ভূমিকা – বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুব পছন্দের একটি স্থান হলো বোলপুরের শান্তিনিকেতন। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় এটি অবস্থিত। মূলত শান্তিনিকেতন পরিচিতি বিশ্বকবির হাত ধরেই। তাই বোলপুরের শান্তিনিকেতন ঘিরে যেমন জড়িয়ে আছে বাঙালির রবীন্দ্রনাথ, ঠিক তার পাশাপাশি চোখ কাড়ে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। লাল মাটির রাস্তা, সবুজে ঘেরা চারিপাশ কিংবা হলুদ-সবুজ মিলিয়ে বিস্তীর্ণ ভূমি। হঠাৎ করেই যদি মনে দুদিন এর দোলা দিয়ে ওঠে, তার জন্য শান্তিনিকেতন কিন্তু এক অপূর্ব দর্শনীয় স্থান।
যাত্রাপথ – হাওড়া থেকে বর্ধমান হয়ে পূর্ব রেলপথের সাহেবগঞ্জ লুপ লাইনে ট্রেন যাচ্ছে ১৩৬ কিমি দূরের বোলপুরে। বোলপুরের ৩কিমি দূরে শান্তিনিকেতন। মোটামুটি ঘন্টা তিনেক এর জার্নি।
শান্তিনিকেতন – বোলপুর স্টেশন থেকে জয়দেব রোড ধরে ইলামবাজার যেতে সুপুর, রায়পুর, কাঁকুটিয়া ও দেউলির অবস্থান। রিকশা বা বাসে একে একে বেড়িয়ে নেওয়া যায়। ৪কিমি দূরে ইতিহাস ও কিংবদন্তির মিলনক্ষেত্র সুপুর। ইলামবাজার মুখী যে-কোনও বাসে শিবতলায় নেমে রাজা সুরথের তৈরি সুরথেশ্বর শিব মন্দির দেখে ৩কিমি পশ্চিমে শাক্ত ও বৈষ্ণবতীর্থ কাঁকুটিয়ায় বামাক্ষ্যাপার স্মৃতি বিজড়িত হাটপুকুর কালীবাড়ি ও লোচনদাস প্রতিষ্ঠিত মহাপ্রভুর মন্দির দেখে নেওয়া যায়। দ্বীপান্বিতা কালীপুজোর রাতে দূর-দুরান্ত থেকে ভক্তের দল আসেন। কাঁকুটিয়া গ্রাম পেরিয়ে অজয় নদের তীরে শৈবতীর্থ দেউলির খ্যাতি সুপ্রাচীন দেউলীশ্বর শিব মন্দিরের জন্য। হালকা গোলাপি রঙের মন্দিরের ডান দিকে বৈষ্ণব কবি লোচন দাসের সিদ্ধাসন। লোকমুখে প্রচারিত, এখনে বসেই চৈতন্য মঙ্গল রচনা করেন কবি। আর রায়পুরের জমিদার বাড়ি আজ দীর্ণ হলেও, লাগোয়া নারায়ণ মন্দির, গৌড়ীয় মঠ, গোপীনাথ ধর্মঠাকুরের গড় দেখে নেওয়া যায়। মার্কণ্ডেয় পুরাণে মেলে, ভাগ্য বিপর্যয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে দেবীর আরাধনায় হৃতসম্পদ ফিরে পেতে সুপুরের মহারাজা সুরথ লক্ষ্য বলি ভেট দেন দেবী চন্ডী(কালী) কে। সেই থেকে জায়গার নাম হয় বলিপুর। কালে কালে বোলপুর। দ্বিমতে সুপুরের অপভ্রংশ।
শান্তির স্বর্গ শান্তিনিকেতন। ১৮৬১তে রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদার এস পি সিনহার কাছ থেকে নিকডাঙায় ২০বিঘা জমি কিনে পরের বছর শান্তির নীড় গড়েন, নাম রাখেন শান্তিনিকেতন। কালে কালে বাড়ি থেকে জায়গার ও নাম হয় শান্তিনিকেতন। অবশেষে দেবেন্দ্রনাথ এর গড়ে তোলা আশ্রমটি ১৯০১র ২২শে ডিসেম্বর(৭ই পৌষ) রবীন্দ্রনাথের হাতে ৫টি ছাত্র নিয়ে রূপ পায় ব্রহ্মচর্যাশ্রমে। ১৮৭৩এ রবীন্দ্রনাথের প্রথম আগমন শান্তিনিকেতনে। ইটে গড়া বাড়িগুলি থেকে দূরে নীল আকাশের নীচে সেদিনের সেই ব্রহ্মচর্যাশ্রমটি আজ সারা বিশ্বে বন্দিত। পড়ুয়া আসছে দেশ দেশান্তর থেকে। ১৯২২এর ১৬ই মে গড়ে ওঠে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। এরও প্রশস্তি আজ দুনিয়া জুড়ে। বিশ্ব মিলেছে এখানে। জগৎসংসারের প্রতিটা বিষয় শিক্ষা দেওয়া হয়। আজও ক্লাস বসে শাল, বকুল, আম্রকুঞ্জের, ছায়ায় নীলাকাশের নীচে। সহশিক্ষার প্রথা চালু। আর রয়েছে দীর্ঘ চল্লিশ বছরের রবীন্দ্র-স্মৃতি শান্তিনিকেতনের আকাশে-বাতাসে।
