তীকালে ‘রায়পুর’ বা রাইপুর নামে পরিচিত হয়।
এখন প্রশ্ন হল কে এই লালচাঁদ, এর সাথে শান্তিনিকেতনের যোগসূত্র কোথায় ?
শোনা যায় , ১৭৬৪ সালে মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা হতে সিংহ পরিবারের আদিপুরুষ লালচাঁদ দে অজয় নদের তীরে রাইপুর গ্রামে আসেন, এবং অধুনা মা মঙ্গলচন্ডী বাড়ির নিকট বসতি স্থাপন করেন। ইনি একহাজার তাঁতি পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে বীরভূমে এসেছিলেন। পরে এই তাঁতি পরিবারগুলি বীরভূমের মির্জাপুর, চন্দনপুর, রাইপুর, সুখবাজার, সুরুল, সিয়ান প্রভৃতি গ্রামগুলিতে সমৃদ্ধি এনেছিল। সেই সময় চৌধুরীদের অবস্থার অবনতি হয়। ১৭৭০ সালে রাইপুর চৌধুরীদের নিকট হতে জমিদারী ক্রয় করে লালচাঁদ স্থানীয় জমিদার রূপে পরিগনিত হয়। লালচাঁদের তিন পুত্র ছিল পঞ্চানন, রামকিশোর ও শ্যামকিশোর। ১৭৭৩ সালে লালচাঁদ ৬০ বিঘা জমির উপর তিন ছেলের জন্য তিনটি মহল্লা বাড়ি তৈরি করেন। এগুলিতে মোট ১২০ টি ঘর ছিল।
লালচাঁদের কনিষ্ঠপুত্র শ্যামকিশোর তাঁতের ব্যবসায় প্রচুর মুনাফা করেছিলেন,পরবর্তীকালে রাজনগরের রাজার নিকট থেকে সমস্ত সম্পত্তি এবং শ্যামবাটি, ভুবনডাঙ্গা মৌজা কিনে নেন।
এখানে বলে রাখা ভালো যে বর্তমান শ্যামবাটি জায়গাটির নামকরণ তাঁর নামানুসারেই হয়েছিল। শ্যামকিশোরের চার পুত্র ছিলেন জগমোহন, ব্রজমোহন, ভুবনমোহন ও মনমোহন।জগমোহনের জ্যেষ্ঠপুত্র বিশ্বম্ভর খুব বুদ্ধিমান ও তেজস্বী পুরুষ ছিলেন। তিনি বর্ধমানের মহারাজা তিলকচাঁদ মহাতাভের দেওয়ান ছিলেন। তাঁর নামে প্রবাদ বচন চালু ছিল- ‘যাহা বিশ্বম্ভর, তাহাই রাইপুর।’ বর্ধমানের মহারাজ তাকে ‘রায়’ উপাধি দান করেন। সম্ভবত এই ‘রায়’ উপাধি হতেই গ্রামের নাম হয় ‘রায়পুর’ বা ‘রাইপুর’।
১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিভৃতে ঈশ্বরচিন্তা ও ধর্মালোচনার উদ্দেশ্যে ভুবনমোহন সিংহের কাছ থেকে দুটি ছাতিম গাছ সমেত কয়েক বিঘা জমি
হিজারা নিয়ে শান্তিনিকেতন নামে একটি অতিথিশালা স্থাপন করেন ।
এই বছরেই ২৪ শে মার্চ সিংহ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ,বীরভূমের গৌরব লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ, যিনি সবার কাছে লর্ড এস. পি. সিংহ নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন সিতিকন্ঠ সিংহের কনিষ্ঠ পুত্র। ১৮৬৩ সালের ২৪ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতার নাম মনোমোহিনী দেবী। তাঁর দরুনই আজ রাইপুর জমিদারবাড়ির এত নাম ডাক। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি বীরভূম জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। এবং বি.এ. পরীক্ষা না দিয়ে নরেন্দ্র প্রসন্নের সঙ্গে গোপনে ইংল্যান্ডে যান হেনরী আরস্কিনের সহায়তায়। তখনকার দিনে কালাপানি পার হওয়ার অপরাধে দুই ভাই জাতিচ্যুত হয়। পরবর্তীকালে গ্রামে ফিরলে জমিদার বাড়িতে প্রবেশ করার অধিকার তাঁর ক্ষুণ্ণ হয়। ১৮৮৬ সালে ‘লিঙ্কনস ইন’ থেকে ব্যারিস্টার পাস করে সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। সিতিকন্ঠ সিংহের নামধারী ‘রাইপুর সিতিকন্ঠ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয়’ আজও জ্ঞানের আলো বিতরণ করে চলেছে। এই বিদ্যালয়টি ১৯০২ সালে সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯১৫ সালের ২৭ শে ডিসেম্বর জাতীয় কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে স্যার সতেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ জাতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ও ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ হাউস্ অফ লডস্ এর সদস্য হিসাবে নিযুক্ত হন । এখানেই শেষ নয় ১৯২০ সালে বিহার-ঊড়িষ্যার গভর্নর পদেও তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন ।
কলকাতার এক্সাইড রোড থেকে একটু এগোলেই যে লড সিনহা রোড , তা এনার নামানুসারেই দেওয়া হয় । বেশিরভাগ মানুষই এ ব্যাপারে জানেন না ।
এত ভারি ইতিহাস থাকার পরেও রায় পুর জমিদার বাড়ি
দিন দিন কালের আলো আধারিতে তলিয়ে যাচ্ছে।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট , কিছু ইতিহাসের বই ও রায়পুরের কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলা ।
উৎসর্গ: কবি ও ইতিহাস প্রেমি
কৌশিক চক্রবর্তী দাদা কে ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।