• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে আরণ্যক বসু (পর্ব – ২৪)

রূপকথা পৃথিবীর

একদিকে পাড়া,শেষে ধানমাঠ,ঘরপোষা গাছপালা ;
রেললাইনের ধারে বসে বাঁশি বাজায় কৃষ্ণকালা।
আকাশ যেখানে প্রতিবেশী, আর বাতাসেও দেয় দোলা ,
উড়োজাহাজের শব্দ শোনাতো ঘরছাড়া হরবোলা !
দেখতে দেখতে কালীপুজোর দিনটা এসে গেল । আসলে, ঐদিনটার থেকে আগের দিনটাই আমার বেশি পছন্দ। তার কারণ, চোদ্দ শাক খাওয়া। আমার যে কী ভালো লাগে মাইরি,দিদি তোকে কী বলবো ? বাবা বেছে বেছে গ্রামের মাসীদের থেকে এই শাক কিনে আনে। দুপুরের ভাতের পাতে সে যেন এক অমৃতের স্বাদ। সঙ্গে নতুন ওঠা ফুলকপির তরকারি আর জলপাইয়ের চাটনি। আমাদের বাড়িতে আবার মাঝে মধ‍্যেই নিরামিষ খাওয়ার ঘটাপটা নেই ; কাজেই দুপুরের খাবার পাতে নিরামিষ দেখলে, ভুরু কোঁচকাতেই পারে। আজ কিন্তু গরম ভাতের সঙ্গে চোদ্দ শাক , গোল গোল বেগুন ভাজা, মুগের ডাল, আলু ফুলকপির ঝালঝাল রসা রসা যুগলবন্দী — বাজারে নতুন ওঠা কচি জলপাইয়ের চাটনি (যার টক মেরে মিস্টি আনতে চিনির কৌটো উজাড় হয়ে যায় ) দিয়ে খাওয়াটা দারুণ জমে গেল। বাকি দুপুরটা , বিভূতিভূষণের অপরাজিত শেষ করার পর , বুকের ভেতরটা যখন টনটন করছে , তারপর বিকেলের খেলার মাঠে , ছোটো বড়োরা মিলে কিছুক্ষণ ফুটবল নিয়ে দাপাদাপি করতে না করতেই, ওমা ! ধানমাঠের পুব দিগন্তে আকাশে কী বিশাল এক সোনার থালা ! বাড়ি ফিরে ধুলো পায়েই ঢুকে গেলাম , দিদির সঙ্গে মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে ভূতচতুর্দশীর অন্ধকার দূর করতে । বাবা-মা’র নির্দেশে আজ চোদ্দটা মাটির প্রদীপ জ্বালতে হবে , আগামীকাল মোমবাতি দিয়ে বাড়ি সাজাতে হবে । আজ আর পড়াশোনার বালাই নেই। দাদাও আজ আমাদের সঙ্গে আমোদে মেতেছে। মা বাড়ি ফেরার পরে বাবা এই দুদিনের মধ‍্যেই, কাঠকয়লা , সোরা ,গন্ধক,লোহাচুর মিশিয়ে বড়ো বড়ো মাটির খোলের মধ‍্যে দুহাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ঠেসে ঠেসে সুখের পেটমোটা ঘরবাড়ি বানিয়ে দিয়েছে। আমি বলেছি , সুখের ঘরবাড়ি না ছাই ! ধুত্তোর ,এতগুলো শরিক একসাথে গলা জড়াজড়ি করে থাকতে পারে ? এ সংসার , না জেলখানা ? বাবা অফিস থেকে ফিরে , কী করে যে এত এনার্জি পায় ,কে জানে ? আমার তো একটা তুবড়ি ঠাসতে গিয়েই বাঁ হাতে বুড়ো আঙুলের লাল আভা বলে দিচ্ছে , ফোসকা পড়লো বলে ! তাই দেখে মা যখনই আদর করে আমার দুহাতের বুড়ো আঙুলে বোরোলীন লাগিয়ে দিচ্ছে , তখনই রেডিও বিবিধ ভারতীতে কার যেন একটা মিস্টি গলা গেয়ে উঠলো — ত্বক যদি কেটে যায় ,ফেটে যায়,খসখসে যদি হয় , রোদ্দুরে ঝলসায় , সারা গায়ে মেখে নিন , সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম ,বোরোলীন…..