শান্তিনিকেতনের মূল আকর্ষণ রবীন্দ্রনাথ এর শেষ জীবনের আবাস ‘উত্তরায়ান’। বেশ কয়েকটি ভবনের সমষ্টি উত্তরায়ান এর বিচিত্রা ভবনে বসেছে রবীন্দ্র মিউজিয়াম। ১৯১৩র নোবেল পুরস্কার টি চুরি যেতে প্রতিকৃতির সাথে পুরস্কার পাওয়া নানান পদক, কবির ব্যবহৃত চটি, জোব্বা, কলম, বসন-ভূষণ, ছবি, পাণ্ডুলিপি, প্রদর্শিত হয়েছে মিউজিয়ামে। ১৯১৫ তে নাইটহুড শিরোপা দেন কবিকে ব্রিটিশরাজ। তবে ১৯১৯র জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্যথিত রবীন্দ্রনাথ ফেরত দেন ব্রিটিশরাজের খেতাব। আর এক অংশে বসেছে গবেষণা কেন্দ্র। কবির ব্যবহৃত অস্টিন গাড়িটিও প্রদর্শিত হয়েছে চত্বরে। পাশেই রবীন্দ্র ভবন। আর রয়েছে রবীন্দ্র-পরিকল্পিত রবীন্দ্র-স্মৃতি বিজড়িত উদয়ন, কোনার্ক, শ্যামলী, পুনশ্চ, উদীচী। কবির স্বহস্তে রোপিত মালতীলতা আজও কোনার্ক এর সামনে শিরীষ গাছে স্মারক হয়ে বিকশিত। উদীচীর ডান দিকে গোলাপ বাগিচা। অদূরে স্টুডিও চিত্রভানু-সাধারণের কাছে দ্বার রুদ্ধ হলেও কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথের জন্মদিন ২৩শে নভেম্বর দর্শন মেলে। এছাড়া সড়ক পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে মহর্ষির সাধনবেদী ছাতিমতলা আর এক দ্রষ্টব্য। সপ্তপর্নী বৃক্ষের স্নিগ্ধ ছায়ায় শ্বেতমর্মরের বেদিতে বসে মহর্ষি লাভ করেছিলেন প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি। অদূরে ১৮৬৩তে তৈরি ব্রহ্মচর্যাশ্রম অর্থাৎ বর্ণময় কাচের উপাসনা মন্দির। মন্দিরের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য টুকরো রূপে কলকাতা থেকে এসে সম্পূর্ণতা পায় শান্তিনিকেতনে। আলপনাচর্চিত মর্মরের মেঝেয় আজও উপাসনা হয় প্রতিবুধবার প্রত্যুষে। বিপরীতে মহর্ষির আর এক স্মারক ১৮৬৪তে গড়া শান্তিনিকেতন গৃহ। কলাভবনে, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগণেন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসুর ম্যুরাল ও অঙ্গন জুড়ে রামকিঙ্কর বেইজের স্টুকো ভাস্কর্য, বিনোদবিহারী অঙ্কিত দেওয়ালচিত্রে সুশোভিত হিন্দী ভাষা সংস্কৃতির হিন্দী ভবন, নন্দলাল বসু চিত্রিত চীন ভবন এ প্রাচীন বৌদ্ধ জৈন পুঁথির সংগ্রহ, সংগীত ভবন, নন্দন-প্রদর্শশালা, মূল পাঠাগার ভবন। বহু বিচিত্রিত মূর্তি খোদিত কালোবাড়ি ছাত্রাবাস।
শান্তিনিকেতনের জন্মদিন ৭ই পৌষ (২২শে ডিসেম্বর, ১৯০১), উৎসব হয় জাঁকালো। মেলা বসে অন্তিম দিনে সকাল ৮:০০ টায় পরলোকগত আশ্রমবাসীদের স্মৃতিবাসর, দুপুরে হবিষ্যান্ন গ্রহণ, সাঁঝে আতশবাজির মেলায় আকাশ আলোকিত হয়ে ওঠে। এরই নাম পৌষমেলা। খুবই চমকপ্রদ এই পৌষমেলা, আজ জাতীয় উৎসব এর চেহারা নিয়েছে। দিনরাত ধরে বিকিকিনি চলে তাল পাতার বাঁশি থেকে কুমোরদের হাঁড়িকুড়ি। বিকোচ্ছে শ্রীনিকেতনের চর্মজাত ব্যাগ, মোড়া, মধুবনীর ছবি, ডোকরা শিল্প ছাড়াও গ্রামীণ পণ্যের নানান সম্ভার। বাউলেরাও আসে গ্রামগঞ্জ থেকে। একতারায় তান ধরে, গান গায় তিন দিন তিন রাত মেলার আসরে। আর ১৯২৫এ শুরু হয় ঋতুরাজ বসন্তে শান্তিনিকেতনের আর এক আকর্ষণীয় উৎসব “বসন্তৎসব”। বাসন্তীরঙা বসনে সবাই চলেছেন আম্রকুঞ্জে। প্রত্যূষ থেকে গানে গানে মুখরিত হয়ে ওঠে আকাশ বাতাস। ফাগ ওড়ে বাতাসে। নেচে গেয়ে বৈতালীকের দল চলে পুরাতন নন্দন ভবন থেকে গৌর প্রাঙ্গনে। দিনভর নানান অনুষ্ঠান। শ্রীনিকেতনের মাঘমেলায় জৌলুস কোমলেও, শ্রীনিকেতনের মেলার মাঠে কৃষি ও গ্রামীণ শিল্পের প্রদর্শনী সঙ্গে নানানধর্মী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আসর বসে ৩দিনের এই মাঘোৎসবে। এছাড়াও উৎসব আছে বর্ষশেষ, নববর্ষ, খ্রিস্টোৎসব শান্তিনিকেতনে। এছাড়াও বর্ষায় মাধুর্যের সঙ্গে রোম্যান্স বাড়ে শান্তিনিকেতনে।