সাপ্তাহিক ধারাবাহিক ঐতিহ্যে “কলকাতার চার্চ (কোম্পানীর যুগ)” (পর্ব – ১১) – লিখেছেন অরুণিতা চন্দ্র

আগের পর্বগুলিতে মহানগরীর চার্চগুলির সাথে শিক্ষার প্রসারের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। সেই সূত্র ধরেই দেশীয় দের মধ্যে পশ্চিমি শিক্ষার বিস্তারের সাথে জড়িত ছিল ক্রাইস্ট চার্চের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। আর এর সাথেই জড়িয়ে উনিশ শতকের নবজাগরণের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ডিরোজিওর শিষ্য রেভারেন্ড কৃষ্ণমহন ব্যানার্জির নাম।১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে আলেকজান্ডার ডাফ কর্তৃক কৃষ্ণমোহন ব্যাপটাইজড হন। ইতিপূর্বেই তিনি তাঁর বাড়িতে থাকা বন্ধুদের এক নিছক রসিকতার জন্য প্রতিবেশী দের বিরাগভাজন হয়ে পরিবার কর্তৃক বিতাড়িত হন। তার ফলে তাঁকে তাঁর বিধবা মা ও ভাইবোনদের ত্যাগ করতে বাধ্য হতে হয়। পরে তিনি এই বিষয়ে ইংরেজিতে ‘The Persecuted’ নামে এক ছোট্ট নাটিকা ও লেখেন। তাঁর ধর্মান্তর তদানীন্তন হিন্দু বাঙালি সমাজে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কৃষ্ণমোহন স্কটিশ ও আংলিক্যান উভয় চার্চেই প্রার্থনাসভায় যোগদান করতেন। তাঁর স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্বের কারণে রেভারেন্ড ডাফের সাথে তাঁর মতানৈক্য উপস্থিত হয়। ফলে কৃষ্ণমোহন ফ্রি চার্চের সংস্পর্শ চিরতরে ত্যাগ করেন।১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ থেকেই কৃষ্ণমোহন চার্চ মিশনারী সোসাইটির সাথে যুক্ত ছিলেন এবং বিশপ কলেজে থিওলজি পাঠ করছিলেন। এভাবেই তিনি লাতিন, গ্রীক আর হিব্রুতে গভীর জ্ঞানলাভ করেন। ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে বিশপ উইলসনের অনুমতিলাভ করে তিনি চার্চ মিনিস্ট্রিতে যোগ দেন।
১৮০২ খ্রিষ্টাব্দে মিশন চার্চের সাথে সম্পর্কিত এক ইভ্যাঞ্জেলিকাল সোসাইটির জন্য ডেভিড ব্রাউন এক ফান্ড গঠন করেছিলেন। ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা দেশীয় এলাকায় একটি চার্চ গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। এর জন্য কলেজ স্কোয়ারের কাছে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে একটি জমি ক্রয় করা হয়। সেসময় কৃষ্ণমোহন চার্চ মিশনারী সোসাইটির স্কুল ইন্সপেক্টর পদে যুক্ত ছিলেন। স্থির হয়ে ৭ ই জুলাই ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর হাতে ৩৩, রাজা রামমোহন সরণীতে চার্চের শিল্যান্যাস হবে। কিন্তু হিন্দু কলেজের কর্তৃপক্ষ আপত্তি করেন যে তাঁর ডিরোজিয়ান অতীত হিন্দু কলেজের ছাত্র ও অভিভাবকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। তাই তাঁরা কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন শিল্যান্যাস স্থগিত করে চার্চটি অন্যত্র স্থানান্তরের জন্য। বিশপ তখন এক মাসের মধ্যে কলেজ স্কোয়ার থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বের কোন স্থান চয়নের নির্দেশ দেন। এভাবে কর্ণওয়ালিস স্কোয়ার বা আজাদ হিন্দ বাগ অর্থাৎ বর্তমান হেদুয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি এলাকা চার্চের জন্য নির্বাচিত হয় । চার্চ কমিটিকে ১৮০০ টাকা এর জন্য দিতে হয়। ১৮৩৮ এর নভেম্বরে চার্চের শিল্যান্যাস হয় ও ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে চার্চের নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়।
ক্রাইস্ট চার্চটি গথিক স্থাপত্যে নির্মিত ছিল। এর শিখরটি ছিল ৫০ ফুট উঁচু। ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে বিশপ উইলসন চার্চের পবিত্রতা কার্য সম্পাদন করেন। কৃষ্ণমোহন চার্চের মিনিস্টার পদে নিযুক্ত হয়ে ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চার্চের দায়িত্ব নির্বাহ করেন বিশপ কলেজের অধ্যাপক হিসাবে যোগদানের আগে পর্যন্ত। তাই ক্রাইস্ট চার্চ কৃষ্ণ বন্দ্যর চার্চ নামেই পরিচিত ছিল।মির্জাপুরে যে চার্চ মিশনারী সোসাইটির স্কুলের সাথে কৃষ্ণমোহন জড়িত ছিলেন তাই পরে St. Paul’s School and College নামে পরিচিত হয়।
ক্রাইস্ট চার্চ বিশেষ কোন শৈল্পিক সজ্জা দ্বারা অলঙ্কৃত ছিল না। চার্চের দেওয়ালে সংরক্ষিত স্মৃতিফলকের মধ্যে অন্যতম ছিল কৃষ্ণমোহনের বন্ধু ও আরেক বিখ্যাত ধর্মান্তরিত ডিরোজিয়ান অকালমৃত মহেশচন্দ্র ঘোষের স্মৃতির উদ্দেশ্যে রক্ষিত স্মৃতিফলকটি। এছাড়া এছাড়া Colsworthy Grant এর অঙ্কিত কৃষ্ণমোহনের প্রতিকৃতির একটি নকল ও সেখানে সংরক্ষিত। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে চার্চটি বর্তমান রূপ পায়।চার্চের হলটি নার্সিং শিক্ষার জন্য ব্যবহার হত। কৃষ্ণমোহন নিজেও তাঁর বাসগৃহে অল্পবয়স্ক ধর্মান্তরিত ও বিতাড়িত খ্রিস্টান তরুণদের শিক্ষা দিতেন।
বর্তমানে এক ঐতিহাসিক স্থাপত্য রূপে ক্রাইস্ট চার্চ মহানগরীর শতাব্দী প্রাচীন বহুত্ববাদী সংস্কৃতির সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।