যে কোনো কারণেই হোক ,মা বাড়ি ফেরার পর , আমি একটু দূরে দূরে সরে থাকছি । কেন ? একটাই উত্তর —- ব‍্যস্ত ,ভীষণ ব‍্যস্ত । স্কুল খুললেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা , স্বপ্নে অঙ্ক আর ইংরিজি রোজ ঘুমের মধ‍্যে আঙুল তুলে শাসিয়ে বলে — ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে আগে আমাদের নিয়ে বসবি ।তারপর অন‍্য কথা । অঙ্ক বলে –আগে অঙ্ক , ইংরিজি বলে — আগে ইংরিজি । তারপর রোজ দুজনে হযবরল’র উদো আর বুদোর মতো , উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে মিলিয়ে যেতেই , বাবার বিখ্যাত টেবিল ক্লকটা ক‍্যারক‍্যার করে বেজে , আমার কলার ধরে তুলে দিয়ে বলে — ওঠ , পাঁচটা বাজে। তারপর দশটা পর্যন্ত চোখমুখ গুঁজে পড়া পড়া পড়া …
আমি এই ধেড়ে খোকা হয়েও সব সাবজেক্টের বইগুলোই নাড়াচাড়া করতে করতে ভাবি , কোনটা আগে, কোনটা পরে পড়বো ? পরীক্ষা মানে তো অকূল পাথার ! যাই হোক, বাংলা অঙ্ক ইংরিজি ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান পেরিয়ে , আমি যখন শ‍্যামলদের ছাতে পৌঁছোই , তখন আমাদের ছুঁচোবাজি তৈরির ক্লাবে , নরক গুলজার শুরু হয়ে গেছে । রাশি রাশি ছুঁচোবাজি গাঁথা শেষ করেই , দৌড়োচ্ছি বাজারের সামনে রাস্তায় ঢেলে সাজানো কালিপটকা , দোদোমা , চকলেট বোম আর রকেটবাজি কিনতে । ওগুলো আমাদের বাবারা কিছুতেই কিনে দেবে না। আহা ! বহু কষ্টে জমানো দশ বারোটা টাকা বাজি কেনার পিছনে মচমচ করে খরচ করতে কী যে ভালো লাগে মাইরি ! বাড়ি ফিরে কুয়ো থেকে ঝপাঝপ দুচার বালতি জল মাথায় ঢেলে , বাবার ভাষায় ‘কাকস্নান ‘ সেরে , ভাতের পাতে মন দেওয়া… তারপর , বাকি দুপুরটা পরীক্ষার পড়া করবো বলে বসে , আপাতত বিভূতিভূষণের অপরাজিত’র মধ‍্যে ডুবে থাকা। বিকেলে মাস্ট খেলা ,কেননা ভাইফোঁটার পরেই ধানমাঠ থেকে ফুটবলের ছুটি আর ক্রিকেটের অনুপ্রবেশ । আমি কানু বংশী আর শ‍্যামল পড়বো মুসকিলে। কমলদা নোটিশ ধরিয়ে দিয়েছে — এবছর শীতেও ফুটবল টুর্নামেন্ট আছে । হয়তো পাড়ার ছোটো মাঠে রবারের বলেই গা গরম করতে হবে। পুজোর ছুটির পর অ্যানুয়াল পরীক্ষা শুরু হলেই , ঠিক পরীক্ষার মধ‍্যেই ইডেন গার্ডেনে টেস্ট ম‍্যাচ শুরু হবে , আর অঙ্ক পরীক্ষার দিন, মায়ের হাতে দইয়ের ফোঁটা নিয়ে ,দুগ্গা দুগ্গা বলে বেরোনোর আগে (সেদিন দই কেন,রাবড়িও গলা দিয়ে নামে না অঙ্কের ভয়ে ) , তেত্রিশ কোটি দেবতাকে স্মরণ করতে করতে , রেডিওতে কলকাতা ক নাকি খ থেকে মনপ্রাণ জুড়িয়ে অজয় বসুর ম‍্যাজিক কন্ঠস্বরে ,পরীক্ষার জন‍্য উন্মুখ পা দুটো ঘরের মধ্যেই আটকে যাবে !
