ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে আরণ্যক বসু (পর্ব – ৪)

রূপকথা পৃথিবীর – ৪

সব্বাই যদি গাইতে পারতো বেঁচে উঠবার গান
সব্বাই যদি মনের কথাটা সুরে সুরে দিত ব়েঁধে
সব্বাই যদি মৃত পাখিদের বুকে ভরে দিত প্রাণ
খিদের থালার একপাশে দিত ইলিশ মাছটি রেঁধে !
কমলদার সাইকেলে বেশ একটা মাতব্বর মাতব্বর ভাব করে পাড়াতে ঢুকে গেলাম । রাস্তার আলো জ্বলে গেছে আজ। আমি জানি , এতক্ষণে মণিমামা বাড়িতে ঢুকে গেছে। তার মানে , আজকে বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব। বাড়ি ঢুকে কাউকে তেমন পাত্তা না দিয়ে, কুয়োতলায়় গিয়ে ঝপাঝপ চার বালতি জল ঢেলে, লক্ষ্মীপুজোর ড্রেস পরে শান্তশিষ্ট হয়ে , মা’র কুরুশ কাঁটায় বোনা আসনে বসে পড়ে , দুলে দুলে লক্ষ্মীর পাঁচালী পাঠ করতে শুরু করলাম ।অনুভবে বুঝলাম ,চারপাশে বেশ একটা ভিড় জমে গেছে । ভিড় মানে তেমন কিছু জনসমাগম নয় । দিদি আর মা তো আছেই , তার সঙ্গে মণিমামা আর শিবপুর বি ই কলেজ থেকে হঠাৎ চলে আসা , আরে আমার ডার্লিং দাদা যে ! শনিবার বিকেলে আসার কথা। নিশ্চয়ই কোন একটা বিশেষ কারণে চলে এসেছে ।যাক, ওসব দিকে মন দেওয়ার সময় এখন আমার নয়। এমনকি মণিমামা যে জামাকাপড়ের প্যাকেটগুলো এনেছে, সেগুলোও দেখিনি এখনও পর্যন্ত । আমার লক্ষ‍্য এখন পুজোর ফল মিষ্টির দিকে । তাই অভ্যস্ত গলায় প্রতি সপ্তাহে যেমন লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়ি ,তেমনই পড়ে যাওয়া আর কি । মাথার মধ্যে কিন্তু গুনগুন করছে শ্যামল মিত্রের গান — কি নামে ডেকে বলবো তোমাকে ….
আচ্ছা , এতগুলো ব্যাপারে কি একসঙ্গে মন দেওয়া যায় ? ভাগ্যিস লক্ষ্মীর পাঁচালীটা খুব তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেললাম ! এ সময় আমার একটা ছোট ভাই বা বোনের অভাব খুব টের পাই । তার ওপর বেশ দাদাগিরি করা যেত। লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়তে হুকুম করতাম — ওই যে কবিতাটা আছে না ,কার যেন, কার যেন — ও মনে পড়েছে , প্রেমেন্দ্র মিত্রের — আমায় যদি হঠাৎ কোনো ছলে, কেউ করে দেয় আজকে রাতের রাজা, করি গোটা কয়েক আইন জারি , দু-একজনায়
খুব কষে দিই সাজা ।
‘সাজা’ ব্যাপারটা দিদির ওপরে সবার আগে চালাতাম। কী সাহস ! সবসময় আমার উপর খবরদারি করে ! মাত্র তো প়াঁচ বছরের বড় । নেহাত আমাকে খুব ভালোবাসে ।তাই কিছু বলিনা ।যাইহোক,পুজো শেষ করে জামা প্যান্ট বদলে , মায়ের দেওয়া চা জলখাবার আর প্রসাদ নিয়ে থিতু হয়ে বসতেই , হঠাৎ দেখি বাবা এসে হাজির ! কি মজা ! বাবাকে সবার আগে দিলাম আজকের সেমিফাইনালের রেজাল্ট — আমরা দারুণ জিতেছি । আমার দুটো গোলের কথা বললাম , কিন্তু বেমালুম চেপে গেলাম দশটা মিস করার কথা ।বাবা পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল — সাবাস ঝন্টু মহারাজ । ফাইনালটাও জিততে হবে কিন্তু । কবে যেন ! মহালয়ার দিন ! তাই না ? দেখি ,পারলে যাবো। কেলেঙ্কারি করেছে রে , মনে মনে ভাবলাম।দর্শকের মধ‍্যে বাবাকে দেখলে আমি তো চুপসে ফুটো বেলুন হয়ে যাবো !আমি একটা গোল করলে তিনটে যে মিস করি , তা তো বাবার জানা নেই ! একে ছোট মাঠ ,তার ওপরে বাবার দাবড়ানি কানে এলেই….
