সাপ্তাহিক ধারাবাহিক ঐতিহ্যে “কলকাতার চার্চ (কোম্পানীর যুগ)” (পর্ব – ১৩) – লিখেছেন অরুণিতা চন্দ্র

কলকাতার চার্চ (কোম্পানীর আমল) – পর্ব ১৩

আগের পর্বগুলিতে ইংরেজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে কলকাতায় নির্মিত প্রোটেস্টান্ট চার্চগুলির কথা আলোচনার পর এবার কোম্পানি আমলের মহানগরীর ক্যাথলিক চার্চগুলির কথা আলোচ্য। এই বিষয়ে প্রথমেই আসে পর্তুগীজ চার্চটির কথা যার নাম Cathedral of the Most Holy Rosary. কলকাতার সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল যেমন প্রোটেস্টান্ট দের তেমনি এই পর্তুগীজ চার্চ রোমান ক্যাথলিকদের ক্যাথিড্রাল।
ইংরেজদের আগমনের বহু পূর্বেই পর্তুগীজরা বাংলায় বাণিজ্যিক কার্যকলাপের সূত্রপাত ঘটায় এবং হুগলীতে তাদের কর্মস্থল স্থাপন করে। ইউরোপীয়দের মধ্যে তারাই প্রথম ভারতীয় মহিলাদের বিবাহ করতে শুরু করে এবং এই বিবাহজাত সন্তানদের থেকে সৃষ্টি হয় এক মিশ্র জাতি যাদেরকে বলা হত Kintal। সপ্তদশ শতকের শেষ পর্বে কলকাতার প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে হুগলীর গুরুত্ব হ্রাস পায়, ফলে পর্তুগীজরা কলকাতায় আসতে থাকে। ফলে কলকাতায় পর্তুগীজ বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের স্থায়ী বাসস্থান গড়ে উঠতে থাকে। অষ্টাদশ শতকের সূচনায় কোম্পানী গঙ্গার তীরে একটি সংরক্ষিত স্থানে তাদের বসতিস্থাপনের অধিকার দেয়। কলকাতায় তারাই প্রথম ও একমাত্র মুরগীপালন ও ক্রয়বিক্রয় করত, তাই এই অঞ্চলের নাম হয় মুর্গিহাটা। এই মুর্গিহাটাতেই পর্তুগীজ রোমান ক্যাথলিক অগাস্টানিয়ান মিশনারীগণ প্রথমে একটি কুঁড়েঘরে প্রার্থনকক্ষ স্থাপন করে। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানীর অনুমতিক্রমে প্রার্থনাকক্ষটি ইষ্টক নির্মিত স্থায়ী গির্জায় পরিণত হয়। ১৭২০ খ্রিষ্টাব্দে Mrs. Sibestian Shaw নামক এক ধনী মহিলার অর্থানুকূল্যে চার্চটির পরিধি বৃদ্ধি পায়। ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে নবাব সিরাজ-উদ-দুল্লার কলকাতা আক্রমনে কোম্পানীর অফিসিয়াল সেন্ট আনে চার্চটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে পলাশী পরবর্তীকালে কলকাতা পুনরুদ্ধারের পর রবার্ট ক্লাইভ ও ওয়াটসনের শাসনে কোম্পানী পর্তুগীজ চার্চটিকে কোম্পানীর কর্মচারীদের প্রার্থনার জন্য অধিগ্রহণ করে। অর্থায় অস্থায়ীভাবে মহানগরীর প্রথম ক্যাথলিক গীর্জাটি পরিণত হয় প্রোটেস্টান্ট প্রার্থনাস্থলে। তিন বছর পর ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চার্চটি পুনরায় কলকাতার ক্যাথলিক জনগণকে প্রত্যর্পণ করা হয়। ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ইউরেশীয় (পর্তুগীজ-ভারতীয়) অধিবাসীরা একটু নতুন চার্চ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলে পূর্বতন চার্চটির পরিসমাপ্তি ঘটে।
১৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই মার্চ ১৫, পর্তুগীজ চার্চ স্ট্রীট ঠিকানায় নতুন চার্চটির শিল্যান্যাস হয়। ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে নভেম্বর এটি উৎসর্গীকৃত হয় Virgin Mary of Rosary-র নামে। চার্চের স্থপতি ছিলেন Thomas Cyrus Driver যিনি চার্চের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবার পূর্বেই প্রয়াত হন। চার্চ নির্মাণের খরচ পড়েছিল ৯০,০০০ টাকা। এর এক তৃতীয়াংশ জনগণের অনুদান এবং চার্চের নিজস্ব আয় থেকে সংগৃহীত হয় আর বাকী সিংহভাগ অর্থদান করেন জোসেফ ও লুইস ব্যারেটো নামক কলকাতার সর্বাপেক্ষা ধনবান পর্তুগীজ পরিবারের দুই ভাই যাঁরা সেসময়ের বিখ্যাত ব্যাংকার ছিলেন এই পরিবারের দুই সদস্য ভারতের পর্তুগীজ উপনিবেশগুলির গভর্নর হিসাবেও নিযুক্ত ছিলেন। ব্যারেটোরা গোয়া থেকে কলকাতায় আসেন। যদিও তাঁরাও ছিলেন মিশ্র বংশোদ্ভূত তাই তাঁদের Laso Indian বলা হত। বড় ভাই যোসেফ তাঁর প্রভুত সম্পদের জন্য Prince of the City নামেও পরিচিত ছিলেন। চার্চের প্রবেশপথের পাশের দেওয়ালে তাঁর নামে একটি স্মৃতিফলক রক্ষিত আছে। কলকাতার রোমান ক্যাথলিকদের প্রথম আর্চবিশপ Reverend Paul Goethal ও এই চার্চেই সমাধিস্থ হন। তিনি ভারতপ্রেমী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত তাঁর দুর্মূল্য গ্রন্থসম্ভার ও বিশেষত প্রাচীন কলকাতার মানচিত্রগুলি বহুকাল সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত ছিল এবং বর্তমানে চ্যাপেলটির দ্বিতীয়তলে Goethel Research Centre এ তা স্থানান্তরিত হয়েছে। এছাড়া চার্চটির বিল্ডিং নির্মাণের আরেক আর্থিক পৃষ্ঠপোষক Count John Lackersteen ও এই চার্চের জমিতে সমাধিস্থ হন। চার্চের সংলগ্ন এলাকায় কিছু পুরাতন আর্মেনীয় সৌধর সাক্ষাৎ মেলে যা ১৭১২ খ্রিষ্টাব্দের আশেপাশে নির্মিত ছিল।
চার্চের প্রবেশপথের দুধারে পর্ব ও পশ্চিম শিখরদুটি মাতা মেরীর মুকুটে সজ্জিত। চার্চের সম্মুখের দেওয়াল মাতা মেরী ও শিশু যিশুর চিত্রে অলঙ্কৃত যার দুধারে দেবদূতদ্বয় অঙ্কিত। প্রার্থনাকক্ষের দুধারের দুই পূর্ণ আকারের মূর্তি St. Paul এবং St. Peter কে উপস্থাপিত করছে। উত্তরে দুটি মর্ম্মরনির্মিত মঞ্চে খ্রিষ্টধর্মের শান্তির বাণী খোদিত। মঞ্চের ডানদিকে যিশুর শিশুমুর্তি আর বামদিকে যোসেফের ক্রোড়ে বালক যিশু। যিশুর জীবনের ১৪টি ঘটনা চার্চের দেওয়ালে চিত্রবিচিত্র। ক্রুশবিদ্ধ হবার সময় যিশুর শ্বেতবস্ত্র শান্তির বার্তা দেয়। এছাড়া যিশুর রক্তাক্ত দেহ ক্রোড়ে ধারণ করে মাতা মেরী, মেরী ম্যাকডালেন প্রমুখর মূর্তিও চার্চে সজ্জিত। এসকল মূর্তি ও চিত্রের আধিক্যই ক্যাথলিক চার্চের বিশেষত্ব যা তাদের প্রোটেস্টেন্ট চার্চ থেকে পৃথক করে। চার্চের দেওয়ালে কিছু পর্তুগীজ ভাষার ফলক ও খচিত হয়েছে যার কোন বাংলা বা ইংরাজি অনুবাদ চার্চে অনুপস্থিত।
দ্য ভার্জিন মেরী অব রোসারি পূর্ব ভারতের তথা ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত হয়েও জগৎ বিচ্ছিন্ন ভাবে তার শিল্পস্থাপত্য, ইতিহাসের সম্ভার নিয়ে এক শান্ত সমাহিত রূপে দন্ডায়মান। তাই কোম্পানী আমলে নির্মিত কলকাতার এই রোমান ক্যাথলিক ক্যাথিড্রাল ব্যতিক্রমী মর্যাদার অধিকারী।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।