ভগবান ! জাস্ট পাঁচ মিনিট শুনেই রেডিও বন্ধ করে দেবো। অজয় বসু বলছেন — নমস্কার, ক্রিকেটের নন্দনকানন ইডেন উদ্যান থেকে অজয় বসু বলছি । আমার সঙ্গে রয়েছেন , কমল ভট্টাচার্য ও পুষ্পেন সরকার। আর বিশেষজ্ঞের মতামত দেওয়ার জন‍্য এসেছেন ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেট নক্ষত্র ,পঙ্কজ রায় । টসে জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথমে ব‍্যাট করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে… ভগবান , আর দু মিনিট…. সাজানো ফিল্ডিং এই রকম — স্লিপে তিনজন ,গালি , পয়েন্ট–একটু বাউন্ডারি ঘেঁষে , মিড অন , মিড অফ , স্কোয়ার লেগ , সট স্কোয়ার লেগ , আর ডী……প ফাইন লেগে একজন ফিল্ডার। হাইকোর্ট প্রান্ত থেকে , দিনের প্রথম বল শুরু করবার জন‍্য প্রস্তুত হয়েছেন , রমাকান্ত দেশাই । উইকেটের ওপর এসেছেন , বল করেছেন, গুড লেংথ বল ….দিনের প্রথম বলটি যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে ব‍্যাকফুটে খেললেন — ওপেনার বেসিল বুচার। ননস্ট্রাইকার প্রান্তে দাঁড়িয়ে তারিফ জানালেন আর একজন খ‍্যাতনামা ওপেনার করনাড হান্ট । গালি থেকে ছুটে এসে , অধিনায়ক পতৌদি নবাব লাল টুকটুকে সেই বলটাকে দুধ সাদা প‍্যান্টে দু তিনবার ঘষে , ছোটোখাটো চেহারার বোলার , রমাকান্ত দেশাইয়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে দুবার পিঠ চাপড়ে দিলেন । ইডেনের গ‍্যালারি আলো করে মাঠে এখনো অসংখ্য লোক ঢুকছেন । গ‍্যালারিতে যেন সূর্যের সাত রঙের ঢেউ নেমেছে। ইতিমধ্যেই , একজনের হাতের আয়না থেকে সূর্যের আলো ঠিকরে গিয়ে বেসিল বুচারের মুখে পড়ায় , ব‍্যাটসম‍্যান বিব্রত হলেন । আচ্ছা কমলদা , এটা কিন্তু কোলকাতার ক্রিকেট-পাগল দর্শকদের কাছ থেকে একেবারেই আশা করা যায় না; আপনি কিছু বলুন– তুমি ঠিকই বলেছো অজয়–কমলদার কণ্ঠ গমগম করে উঠতেই , আমি রেডিও বন্ধ করে দৌড় মারবো অঙ্ক পরীক্ষার হলের দিকে ।
সে তো পরের গল্প ।
আপাতত এই ভূত চতুর্দশীর সন্ধ্যায় কালীপটকা ধানীপটকা দোদোমার টুকটাক খুচরো আওয়াজের রিহার্সালের মধ‍্যেই , বাড়ির মাটির প্রদীপগুলো দুলে দুলে আমাদের নিস্তেজ অবসন্ন মাকে গান শোনাবার অনুরোধ করছে । কাল কালীপুজোর দিন আমাদের লক্ষ্মীপুজো ।বাবা সকালেই সব বাজার সেরে রেখেছে । তবু টুকটাক কিছু কিনতে যাবে বলে রেডি হচ্ছিল । মা হঠাৎ খাটের উপর হারমোনিয়ামটা টেনে , একটু কমজোরী গলাতেও অপূর্ব সুর লাগিয়ে গেয়ে উঠলো — আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ যদি নাইবা জ্বলে , কন্ঠমালার বকুল যদি যায় গো ঝরে ….
ওগো প্রিয় ,ওগো প্রিয় ,জাগবো বাসর শূন‍্য শয্যা পাতি , আমার বিফল রাতি…..