হঠাৎ দেখি, বাবার হাতে বেশ বড়সড় একটা ইলিশ মাছ। মুখে মাথায় আর ল‍্যাজায় দড়ি বেঁধে এমনভাবে ঝুলিয়ে এনেছে , যেন মনে হচ্ছে ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে বাবা বাড়ি ফিরল । মা খুব খুশি, কারণ গায়ক ভাইকে আজকে গুছিয়ে ইলিশ ভাপা , ইলিশ মাছ ভাজা আর মাছের তেল খাওয়াবে ।আমি জানি এক্ষুনি মায়ের প্রিয় চকলেট রঙের হারমোনিয়াম নিজেই গুনগুন করে উঠবে –রবীন্দ্রসংগীত, অতুলপ্রসাদ , ডি এল রায় , রজনীকান্ত আর বাংলা আধুনিক গান , সিনেমার গানে গানে ।
মণিমামা হয়তো দু একটা হিন্দি গানও শোনাতে পারে । হঠাৎ মনে পড়ল , শনিবার আমার স্কুলে অঙ্ক পরীক্ষা ! পুজোর আগে শেষ হার্ডল( দাদা বলে – হাড় হিম করা গাঁট )। অঙ্কটা ঠিকমতো জুত করে প্র‍্যাকটিস করা হয়নি । আর করা হবেই বা কী করে ? প্রত্যেকদিন স্কুলের শেষে যদি ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে যেতে হয় ,তাহলে দাদার মতো স্টুডেন্ট হব কি করে আমি ? অথচ , কথায় কথায় দাদার সঙ্গে আমার তুলনা করবে সবাই। ইস্কুলেও আর বাড়িতেও । আমি বেচারা কি যে করি ! যাইহোক , কিছুক্ষণ অঙ্ক নিয়ে বসার ভান করলাম । দাদাকে চুপি চুপি ডেকে কঠিন অঙ্কগুলো একটু দেখে নেওয়ার চেষ্টা চালালাম । দিদিও বই নিয়ে বসে পড়ার ভান করে যাচ্ছে, কিন্তু কান পাশের ঘরে। সেখানে মৃদুস্বরে হলেও গানের গুনগুনানি ।একটু পরেই পড়া কোনোরকমে শেষ করে ওই জগতের মধ্যে ঢুকে যাবো আর সবাইকে চমকে দিয়ে একটা আনকোরা নতুন গান শুনিয়ে দেবো । জানিনা আমার মা আর মণিমামা, গায়ক-গায়িকা ভাইবোন আমাকে কতটা পাত্তা দেবে ! কিন্তু আমি শোনাবোই । খেলার মাঠ আজকে আমাকে একটা দারুণ উপহার দিয়েছে ।এমনিতেই শ্যামল মিত্রের গান আমার খুব ভালো লাগে । যাইহোক, আমি সবার আগে পুজোর জামা কাপড় দেখে আর প্রায় দেড় মিনিট ধরে গন্ধ শুঁকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখলাম। দক্ষিণ কলকাতার বেশ অভিজাত বস্ত্রালয় থেকে কেনা আমার প্যান্ট আর শার্ট , দিদির হালফ্যাশনের ফ্রক, দাদার জন্য টি শার্ট , মায়ের জন্য শাড়ি আর বাবার জন‍্য ফিনলের ধুতি। সবাই খুশি। মা খাটের উপর বিছিয়ে দিয়েছে মুড়ি পেঁয়াজি আর গরম গরম চা । সবাই আমার কাছে শুনতে চায় আজকের খেলার মাঠের কথা। আমি ইতিমধ্যেই দিদির কাছে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে অভিজ্ঞতাটা বলে দিয়েছি , আর মিনমিন করে শুনিয়ে দিয়েছি শ‍্যামল মিত্রের গানটা — কি নামে ডেকে,বলবো তোমাকে , মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে….
হাফটাইম শেষ হতে না হতেই এই গানটা আমি পুরো তুলে নিয়েছিলাম।আর সেই জন‍্যেই তো খেলার ফার্স্ট হাফে ধ‍্যাড়ালেও , ওই গানের ছন্দে সেকেন্ড হাফে গুণে গুণে দুটো গোল মেরে দিয়েছি । হুঁহুঁ বাবা , আমার বাড়িতে বাবার ফুটবলও আছে আর মায়ের গানও আছে …
ওরে আমায় কে আর পায় !

ক্রমশ..

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।