বাবা ব‍্যাগ রেখে খাটের এককোণে বসে বললো– ওগো শুনছো , তুমি আর এই শরীর নিয়ে গানের রেওয়াজে বোসো না।ওগুলো কিছুদিন পরে হলেও চলবে । মার চোখে সেই পুরোনো দুষ্টুমির ঝিলিক যেন দেওয়ালি আলোর মতোই বাবাকে চমকে দিয়ে বললো — মন থেকে বলছো তো ? সত‍্যিই বলছো তো ? বাবার অস্বস্তির কাশিটা আমরা শুনতে পেলাম , আর মঙ্গলাদি শুনলো — ও মঙ্গলা , একটু চা খাওয়াবে ? তারপরেই না হয় বাজার যাই….
আমাদের লক্ষ্মীপুজো , মানে কালীপুজোর দিন বিকেলে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। পথ হারানো একটা অপূর্ব সুন্দর টিয়াপাখি , হঠাৎ জানলা গলে এসে , মায়ের লক্ষ্মীর আসনে বসে টুকটুকে লাল ঠোঁট আর আশ্চর্য সবুজ শরীরটাকে বেঁকিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের মাপতে লাগলো । কিন্তু উড়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করলো না । যেন — এই তোরা কেমন আছিস দেখতে এলাম গোছের ভাব ( কৃতজ্ঞতা স্বীকার : আগাপাশতালা বাবার কথা )। পুরোহিত মশাই তখনও আসেননি । কিছুতেই কথা না শুনে , সারাদিন উপবাস করা মা দিদি যেন একসঙ্গেই বলে উঠলো — পাখিটা থাক আমাদের বাড়িতে । আর ছোটোবেলা থেকে এই পর্যন্ত ভ‍্যাবাগঙ্গারাম আমি , সেই মুহূর্তে একটা দারুণ স্মার্ট কাজ করে ফেললাম । এক ছুটে অমিতদের বাড়ি থেকে ওদের জঙ ধরা শূন‍্য খাঁচাটা নিয়ে এসে , কুয়োর জলে ধুয়ে মুছে , নিচে খবরের কাগজ পেতে , মায়ের নৈবেদ্যর থালা থেকে একমুঠো ছোলাসেদ্ধ নিয়ে খাঁচার একদিকের বাটিতে রাখতেই , দিদি ছুটে রান্নাঘর থেকে গেলাসে করে খাবার জল এনে অন‍্যদিকের বাটিতে ঢেলে দিলো। মা বললো — ও শিখা , তরকারির ঝুড়িতে দ‍্যাখ ,পাকা লাললঙ্কা আছে । ছোলার পাশে রেখে দে , টিয়াপাখি খুব ভালো খায় । এইবার আমার হাতযশ । খেলার মাঠে বর্ষাকালে মাঠের মধ‍্যে হঠাৎ ঢুকে পড়া ঢোঁড়া বা হেলে সাপের ল‍্যাজ ধরে দুবার ঘুরিয়ে মাঠের বাইরে ছুঁড়ে দেবার মতো , সহজ ভেবেছিলাম টিয়াপাখি ধরার কাজটাকে । সঙ্গে সঙ্গে টিয়াটা আমার হাতে দুটো সলিড ঠোক্কর মেরে , যেন মানুষের মতো বলতে চাইল — খবরদার গায়ে হাত দিবি না ! আমি নিজে নিজেই ঢুকবো । গুটিগুটি খাঁচার দিকে এগোতে লাগলো , আর কি অদ্ভুত , ঢুকেও গেল ! বাবা খাঁচাটা বন্ধ করে , আমাদের লম্বা করিডোরে, কাপড় মেলার লোহার তারে ঝুলিয়ে দিলো। সেখান থেকেই ভারত সম্রাট শাজাহানের মত টিয়া পাখিটা , ঘুরে ঘুরে পুজোর আয়োজন দেখতে লাগলো ,আর নিজের থাকার জায়গাটা ভালো করে দেখে নিলো , সব ঠিকঠাক আছে কিনা। তারপর মন লাগিয়ে , ঠ‍্যাং আর ঠোঁট দিয়ে পাকা লঙ্কা খেতে শুরু করলো । ব্যস ! আমাদের বাড়ির সদস্যসংখ্যা পাঁচ থেকে ছয়ে চলে গেল। আমার হাতের জন্য তখন ডেটল তুলো, ব্যান্ডেজ — সড়কি লাও , বন্দুক লাও অবস্থা। আর আমি ভাবছি , ছড়া ছড়া কালীপটকা যে , হাতে ধরেই ফাটাই , সেটা এবারে পারবো তো ?
কালীপুজোর বাজির আমেজ মিলোতে না মিলোতেই , ভাইফোঁটার সকাল এসে পড়লো। এবার পাঁচ মামা এসেছে , প্রিয় বড়দির সঙ্গে একটা সারাদিন কাটাতে। সুস্থ হয়ে যাওয়া বড়দি , স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া বড়দি , গান গেয়ে ওঠা বড়দি । মণিমামা ঢুকেই বললো — বড়দি , তোকে পুজোর সময় খুব মিস করেছি রে ! কত নতুন গান তুলেছি — তোকে তো শোনানোই হল না । মা’র মুখে প্রিয় ভাইদের দেখে সেই পাগল পাগল উচ্ছ্বাসটা কেউ যেন ব্লটিং পেপার দিয়ে শুষে নিয়েছে । ম্লান হাসিতে যেন এই কথাটাই লেখা আছে — কতদিন পর নতুন চোখে যেন দেখছি তোদের ! বড্ড অত্যাচার করেছি রে । আমাকে সামলাতে তোদের কালঘাম ছুটে গেছে । ঝন্টুটার পড়াশোনাটাও সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে । তোদেরও সংসার জীবনে কত দুর্বিপাক নেমে এসেছে । তবু তোরা আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছিস। আয় ,আমার সোনার ভাইরা — তোরা দু’মুঠো অন্ন গ্রহণ করলে আমার হাসপাতাল থেকে ফিরে আসাটা সার্থক হবে। গান না হয় নাই গাইতে পারলাম , এবারে– দুলাল ,মণি , তোদের গান শুনবো। মা এই কথাগুলো একটাও কিন্তু বলেনি — সবটাই আমি মনে মনে ভাবলাম। মা শুধু মায়ের কথা বলা চোখ দিয়ে বলেছিলো — আমি বুঝতে পেরেছিলাম । আমার মায়ের মতোই অনুভূতিপ্রবণ আমাদের পাঁচ-পাঁচটা দারুণ দারুণ সুন্দর মামা — মা যাদের ডাকে — খোকন গোপাল দুলাল মণি আর মন্টু বলে। আমি কোন কিছুই না বুঝে আনন্দে চিৎকার করে বললাম — মা , তুমি দেখে নিও , আমার পড়াশোনা একটুও নষ্ট হয়নি । অ্যানুয়াল পরীক্ষায় যদি অঙ্কে ছিয়ানব্বইয়ের কম পেয়েছি , তবে পাড়ার কালু কুকুরটাকে তুমি আমার নামে ডাকবে , ঝন্টু ঝন্টু বলে । মা অবাক হয়ে বললো — এসব আমি কখন বললাম ? আমার গম্ভীর উত্তর –আমি সব বুঝি , আমার পড়া নষ্ট হচ্ছে বলে তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছিলে কাল । অঙ্কে একশো পাবো না ,ইশকুলে ওটা দাদার জন্যেই তোলা ছিলো; আমি কিন্তু …….
এবার একটু ঢোক গিলে বললাম — আচ্ছা ছিয়ানব্বই না হলেও উননব্বই তো পাবোই– এই তোমাকে ছুঁয়ে বলছি…
দিদি আমার গোঁৎ খাওয়ার সুযোগটা নিয়ে সলিড খোঁচা দিয়ে বললো — ও বাবা, তোমার ছোটো পুত্তুরের ঘুড়িটা যে ,অলরেডি লাট খেতে শুরু করেছে। আমি চিৎকার করে কিছু বলতে যেতেই ,দাদা বক ধার্মিকের মতো মাথা নেড়ে বললো — এই শিখা, সাবধান, সাঁকোকে কখনও পাগল নাড়াতে বলতে নেই ।
আমি হেসে উঠতে গিয়েও থমকে গেলাম।দাদার মুখের ওই ‘পাগল’ শব্দটা ততক্ষণে আমার বুকের মধ‍্যে তীরের মতো গেঁথে গেছে।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।